খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান ঘুরে: একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অন্যান্য ফসলের মতো আখ চাষ ছিল স্বল্প পরিসরে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে বর্তমানে পার্বত্য তিন জেলাতেই প্রচুর জমিতে ও পাহাড়ের পাদদেশে চাষ হচ্ছে আখের।
পার্বত্য এলাকায় আখের চাষ ও বাজার ক্রমেই বাড়ছে। ফলে অনেকটা নীরবেই এ অঞ্চলে আখ চাষে বিপ্লব শুরু হয়েছে। এতে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে তামাক ও জুম চাষিদের। এতে তাদের আর্থিক উন্নতি ছাড়াও ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাচ্ছে প্রকৃতি-পরিবেশ।
সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের কয়েকটি এলাকা ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
চাষিরা বলছেন, পাহাড়ি এলাকায় আখ চাষে খরচ সমতলের চেয়ে বেশি, লাভও বেশি। এখানকার আখ আকারে ১২ থেকে ১৫ ফুট লম্বা, মোটা ও সুমিষ্ট।
খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার রাজবাড়ী সংলগ্ন শতবর্ষী বাজারের রাস্তায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আখ বিক্রি করেন মো. নুরুল হক। বাজারে আখ বিক্রি করে চলছে তার ৭ জনের সংসার। তিনি হাজারপ্রতি ২০-২৫ হাজার টাকা দরে আখ কিনে প্রায় দ্বিগুণ দামে বেচেন।
গত ১৩ অক্টোবর তার সঙ্গে আলাপকালে জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ি এলাকায় আখ চাষে এসেছ বিশাল পরিবর্তন। এতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন নৃগোষ্ঠীর লোকজন।
ওই বাজারে চান্দের গাড়িতে আখ নিয়ে এসেছেন এয়াতোলংপাড়ার ইয়াসিন ও দুই পাহাড়ি যুবক। তারা জানালেন, পাহাড়ের নিচে পতিত জমিতে আখ চাষ করছেন। প্রতিবিঘা খরচ প্রায় ৩০ হাজার টাকার মতো। বিক্রি করে পাচ্ছেন ৫০ হাজারের বেশি।
তারা জানালেন, আখ চাষে প্রচুর বাঁশ প্রয়োজন। বাঁশের দর বেড়ে প্রতিশ’ আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা হয়েছে। ফলে তাদের খরচও বেড়ে গেছে।
১৪ অক্টোবর পানছড়ি উপজেলার এক আদিবাসী পল্লীর দোকানে কথা হয় আখ বেপারী সাজাই মারমার সঙ্গে। তিনি জানান, খেত থেকে আগেই আখ কিনে রাখেন। পরে চাহিদা অনুযায়ী বিক্রি করেন। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ফেনী থেকে আসা মহাজন এসব এলাকার আখ কেনেন। প্রতিআঁটি আখ (১০টি) ১০-১৫ টাকা দরে বিক্রি করেন। খরচ বাদে মুনাফা থাকে আঁটিপ্রতি ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত।
আখ চাষের মাঠের তথ্যের মিল পাওয়া গেল বান্দরবান ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইনচার্জ ক্যাছেন মারমার বক্তব্যে।
তিনি জানান, বর্তমানে পার্বত্য জেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আখ চাষে সহায়তা দিচ্ছেন তারা। এজন্য জুম ও তামাক চাষিদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। তাদের গবেষণালব্ধ বীজ এবং সার ও কীটনাশক বিনামূল্যে দেওয়া ছাড়াও চাষিদের সবরকম সহায়তা করা হচ্ছে।
তিনি জানান, বান্দরবান সদর, লামা, আলীকদম, রুমা, রোয়াংছড়ি উপজেলার ৭১০ হেক্টর জমিতে; রাঙামাটি সদর, কাউখালী, কাপ্তাই, বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর ও জুরাছড়ি উপজেলার ৬৭০ হেক্টর জমিতে এবং খাগড়াছড়ি সদর, পানছড়ি, দীঘিনালা, রামগড়, মানিকছড়ি ও মাটিরাঙ্গা উপজেলার ৭৯০ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হচ্ছে।
এসব এলাকার ৬০ ভাগ আখ চাষি পাহাড়ি। তারা পাহাড়ের নিচে ঢালু জমিতে আখের সঙ্গে সাথী ফসল চাষেও সহায়তা করছেন।
তিনি জানান, যার নিজস্ব জমি রয়েছে তাকে বীজ একবারই দেওয়া হয়। তবে বিনামূল্যে তিন দফায় অন্তত ৩০ কেজি সার দেওয়া হয়।
কৃষকদের আখ বিক্রির ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে সরকারিভাবে ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় বলেও তিনি জানান।
তিনি জানান, ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট হচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা আখ থেকে জুস ও গুড়জাত পণ্য উদ্ভাবন করেছেন। টেবিয়া পাতা থেকে চা তৈরির গবেষণাও শেষ পর্যায়ে।
পাহাড়ে বর্তমানে আখ চাষের যে গতি তাতে এ অঞ্চলের কৃষি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আর্থিক পরিবর্তনে এটিই বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন>>
** টাইটানিক ও মেঘ-পাহাড়ের মিরিঞ্জা
** বিকল্প পেলে তামাক চাষ ছাড়বেন আলীকদমের চাষিরা
** একজন শামসুল ও কৃষিতে পরিবর্তনের শুরু ....
** শিশিরভেজা সকালে ম্যারাইংতং পাহাড়ের ম্রো পাড়ায়
** মাতামুহুরী নদীর 'বক দ্বীপ'
** প্রবারণায় বান্দরবান রাজার মাঠে উৎসবের সাজ
** নিরবধি বয়ে চলা 'শৈল প্রপাত'
** দ্য ওয়াটার ল্যান্ড অব রাঙামাটি
** পানির রাজ্যে পাহাড়ের বুদ্ধ...
** প্রশান্তি বিলাতে কাপ্তাইয়ের ‘রিভার ভিউ পিকনিক স্পট’
** দেশের যে শহরে রিকশা নেই!
** খাগড়াছড়ির প্রবারণা উৎসবে…
** 'জিরাফ গলার' ঝুলন্ত সেতুর আকর্ষণও কম নয়
** রেল স্টেশনে বিনামূল্যে বিশুদ্ধ পানি
** রাবার ড্যামে চেঙ্গী নদীপাড়ের কৃষকদের সুদিন
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৬
এসআর/জেডএম