কেওক্রাডং, বান্দরবান থেকে: রুমা বাজার থেকে দুঃস্বপ্নের মতো খারাপ সড়ক ১১ মাইল পর্যন্ত। এখান থেকে উত্তরে নেমে যাওয়া খাঁড়া ঢাল বাইতে গিয়ে বুঝলাম আমাদের মতো অ্যামেচার ট্রেকারদের জন্য কাজটি নিতান্ত সহজ হবে না।
অগ্নিপরীক্ষার মতো কঠিন সে ঢালের নিচেই স্বৈরাতন পাড়া। প্রায় ২শ ফুটের মতোই নামতেই ঘেমে একশেষ। যারা ট্রেকিং করে উঠছেন তাদের হা-পিত্যেশ অবস্থা। পাড়ায় নেমে আমাদের অভিজ্ঞ গাইড সাদেকের স্পেশাল কমলার জুস পানে ফের শুরু যাত্রা। মেঘ তখন চোখ রাঙাচ্ছে। সঙ্গে অনেকেগুলো ডিভাইস থাকায় সব পলিব্যাগ ভর্তি করা হলো।
অন্যসব পাহাড়ের মতোই আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে চলতে থাকলাম উত্তর-পশ্চিম কোণ ধরে। হাতে সবার বাঁশলাঠি। শুধু এ ট্রেকিংয়ে আমাদের অগ্রে থাকা ট্রেকার সানভী ছাড়া। সন্ধ্যা নামতেই নামলো বৃষ্টিও। পাহাড়ি অচেনা পথে বৃষ্টি। জুতা সব কাদা জমে হেয়ে গেছে দ্বিগুণ ওজন। দুরুদুরু বুকে কমলাপাড়া থেমে একগাদা কলা আর পেয়ারা খেয়ে এবার আসল পরীক্ষা। টর্চের আলোয় উঠতে হবে বগালেক। সেটা আবার সানভীর কাছেই কেওক্রাডং থেকে কঠিন।
পাহাড় ডিঙানো আর সমুদ্র সাঁতরানো সবচেয়ে কঠিন কাজ। ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ কবির চরণ শিরধার্য করে তাই পা বাড়ালাম সামনে। ২৫ মিনিটে উঠে গেলাম বগালেকের চূড়ায়। যাত্রাপথের সে গল্প থাকবে বগালেকের গল্পে।
রাত হয়ে যাওয়ায় ওইদিন আর যাওয়া হলো না একসময়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া কেওক্রাডং। রাত কাটলো বগালেকে সবার প্রিয় সিয়াম দিদির আতিথেয়তায়। সকালের প্রথম প্রহর বগায় কাটিয়ে বেলা ১১টায় রওয়ানা কেওক্রাডং। সানভী বলছিলেন ট্রেকিংয়ের প্রথম এক দুই ঘণ্টা সবচেয়ে কঠিন। টানা চললে কেউক্রাডং পৌঁছাতে সময় লাগবে তিন ঘণ্টার মতো। কিন্তু অ্যামেচারদের পক্ষে সেটি কঠিন। প্রথম ঘণ্টা নয়, ১০৭৩ ফুটের লেক থেকে ১৪শ’ ফুটে উঠতেই শরীরে বয়ে গেলো ঘামের বৃষ্টি। পেশী টান হয়ে মোচড় দিলো। একটু থামি বলে বসে পড়ে পেটে পড়লো স্যালাইন পানি। ট্রেকিংয়ে এটি অপরিহার্য। বসলে কষ্ট বেশি হবে, তাই দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ফের যাত্রা। ততক্ষণে জোঁকে ধরে টিমের দুজনকে। জোঁক ছাড়ালেও রক্ত পড়লো কিছুক্ষণ।
কখনও খাঁড়া খাদ, কখনও খাঁড়া চড়াই, কখনও পিচ্ছিল। একে অন্যকে একেকটি শব্দে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো পিছনের জনকে। আস্তে আস্তে যেন ভারী হয়ে উঠলো কাঁধের সামান্য ক্যামেরাও। কাঠফাটা তপ্ত রোদে পড়তে থাকলো শরীর। ভেজা গামছা শুকিয়ে যাচ্ছিলো মুহূর্তে। দুপাশের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য উপভোগ তখন হয়ে উঠলো দুঃসহ। পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। যেতে হবে বহুদূর।
