ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

অজগরের মাংস খেতেই জেগে উঠলো বগালেক!

আসিফ আজিজ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৬
অজগরের মাংস খেতেই জেগে উঠলো বগালেক! ছবি: আসিফ আজিজ-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বগালেক, রুমা ঘুরে: আদিকালের কথা। এই পাহাড়ে বসবাস করতো ৬০ পরিবার।

তারা একদিন বড় আকারের একটি অজগর সাপ পেলো। সবাই সিদ্ধান্ত নিলো, সাপটি কেটে সব পরিবার ভাগ করে মাংস খাবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অজগরটি কেটে সবাই মাংস ভাগ করে নিলো। এক বিধবার ভাগে পড়লো মাথাটি।

বিধবার বাড়ি লাল মার্ক করা স্থানে ছিলো বলেই দাবি স্থানীয়দের
বিধবা বললেন, আমাকে যেটি রান্না করে দেবে তাতে মরিচ বেশি দেবে না। বেশি দিলে চোখ জ্বলবে। সাপের মাথাটি রাখা হলো একটি মুরগির ঘরে। তখন মাথাটি কথা বলে উঠলো! একটি সময়ও বলে দিলো। বললো সবাই এখান থেকে চলে যাও। এই পাড়া ডুবে যাবে। যারা মাংস খেয়েছো সবাই ডুবে মরবে। কিন্তু সবাই গেলো না। ডুবে গেলো পাড়া। শুধু ডুবলো না সেই বিধবা নারীর ঘর। যিনি শেষ পর্যন্ত মাংস খাননি। যে বাড়িটির চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে লেকের পাড়ে।

বগালেক নিয়ে যে কিংবদন্তি, জনশ্রুতি রয়েছে পাহাড়িদের কাছে  তার অন্যতম এটি। এমনটি জানাচ্ছিলেন বগালেকে আসা পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় নাম সিয়াম দিদি। তাদের বিশ্বাস, এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে বগালেক। গল্পটি আরও অনেক বড়। সংক্ষেপে এমন। যে বিধবা নারীর ঘর সেদিন ডোবেনি সেই ঘরের জায়গাটি নিজে দেখালেনও তিনি।

আমাদের অলটিমিটারের রিডিং অনুযায়ী প্রায় ১২শ’ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের কোলে অপূর্ব এক স্বাদু পানির উৎস বগালেক। যদিও উচ্চতা কোথাও লেখা ১৭শ’ ফুট, আবার কোথাও ২৪শ’। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলামের পরিমাপ অনুযায়ী, লেকের উচ্চতা ১ হাজার ৭৩ ফুট। আর গভীরতা ১১৫ ফুট। লেক এলাকায় বসবাসকারীরা জানালেন, এই শিক্ষকই প্রথম উচ্চতা ও গভীরতা মাপেন। লেকের পাশে তাই একটি গোলঘর আছে তার নামে। সেখানেই লেখা এ তথ্য।

পর্যটক ও ট্রেকারদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত, গুরুত্বপূর্ণ স্থান বাংলাদেশের পঞ্চম সর্বোচ্চ চূড়া কেওক্রাডংয়ের পাদদেশের পাহাড়ের এ অনিন্দ্য সুন্দর লেক। পর্যটকদের কাছে যখন এটি গন্তব্য, ট্রেকারদের কাছে তখন এটি বেসক্যাম্প। এখানে থেমেই ট্রেক করে যেতে হয় কেওক্রাডং।

বাংলানিউজ টিম রুমা বাজার থেকে বকশিবাজার পর্যন্ত হেঁটে এসে ভয়াবহরকম খারাপ, কর্দমাক্ত, উঁচু-নিচু ঢিবির এক সড়কে ল্যান্ডক্রুজারে যখন ১০ কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে ১১ মাইলে নামলো তখন বিকেল সাড়ে ৩টা। পাহাড়ি পথে কিলোমিটার হিসাব করা কঠিন। ‘পাহাড় ডিঙানোর প্রচণ্ড স্পর্ধা’ গানের চরণগুলি মনে পড়লো যখন প্রথম খাড়া ঢাল বেয়ে স্বৈরাতন পাড়ায় নামি। মেঘ গুমরিয়ে উঠে এখান থেকে আরও ঘণ্টা দুয়ের হাঁটাপথ মাড়িয়ে তবেই বগালেক।

স্বৈরাতন পাড়ায় একটু জিরিয়ে জুস, পানি পান করে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কমলাপাড়া পৌঁছুতেই নিস্তেজ সূর্যদেব। নেমেছে আঁধার। নিস্তব্ধতা ভেঙে কানে ভেসে আসছে পাহাড়ি পোকার গান। মুরং কন্যা টুমসিংয়ের দোকানে পাহাড়ের মিষ্টি পেয়ারা আর কলা খেয়ে ট্রেকার সানভীর কাছে জানা গেলো, কেওক্রাডং এর চেয়ে ঢের কঠিন খাড়াই মাড়াতে হবে এখন। তাও আবার বৃষ্টিভেজা রাতে। ২৫ মিনিটে টর্চের আলোয় রুদ্ধশ্বাস সেই খাড়াই অতিক্রম করে রাত সোয়া ৭টায় পৌঁছুলাম বহুকাঙ্ক্ষিত বগালেক। স্বস্তির নিশ্বাস পড়লো সবার। লেকের ওপরের পাহাড়ে অলটিমিটারে রিডিং উঠলো ১২২৩ ফুট।

