বান্দরবান জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষ থেকে: সাগর মানুষকে টানে। আর পাহাড় মানুষকে শুধু্ টানেই না, বেঁধেও রাখে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে শনিবার (২২ অক্টোবর) বান্দরবান জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বাংলানিউজ আয়োজিত দ্বিতীয় দিনের বিশেষ আলোচনায় কথা বলছিলেন তারা। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের পর্যটন স্পটগুলোতে ঘুরে ঘুরে বাংলানিউজ কর্মীদের করা প্রতিবেদন নিয়ে এ আলোচনার আয়োজন করা হয়।
বাংলানিউজের দু’দিনব্যাপী আয়োজনের প্রথম দিন শুক্রবার (২১ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত হয় বিশেষজ্ঞ আলোচনা। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলানিউজ এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন। প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) দিলীপ কুমার বণিক। আলোচনায় পর্যটন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টরা অংশ নেন।
আর দ্বিতীয় দিন শনিবার আয়োজন করা হয় বিশেষ আলোচনার। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান অপরূপ চৌধুরী। অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান তুহিন। সভাপতিত্ব করেন বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দিদারে আলম মো. মাকসুদ চৌধুরী।
আরও উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র এএসপি শম্পা রানী সাহা, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুজন চৌধুরী, ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিদর্শক সুহৃদ চাকমা, বান্দরবান প্রেসক্লাব সভাপতি আমিনুল ইসলাম বাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক মিনারুল হক, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও মাসিক চিম্বুকের সম্পাদক বাদশা মিঞা, জেলা অনলাইন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরান ফারুক, হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম, হলিডে ইন রিসোর্টের মালিক জাকির হোসেন, ট্যুর বাংলাদেশের পরিচালক ডাবলু বড়ুয়া প্রমুখ।
দু’দিনের আলোচনাতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জেলার চেনা-অচেনা স্পট ঘুরে বাংলানিউজ টিমের করা প্রতিবেদন মাল্টিমিডিয়া প্রোজেক্টরে উপস্থাপন করেন বাংলানিউজের সিনিয়র আউটপুট এডিটর ও বছর জুড়ে দেশ ঘুরে কর্মসূচির ট্যুর প্ল্যানার জাকারিয়া মন্ডল ও অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর আসিফ আজিজ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন লাইফস্টাইল এডিটর শারমীনা ইসলাম। সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন চিফ অব করেসপন্ডেন্টস সেরাজুল ইসলাম সিরাজ। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট মবিনুল ইসলামের স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়।
অপরূপ চৌধুরী বলেন, অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রোডাক্টের প্রতি ডেস্টিনেশন থাকে। আর ট্যুরিজমে ডেস্টিনেশনের কাছে প্রোডাক্ট পৌঁছে দিতে হয়। এক্ষেত্রে ট্যুরিজমের অনুষঙ্গ বিশেষ করে করে যাতায়াত ব্যবস্থা, অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন।
“পর্যটনখাতে বিশ্বে প্রতি আড়াই সেকেন্ডে একজনের কর্মসংস্থান তৈরি হয়। পর্যটক কোনো ডেস্টিনেশনে গেলে কমপক্ষে ১১ জন জড়িয়ে পড়েন। এছাড়া আরও অনেকেই বিভিন্নভাবে এ খাতে জড়িত থেকে লাভবান হন।
তিনি বলেন, ট্যুরিজম একটি ইন্ডাস্ট্রি। এ ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন প্রোডাক্ট পরিচয় করাতে হবে। পর্যটনের বৈচিত্র্যকেও বিকশিত করতে হবে। এতে পর্যটকের আগ্রহ বাড়বে।