১৬শ’ ফুটে গিয়ে দেখা মিললো কেওক্রাডং ট্রেইলের সবচেয়ে বড় ঝরনা চিংড়ির। একদল ভ্রমণপাগল বোহেমিয়ান টাইপ পর্যটকের সঙ্গে উপভোগ করলাম চিংড়ির রূপ। শীতল সে পানি আর শব্দ মোহিত করে রাখলো কিছুক্ষণ। ফের শুরু হলো চড়াই উতরাই। এরইমধ্যে একদলকে দেখা গেলো কেওক্রাডং থেকে নামতে। শুধু বললো যান ভাই ভালো লাগবে। সানভীও বারবার সাহস দিয়ে বলছিলেন এই তো সামনে গিয়ে থামবো। পারবেন চলেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় পানি ফুরোলো সবার। তখন ভরসা কেবল ঝিরি। সাদেক চিনিয়ে দিলো কোন ঝিরির পানি খাওয়া যাবে। সে অনুযায়ী ফ্রিজের পানির মতো ঠাণ্ডা জীবনদায়ী পানি পানে ফের এগোনো। তখন আমরা ২ হাজার ফুটে। অলটিমিটার তাই বলছিলো।
এখানে রয়েছে আবার বড় একটি চড়াই। ততক্ষণে চড়াই দেখলেই সবার জান কাবাব! লাঠ ভর করে জিরিয়ে একে অন্যকে সাহস যুগিয়ে উঠলাম ২২৫০ ফুটে। এটা লংথং পাড়া। এটি যাত্রী ছাউনি আছে সেখানে। পানিতে ডুব দিয়ে আসার মতো ভিজে টিশার্ট খুলে উদোম শরীরে বাতাস লাগানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিলো না। শুধু মনে মনে আওড়ালাম ‘ঘাম রক্ত বাঁচায়’। সে অবস্থায় বসেই গোগ্রাসে খাওয়া হলো ২ ডজন কলা। পরিশ্রম আর ক্ষুধা কি জিনিস ততক্ষণে আর বুঝতে বাকি নেই।
এরই মধ্যে দেখা মিললো দুই ক্ষুদে শিকারি মিরি আর ক্রাসিংয়ের সঙ্গে। হাতে দুটি শিকার করা মৃত পাখি। আর একটিকে ধরে রেখেছে বাঁচিয়ে। সবগুলো খাওয়া হবে। যদিও অনেক বুঝিয়ে কিছু টাকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো পাখিটিকে। এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ পরে জানাবো।
যাত্রাপথে পাহাড়ি নারীদের জুমের ফসল বহন আর কর্মযজ্ঞ বাড়িয়ে দিচ্ছিলো পাহাড়ের কাছে নতি স্বীকারের আকুতি। সামনে দার্জিলিং পাড়া। অনেক শীত এখানে সারাবছর। সেখান থেকে মানকিম পাড়া থেকে নাম হয়ে গেছে দার্জিলিং পাড়া। আমার দেখা দেশের সবচেয়ে গোছালো, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন গ্রাম। দোকানের সামনে ডাস্টবিন। প্রতি বাড়িতে ফুল বাগান। কোথাও আলগা ময়লা নেই। বাড়িগুলোও সুন্দর। মানুষগুলো আতিথেয়তাও তাই। সুন্দর সে গ্রামে ফের সাদেক স্পেশাল কমলা জুস পান করে মূল অভিযান।
এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে কেওক্রাডংয়ের চূড়া। ভয় কমবেশি সবাই পাচ্ছিলাম। সঙ্গে দেশের অন্যমত উঁচু এ শৃঙ্গে আরোহণের উত্তেজনা। তাই পা পিছলে কিংবা খাদে পড়ে মরার ভয় তখন অনেক দূরে। দার্জিলিং পাড়া থেকে রওয়ানা হয়ে আধাঘণ্টায় কেওক্রাডং পৌঁছানোর টার্গেট নিয়ে হেঁটে চিকন রাস্তার দুপাশের লম্বা ধারালো ঘাস ঠেলে এগোনো এবার। কয়েকবার জোঁকে খেয়ে যে রক্ত নিয়েছে সেসব ভুলে যাচ্ছিলাম কষ্টের অন্য এক আনন্দে। একসময় মানুষের স্বপ্নচূড়া কেওক্রাডং যাচ্ছি, বইয়ে পড়া সেই কেউক্রাডং!শুধু মনে হলো এ আরোহণ জয় নয়, এটা বাংলনিউজ টিমের একটি প্রাপ্তি, অর্জন।
আমরা পৌঁছালাম ২৫ মিনিটে। বোধহয় একটু বেশি উত্তেজনায়। লালা বম, সবার লালা দা’র একমাত্র কটেজের সামনে ব্যাগ করে কোনো সময় ক্ষেপণ না করেই সেনাবাহিনীর তৈরি ৬৩ সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম চূড়ায়। ওহ্ কি শান্তি! কি সুন্দর, কি নয়নাভিরাম সে দৃশ্য, কি আবেগি সে অনুভূতি!
