কেওক্রাডং-রুমা, বান্দরবান ঘুরে: বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু স্বাদু পানির প্রাকৃতিক হ্রদ বগালেক থেকে রওনা দিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ২২শ’ ফুট উঁচুতে সাময়িক বিশ্রাম শেষে আবার ছুটে চললাম কেওক্রাডংয়ের পথে।
উদ্দেশ্য ছিল লুংথং পাড়ার যাত্রীছাউনি থেকে যতদ্রুত সম্ভব কেওক্রাডংয়ের সেই কাঙ্ক্ষিত চূড়ায় ওঠা।
কয়েকটি পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখনই দলের একজনের চিৎকার, ওই যে দেখা যায় কেওক্রাডংয়ের চূড়া। মনের মধ্যে সেসময় ‘স্বপ্ন’ জয়ের ইচ্ছা আরও প্রবল হলো। অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে ক্যামেরার ল্যান্স ঘুরিয়ে কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারলাম চূড়ায় ছোট ছোট দু’টি ঘর আছে। আপাতত এটুকু তৃপ্তি নিয়ে সামনে আবারও পা বাড়ালাম।
মিনিট বিশেক হাঁটতেই চোখে পড়লো মাঝারি আকারের কয়েকটি রঙিন কুটির। দূর থেকে দেখতেই বেশ শান্ত-পরিপাটি মনে হলো। অভিযাত্রী দলের ট্রাভেলার রিয়াসাদ সানভী জানালো, এটা ‘দার্জিলিং পাড়া’। তবে এটা সুদূর দার্জিলিং নয়, বাংলার দার্জিলিং পাড়া।
সম্প্রতি আমার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। মনে মনে দু’টো পাড়ার পার্থক্য খুঁজতে শুরু করলাম। গঠন-আকৃতি এবং পরিবেশগত দিক থেকে দু’টির আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেও এখানকার মানুষজনের জীবনযাত্রায় অনেক ভিন্নতা পাওয়া গেল। পশ্চিমবঙ্গে দার্জিলিংয়ের রিশপ, লাবাতে প্রতিটি পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে একটি অথবা দু’টি করে কটেজ। তবে এ পাড়ায় একেবারেই ভিন্ন চিত্র চোখে পড়লো। বাংলার এ দার্জিলিং পাড়ার মাঝ দিয়ে সোজা চলে গেছে কেওক্রাডংমুখী রাস্তা। আর দু’পাশে সুন্দর-সাজানো গোছানো ছবির মতো ৩০-৩২টি কুটির।
পরিপাটি সাজানো-গোছানো পাড়াটি দেখে একটু ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। সবাই মিলে স্থানীয় বাসিন্দা ধংনিং এর ছোট দোকান কাম ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিলাম। এ ফাঁকে একটু পাড়াটা ঘুরেও দেখা হলো।
পাড়ায় প্রথম সে ব্যতিক্রম চিত্র চোখে পড়লো তা হলো ফুল বাগান। প্রায় প্রতিটি কুটিরের সামনে ছোট ছোট করে বিভিন্ন ফুলের বাগান রয়েছে। একটু সামনে এগিয়ে বামে চোখ ফেরাতেই চোখে পড়লো ‘দার্জিলিং লোকাল চার্চ’। তার ঠিক উপরেই রয়েছে একটি দোতলা কাঠের ঘর। বাইরে থেকে কিছুটা কারুকার্য করা, উপরে টিনের ছাউনি। বলে রাখা ভাল, এখানকার প্রতিটি ঘরেই টিনের ছাউনি। কোনো কোনোটাতে আবার রঙিন টিন।
এ পাড়াটি দু’টি মৌচার অন্তর্গত। একটি হচ্ছে রুমা, অন্যটি নাইতিং। সে কারণে সাংসিন এবং বেনজামিন নামে দু’জন কারবারি এ পাড়ায়।
বাংলার এ দার্জিলিং পাড়ার বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা চলে আদা চাষের ওপর। আদা তাদের প্রধান অর্থকরী ফসল।
তবে স্থানীয় বাসিন্দা ধংনিং দম্পতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বর্ষার সময় তাদের খুব সংগ্রাম করতে হয়। বৃষ্টিপাতের কারণে রুমা পর্যন্ত গাড়ি চলে না। তাই তাদের উৎপাদিত আদা পাইকারের কাছে পৌঁছাতে পারেন না। এজন্য লোকসানও হয়।
কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় কতবার উঠেছেন? সহজ, সহাস্য উত্তর- শতাধিকবার! আমাদের কাছে হয়তো তার এ উত্তর শুনতে অবাকই লেগেছে। কিন্তু এটাই বাস্তত, এটাই তাদের জীবন সংগ্রামের অংশ।
জানা যায়, ১৯৬৬ সালে মাংকিপ যাহাও কম নামে একজন সর্বপ্রথম এখানে বসবাস শুরু করেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আড়াইহাজার ফুট উঁচুতে এ পাড়ায় খুব ঠাণ্ডা-শীত অনুভূত হতো। আর পশ্চিবঙ্গের দার্জিলিং সাড়ে ৬ হাজার ফুট উপরে। পরবর্তীতে পর্যটকরা এটাকে ভারতের দার্জিলিংয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ‘দার্জিলিং পাড়া’ নামে প্রচার শুরু করেন। সেই থেকে এটি এ নামেই পরিচিতি পায়।
এবার উঠতে হবে কেওক্রাডং এর সর্বোচ্চ চূড়ায়...।
আরও পড়ুন-
** দুই হাজার ফুট উঁচুতে যাত্রী ছাউনি!
** আকাশছোঁয়া পাহাড়ি পথে রুমা
** লেকের দু’ধারে প্রকৃতির সঙ্গে রোমাঞ্চ!
** ঝুলন্ত ব্রিজ পার্কের অব্যবস্থাপনায় বিরক্ত পর্যটক
** মেঘ-পাহাড়ের অকৃপণ সৌন্দর্যের আধার খাগড়াছড়ি
** পর্যটকদের কাছে খাগড়াছড়ির ফল-সবজির কদর
**অনাবিল শান্তি শান্তিপুর অরণ্য কুটিরে
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৬
এসএইচ/জেডএস