পর্যটন করপোরেশন চেয়ারম্যান বলেন, দিনদিন ইকো-ট্যুরিজম, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম, রিলিজিয়াস ট্যুরিজমের প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। অ্যাডভেঞ্চারিংয়ের মাধ্যমে অজানা জায়গাতেও ট্রেকিং করে নতুন নতুন স্পট আবিষ্কার করছে তারা।
“বিষয়টি মাথায় রেখেই ইকো, রিলিজিয়াস ও অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি কিংবা যৌথ উদ্যোগে তা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। ”
অপরূপ চৌধুরী বলেন, বিদেশি ট্যুরিস্টদের কাছে বাংলাদেশ এখনও সিঙ্গেল ডেস্টিনেশন হয়নি। দক্ষিণ এশিয়া কিংবা এশিয়ায় এলে এখানে আসেন তারা। কক্সবাজার এয়ারপোর্টকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কাজ চলছে। এটি কমপ্লিট হলে বিদেশি পর্যটকরা সেখান থেকে বান্দরবান রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি বা চট্টগ্রামও ভ্রমণ করতে পারবেন।
পাহাড়-বন রক্ষা করে দায়িত্বশীল পর্যটন গড়ে তোলার ওপরও তাগিদ দেন তিনি।
দিলীপ কুমার বণিক বলেন, পর্যটকদের জন্য বান্দরবানের মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি উদার। বাইরের যারা আসেন তাদের হৃদ্যতার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করে নেন।
“বর্তমানে পর্যটন শিল্প সারাবিশ্বে প্রধানতম আয়ের খাত হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এ খাত অনেক দেশের প্রধান আয়ের উৎস। আর আমাদের দেশে পর্যটন হাজার বছর ধরে আয়ের উৎস। আমাদের এ অঞ্চলের সৌন্দর্য সবাইকে আকৃষ্ট করেছে। ”
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী পর্যটন অর্থনৈতিক স্বীকৃত একটি বিষয়। এর মাধ্যমে অনেকেরই জীবন-জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে। যেমন, নেপাল ও মালদ্বীপ। এমনকি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আয়ের একটি বড় অংশ আসে পর্যটন থেকে।
বাংলানিউজের আলোচনায় যেসব বিষয় উঠে এসেছে তার সবগুলোর সমাধানের চেষ্টা করা হবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক। পর্যটন নিয়ে বাংলানিউজের সামনের যেকোনো আয়োজনে নিজের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহায়তার আশ্বাস দেন দিলীপ কুমার বণিক।
দিদারে আলম মো. মাকসুদ চৌধুরী কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ট্যুরিজম কমিউনিটি বেজড হলে স্থানীয় লোকজনই পর্যটনের বিকাশে কাজ করবে। তাছাড়া, পর্যটনের প্রচার-প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে বাংলানিউজ। এখন সবাই কাজ করছে। বান্দরবানের পর্যটন ব্র্যান্ডিং হচ্ছে। এটাকে বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে দিতে হবে।
মাহবুবুর রহমান তুহিন বলেন, পর্যটন শিল্পকে প্রোমোট করলে গার্মেন্টসের পরই এ খাত অন্যতম আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়াবে। এজন্য বাংলাদেশকে পর্যটনের ক্ষেত্রে ‘সিঙ্গেল ডেস্টিনেশন কান্ট্রি’ বা একক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
“প্রতি বছর ১০ লাখ পর্যটক যেন বাংলাদেশে আসে সে ব্যবস্থা করা হবে। এজন্য ট্যুরিস্ট ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। পর্যটন পুলিশ এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। ”
পর্যটনের বিকাশে পুলিশ বিভাগও কাজ করছে জানিয়ে শম্পা রানী সাহা বলেন, পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বান্দরবানে ট্যুরিস্ট পুলিশ আরও বাড়ানো হচ্ছে। পুলিশ কেবল দেশেই নয়, বিদেশে কোনো মিশনে গেলেও দেশের পর্যটনের ব্র্যান্ডিং করছে।