সত্যি স্বর্গীয় ছাড়া অন্য কোনো অভিধায় তাকে ফেলা যায় না। স্বর্গীয় স্বপ্নের এ চূড়া থেকে পাহাড় দেখার কথা জানাবো অন্য গল্পে।
থেমে থেমে গল্পগুজব করে আমাদের সময় লাগলো ৪ ঘণ্টা। ফলকে লেখা উচ্চতা ৩১৭২। অল্টিমিটারে ৩১৭৭! সবশেষে প্রশ্ন জাগলো যদি এ পর্যন্ত গাড়ি ওঠে, রাস্তা ভালো হয়, তাহলে কি এ মজা, অ্যাডভেঞ্চার কি থাকবে!
যেভাবে যাবেন: বান্দরবান থেকে চাঁদের গাড়িতে রুমা বাজার। খরচ রিজার্ভ ৫-৫ হাজার টাকা। গাড়িতে ১০০। রাস্তা খারাপ তাই কুমার চর পর্যন্ত হাঁটতে হবে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের অনুমতি লাগবে। কাছে রাখবেন এনআইডির ফটোকপি। বড়শিপাড়া থেকে ১১ মাইল পর্যন্ত ল্যান্ডক্রুজার রিজার্ভ ২৫শ টাকা। এবার গাইডসহ হেঁটে বগালেক। গাইড খরচ দিনে ৬শ টাকা। বগালেক ও কেওক্রাডংয়ে প্রতিবেলা খাবার ও থাকার খরচ জনপ্রতি ১শ থেকে ১৫০ টাকার প্যাকেজ। তবে মান আশা করা ভুল।
সঙ্গে রাখবেন: ব্যথার ওষুধ, স্যালাইন, ছুরি, ফাস্টএইড, ভালো ব্যাকপ্যাক, হালকা সব জিনিস, রোদচশমা, গামছা, পানির পট, বাঁশলাঠি, বেল্টওয়ালা আরামদায়ক জুতা, পাওয়ার ব্যাংক ইত্যাদি।
** পৃথিবীর সেরা পানি আমাদের পাহাড়ে!
** রাস্তা হলে দেশি পর্যটকই জায়গা পাবে না বগালেকে
** পাহাড়ের ময়না যাচ্ছে পর্যটকের খাঁচায়
** হরেক পদের খাবারে ওয়াগ্যোয়াই পোয়েঃ’র শুভেচ্ছা
** পাহাড়চূড়ায় চোখের সামনে রংধনুর ’পর রংধনু (ভিডিওসহ)
** ইউরোপ-আমেরিকাকেও পায়ে ঠেলবে রাঙামাটির লংগদু
** ধসে যাচ্ছে রাঙামাটি শহরের পর্যটন
** রাঙামাটিতে বোটভাড়া নিয়ে ঠকবেন না যদি…
** বিকেলটা কাটুক হেরিটেজ পার্কে
** দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তির দেশে
** পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী সব খাবার ‘সিস্টেমে’
** বাঁশের ভেতর মুরগি, পদের নাম ব্যাম্বো চিকেন
** পাহাড়ের সবুজ মাল্টায় দেশজুড়ে বিপ্লব
** নীলাচলে ভোরের আলোয় মেঘের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৬
এএ/এইচএ