মাতামুহুরী, আলীকদম (বান্দরবান ) ঘুরে: সারোশ পাখির ঠোঁটের মত লম্বা ডিঙ্গি নৌকায় সকাল সাড়ে ৮ টায় আলীকদম ঘাট থেকে রওনার সময় প্রথম প্রশ্ন ছিল রূপমুহুরী কত দূর? যেতে কতক্ষণ লাগবে?
নৌকার মাঝি তার সুবিধা মত একটা হিসাব দিলেন। ‘সুবিধা মত’ কথাটা এই জন্যই বলছি যে, পযর্টকের পকেট কাটতে সিদ্ধহস্ত নৌকা চালক যাত্রার শুরুতে বলেছিলেন, রূপমুহুরী ঝরনা অনেক দূর।
অথচ ঘণ্টা খানেক যাওয়ার পর নিরাপত্তাজনিত কারণে জানালী পাড়া সেনাক্যাম্প থেকে যখন আমাদের ফেরত পাঠানো হলো, তখন তিনি বললেন, আর মাত্র ঘণ্টা খানেক গেলেই রূপমুহুরী ঝরনায় পৌঁছানো যেত!
অর্থাৎ চার ঘণ্টার পথ এক ঘণ্টা যাওয়ার পর মাঝির হাতে বাকি আছে আর মাত্র এক ঘণ্টা। বিয়োগ অংকের ‘পণ্ডিত’ মাঝি আমাদের শেখালেন ৪ থেকে ১ চলে গেলে বাকি থাকে ১!
সুতরাং সাড়ে ৫ হাজার টাকায় মেটানো নৌকা ভাড়ার পুরোটাই তাকে পরিশোধ করতে হবে! কম দেওয়া চলবে না!
যাই হোক ভারতের আরাকান রাজ্যে কি এক ঝামেলা চলছে- বিধায় আলীকদমের জানালী পাড়া সেনা ক্যাম্প থেকে কিছুতেই রূপমুহুরী ঝরনায় যাওয়া ছাড়পত্র মিলল না। তাই পেছনো ফিরতে হলো।
মাতামুহুরী নদীর এ অংশটুকু পলিবিধৌত। ফলে পাথরের ভাজে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে নৌকায় ভাসা হলো না। রূপমুহুরীর ঝরনা তলে নীলাভ জলের নীরব সংসার হলো না আনন্দ স্নান। ঘোলা পানিতে ১ ঘণ্টা উজান বেয়ে ভাটির টানে নাও ভাসালাম।
তার মানে এই নয়, রুপমুহুরী ঝরনার চেয়ে রূপে-গুণে মাতামুহুরী পিছিয়ে আছে। অনাদি কাল ধরে বয়ে যাওয়া এই নদী শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে আমাদের। বরং রূপমুহুরীর চেয়ে অনেক বেশি রূপ শরীরের ধারণ করে আকাশ সমান ঊঁচু পাহাড় ডিঙ্গিনে আলী কদমের সমতল দিয়ে বয়ে যাওয়া মাতামুহুরী নদী তার রূপের তেজে মুহুর্তের মধ্যে বেঁধে ফেলল আমাদের!
কিছু কিছু সৌন্দয থাকে, যা বর্ণনার ফ্রেমে বাঁধা যায় না। ঘুরে ফিরে শুধু এ কথা গুলোই বলতে হয়- বর্ণনাতীত, বিস্ময়কর, অপার্থিব, অপরূপ, অভূতপূর্ব, অলৌকিক, অবিশ্বাস্য ইত্যাদি ইত্যাদি!
তেমনিভাবে মাতামুহুরি’র দুই ধারে সবুজে ঠাসা বাদাম ক্ষেত, জলপরীরূপী মগ নারীদের স্নানদৃশ্য, নদীর ধারে সারি সারি বৃক্ষের ডালে সংসার পাতা সাদা বকের ডানা ঝাপ্টানি, নদীর জলে জেলেদের মাছ ধরা, ছোট ছোট শিশুদের এলোমলো ছুটে চলা সর্বপরি কালের ঘষায় স্পাতের রং ধারণ করা ঊচু পাহাড়ের ভাঙ্গা পাজোর দেখার পর বর্ণনাতীত, বিস্ময়কর, অপার্থিব, অপরূপ, অভূতপূর্ব, অলৌকিক, অবিশ্বাস্য বলা ছাড়া উপায় থাকে না।
আকা-বাঁকা নদীর দুই ধারে স্থানীয় বাঙালি মুসলীম নারীদের বাদামচাষ দৃশ্য স্বর্গে যাওয়ার আগ দেখা যে কোনো মানুষের জন্য সেরা দৃশ্য। বাদাম গাছের সবুজ পাতায় মগ রমণীদের স্নেহের পরশ অথবা নদীর ঘাটে নাইতে এসে এলো-মেলো চুলে চিরিনু চালানোর দৃশ্য ইহলোকের বাসীন্দাদের জন্য সব চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় বলা যেতেই পারে।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা ঝিরি নদীতে পতনের শব্দ, উৎপাদিত ফসল- বাঁশ, বেত, মাছ, শসা, পেপে, কলা বয়ে নিয়ে চলা মগ রমণীদের পায়ের শব্দ পযর্টন্ত উপভোগ্য। যার পুরোটাই বহমান মাতামুহুরীকে কেন্দ্র করে।
এই মাতামুহুরীর বাঁকে মেশা স্বর্গ দর্শনে যেতে চাইলে আজই চলে আসুন বান্দরবানের আলীকদমে। এখন থেকে সেনা বাহিনীর জোনের অনুমতি নিয়ে উঠে পড়ুন নৌকায়। অনুমতি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই মাতামুহুরীতে নাও ভাসানো যাবে না। তাহলে আম-ছালা দুটোয় যাবে। গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন না, আবার নৌকা ভাড়া বাবদ পকেট থেকে চলে যাবে সাড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা!
আরও পড়ুন-
** চুম্বকের মতো পযর্টক টানবে চিম্বুক
** নীলাচলে পায়ের নিচে মেঘবালিকা
** মোহম্মদীয়া হোটেলে জুরাছড়ির পযর্টন বাধা দূর!
** এটি কিন্তু জুরাছড়ি!
** হাজারছড়ায় পযর্টকের অপেক্ষায় আফিদা
** বিজিবির আতুরঘরে
** আলুটিলা রহস্যগুহায় গা ছমছমে অনুভূতি
** পাহাড়ে নিরুত্তাপ হরতাল
** সময় বশীভূত ইউএস বাংলায়!
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৬
এজেড/এসআর