পার্বত্যাঞ্চলের পর্যটন সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান সুজন চৌধুরী।
আর পর্যটকদের সুবিধার্থে ছোট করে হলেও বান্দরবানে একটি ডোমেস্টিক (অভ্যন্তরীণ) বিমানবন্দর চালুর আহ্বান জানান জাকির হোসেন।
সুহৃদ চাকমা বলেন, পর্যটকদের সুবিধার্থে সব ধরনের তথ্য সরবরাহ করা হয় ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে।
পর্যটনের বিকাশের কাজ জোরদারের জন্য বান্দরবানে পর্যটন করপোরেশনের অফিস স্থাপন করতে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান মো. সিরাজুল ইসলাম।
বাদশা মিয়া কথা বলেন পর্যটক স্পটগুলোকে প্রবীণবান্ধব করার বিষয়ে। তিনি এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
আমিনুল ইসলাম বাচ্চু আশাবাদ ব্যক্ত করেন, সঠিক পরিকল্পনায় সমন্বিতভাবে কাজ করলে ট্যুরিজম বান্দরবান জেলার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হবে।
সমন্বিতভাবে কাজ করার কথা বলেন মিনারুল হকও।
ডাবলু বড়ুয়া দু’টি পর্যটন স্পটের কথা তুলে ধরে বলেন, সাতভাইখুম-আমিয়াখুম ট্রেকিংয়ের জন্য সুন্দর স্থান। কিন্তু সেখানে খাওয়ার পানির খুবই সংকট। এ সংকট দূর করতে হবে।
কামরান ফারুক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি জাদুঘর করা দরকার। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনাচার নিয়ে একটি তথ্যপুঞ্জি করা দরকার। এতে পর্যটকরা এ অঞ্চলের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন।
বাংলানিউজের এ উদ্যোগে সহযোগিতা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, বান্দরবান পার্বত্য জেলা প্রশাসন ও ট্রাভেল এজেন্সি ফড়িং।
আরও পড়ুন-
**পর্যটনের বৈচিত্র্য বিকশিত করতে হবে
**বান্দরবানের পর্যটনের খুটিনাটি নিয়ে হ্যান্ডবুক প্রয়োজন
**কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম গড়ে তুলতে হবে
**কমিউনিটিভিত্তিক পর্যটন বিকাশের উপর জোর দেওয়ার আহ্বান
**পর্যটন খাতের প্রচার-বিকাশে অগ্রণী ভূমিকায় বাংলানিউজ
**পর্যটনে প্রতি আড়াই সেকেন্ডে একজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়
**বিদেশেও আমরা দেশের পর্যটন-সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করি
**ট্যুরিস্ট স্পটগুলো চিহ্নিত করে আকর্ষণীয় করতে হবে
**বান্দরবানে ট্যুরিস্ট পুলিশ আরও বাড়ছে
**পর্যটকদের জন্য বান্দরবানের মানুষ উদার
**ট্যুরিজমে বাংলাদেশকে ‘সিঙ্গেল ডেস্টিনেশন কান্ট্রি’ করতে হবে
**পর্যটনে সমস্যা সমাধানে মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসার আহ্বান
**বান্দরবানে ডমেস্টিক বিমানবন্দর চালুর আহ্বান
**পর্যটন বিকাশে বাংলানিউজ মাইলফলক
**পর্যটকদের তথ্য সরবরাহ করে ট্যুরিস্ট পুলিশ
**হোটেল মালিকদের প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত অন্যান্য দেশের সঙ্গে
**বান্দরবানে পর্যটন করপোরেশনের অফিস স্থাপনের আহ্বান
**খাগড়াছড়ির দর্শনীয় স্থানগুলো এখনো অনাবিষ্কৃত
**পর্যটক স্পটগুলোকে প্রবীণবান্ধব করার আহ্বান
**ট্যুরিজম হবে বান্দরবানের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি
**বাংলানিউজের আয়োজন পর্যটনবান্ধব
**বান্দরবানে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাদুঘর করার আহ্বান
**পর্যটনে সবচেয়ে পিছিয়ে খাগড়াছড়ি
**পর্যটন এগিয়ে নিতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে
**বাংলাপিডিয়ায় বান্দরবানের পর্যটন নিয়ে সঠিক তথ্য দেওয়ার আহ্বান
**সাতভাইখুম- আমিয়াখুমে পানি সংকট দূর করা জরুরি
**পাহাড়ে পর্যটন: বাংলানিউজের দ্বিতীয় দিনের আলোচনা শুরু
**পাহাড়ে পর্যটন: বাংলানিউজের দ্বিতীয় দিনের আলোচনা শুরুর অপেক্ষা
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৬
এইচএ/জেডএম