আবার ঢাল বেয়ে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে নিলাম সিয়াম দিদির আতিথেয়তা। রাত ৮টা পর্যন্ত অনুমতি আছে এখানে ঢোকার। লেকের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা কটেজের বারান্দায় বসে প্রথম দেখলাম চাঁদনি রাতে বগালেকের সৌন্দর্য। এরই মধ্যে লেকের স্বচ্ছজলে সবাই মিলে গোসল সেরে ঝেড়ে নিলাম দিনের সব ক্লান্তি। পরে সিয়াম দিদির খাবার ঘরের সামনে আড্ডা। এখানে বসে জানা গেলো বগালেক নিয়ে আরও এক কিংবদন্তি।

বম আদিবাসী অধ্যুষিত বগালেকের কয়েকজন শোনালেন, ১৫ একর জায়গার বগালেক সৃষ্টি হয়েছে অনেক আগে। একসময় এখানে একটি চোঙা আকৃতির পাহাড় ছিলো। সেখানে বসবাস করতো বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর আদিবাসী। ঘন বনঘেরা সেই পাহাড়ে প্রায়ই হারিয়ে যেত পোষা গবাদি পশু। একদিন একদল যুবক কারণ অনুসন্ধানে গিয়ে দেখলো ভয়ংকর দেখতে এক ড্রাগন। তাকে মেরে ফেললো সেই যুবকরা। সঙ্গে সঙ্গে গর্জন করে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো আগুন। পুড়িয়ে দিলো আশপাশের সব। সৃষ্টি হলো লেক। ড্রাগনকে বম ভাষায় বলে বগা। সেই থেকে বগালেক।

পাহাড়িতে কাছে এমন জনশ্রুতি আর বিশ্বাস থাকলেও ভূ-তাত্ত্বিকদের কাছে এটা মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ।

ভোরে উঠে পাওয়া গেলো বগালেকের অন্যরূপ। লেকের পাশের পাহাড়গুলোতে বেড়াতে নেমেছে মেঘদল। স্বচ্ছ পানিতে পড়েছে নীলাকাশের ছায়া। পানিও ধারণ করেছে সে বর্ণ। লেকপাড়ের সবুজ গাছ ছায়া ফেলেছে লেকে। পানির ধারে মাছেরা সৃষ্টি করেছে আরেক জগৎ। পা পাতলেই ঘিরে ধরে ঠুকরে খায়। দেয় ফিশ স্পার অনুভূতি!

অন্যরকম এক স্নিগ্ধতা এনে দেয় ভোরের বগার মায়াবি রূপ। সে রূপ দর্শন করে সিয়াম দিদির কাছে এসে ডাল, আলুভর্তা আর ডিম দিয়ে পেটপুরে খেয়ে রওয়ানা পরবর্তী গন্তব্য কেওক্রাডং।

অনেকের কাছে অভিশপ্ত সেই বগাই এখন জীবন-জীবিকা কেওক্রাডং, রুমা, বগালেক এলাকার কয়েক হাজার মানুষের। পাহাড়কোলের আশ্চর্য এ লেক এখনও বিস্ময় মানুষের কাছে।

**সাদেকের কমলার জুসে পাহাড় মাড়ানোর ক্লান্তি দূর
**খাবারে পাহাড়ি সাজ-ঐতিহ্যের হলিডে ইন
**পাহাড়ি শিশুর খেলায় প্রাণ যায় মায়াবি পাখির
** পৃথিবীর সেরা পানি আমাদের পাহাড়ে!

** ৩ ঘণ্টার ট্রেইলে ঘেমে-নেয়ে কেওক্রাডংয়ের স্বর্গচূড়ায়
** রাস্তা হলে দেশি পর্যটকই জায়গা পাবে না বগালেকে

** পাহাড়ের ময়না যাচ্ছে পর্যটকের খাঁচায়
** হরেক পদের খাবারে ওয়াগ্যোয়াই পোয়েঃ’র শুভেচ্ছা
** পাহাড়চূড়ায় চোখের সামনে  রংধনুর ’পর রংধনু (ভিডিওসহ)
** ইউরোপ-আমেরিকাকেও পায়ে ঠেলবে রাঙামাটির লংগদু
** ধসে যাচ্ছে রাঙামাটি শহরের পর্যটন
** রাঙামাটিতে বোটভাড়া নিয়ে ঠকবেন না যদি…
** বিকেলটা কাটুক হেরিটেজ পার্কে
** দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তির দেশে
** পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী সব খাবার ‘সিস্টেমে’
** বাঁশের ভেতর মুরগি, পদের নাম ব্যাম্বো চিকেন
** পাহাড়ের সবুজ মাল্টায় দেশজুড়ে বিপ্লব
** নীলাচলে ভোরের আলোয় মেঘের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ 

 

বাংলাদেশ সময়: ১৯১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৬
এএ/জেডএম

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