প্রান্তিক লেক (বান্দরবান) ঘুরে: শাপলার ডাঁটায় জেঁকে বসেছে পরগাছা। সেই পরগাছায় ফুটেছে থোকায় থোকায় ফুল।
মাঝে মাঝে রঙিন পদ্ম ঠিক যেন ফুল সভায় মিলিত হয়েছে। চারদিকে বিশাল বিশাল পাহাড় শব্দ দুষণ রোধে অতন্ত্র প্রহরায় নিয়োজিত। সেই পাহাড় সারিকে ভেদ করতে পারেনি যান্ত্রিক শব্দ। নৌকায় ভ্রমণের সময় শুধু বৈঠা বাওয়ার ছলাৎছল আর পাখির কিচিরমিচিরই সুর তুলবে কানে।
সে কারণে নৌকা ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে আকর্ষনীয় স্থান বিবেচিত হচ্ছে প্রান্তিক লেক। নীলাভ স্বচ্ছ জলরাশির চারদিকে নানা জাতের বৃক্ষ। কোথাও পরিকল্পিত ফুল বাগান, এক কোনে মহুয়া, কোথাও শিমুল-পলাশ বন।
কোথাও আবার আপন খেয়ালে গড়ে ওঠা জঙ্গল। যাকে আজও কৃত্রিমতা ছুঁতে পারেনি। কঠোরভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে তার প্রাকৃতিক রূপ। যাকে বলা যায় পরিকল্পিত উপায়ে জঙ্গলায়ন। খানিকটা সুন্দরবনের মতো আবহ। গাছের পাতায় ঢেকে গেছে স্বচ্ছ পানি। তার নিচ দিয়ে রয়েছে নৌকা চলাচলের সুড়ঙ্গ পথ। এ যেনো জলাবনেই নৌকা বাওয়া।
চলতে গেলে বুনো গাছপালার শাখা আপনাকে ঝাপ্টা দিয়ে যাবে। কখনও গা ছমছম করবে, এই বুঝি শাখায় মিশে থাকা বিষাক্ত কোন সাপ ছোবল মেরে আপনার সাধের প্রাণ সাঙ্গ করে দিয়ে যাবে।
সেই সুড়ঙ্গ দিয়েই এগিয়ে চলছিল আমাদের নৌকা। আলোচনা ওঠে এই জঙ্গলে সাপ আছে না-কি! মাঝি লিটন মিয়া বললেন, জি স্যার। সহযাত্রী একজন আলোচনায় অংশ নিয়ে বললেন, চারদিকে গহীন বন, কোথাও কোথাও এখনও মানবের পদচিহ্ন পড়েনি। সে রকম একটি জায়গায় সাপ না থাকলেই অবাক হওয়া উচিত।
এ কথা শুনতেই সফরসঙ্গী দেলোয়ার হোসেন বাদল ভয়ে গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলেন। এতোক্ষণ যে দরাজ গলায় গান গাইছিলেন, সেই গলা যেন মুহূর্তেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।
মাঝির উদ্দেশ্যে বললেন এই, এই গাছের ডাল গায়ে লাগছে তো। আর সামনে যাওয়ার দরকার নেই, নৌকা ঘুরাও। অন্যরা মুখে না বললেও সাপের ভয় যে খানিকটা ভীত তা বুঝা গেলে সমস্বরে ফেরার প্রস্তাবে সায় দেওয়ায়।
যথারীতি বনের ভেতর থেকে নৌকা এসে পড়ল বিশাল লেকে। লেকের পাড়ে বড়শি ফেলেছে দু’টি গ্রুপ। মাছ পাওয়া যায় নাকি জানতে চাওয়া হলে মাঝি জানালেন, স্যার এখানে সারাদিনে একটি মাছ পেলেই যথেষ্ট। একেকটি রুই মাছের ওজন পনের বিশ কেজির মতো। অন্যান্য মাছও রয়েছে।
এ কথা কেউই বিশ্বাস করতে চাইছিল না। তখন মাঝি হাত উঁচিয়ে বললেন, ওই যে দেখছেন ছোট্ট ঘরটি। ওইটা ছিল হাঁসের খামার। কিন্তু এই লেকের মাছের পেটে গেছে হাঁসগুলো। লেকে হাঁস নামলে আস্ত গিলে ফেলত।
মাঝির কথার সঙ্গে একমত বান্দরবানের এনডিসি হোসাইন মুহাম্মদ আল-মুজাহিদ। তিনি বাংলানিউজকে জানান, বেশিদিন নয়, বছর খানেক আগে হাঁসের খামার করা হয়েছিল। সব সাবাড় হয়ে গেছে। ধারণা করা হয়, লেকের মাছই হাঁসগুলো খেয়ে ফেলেছে। তবে এখানে অজগর থাকাও বিচিত্র নয়।
মাঝি জানালেন, স্যার কখনও লেকটি শুকায়নি। শুকনো মৌসুমেও পানির গভীরতা থাকে ৫০ ফুটের উপরে। তারপর অনেকেই সায় দিলেন তাহলে এমন সাইজের মাছ থাকতে পারে।
লেকটিতে বৈঠা চালিয়ে নৌকা ভ্রমণ যেমন উপভোগ্য, তেমনি মনের সুখে মাছ শিকার করা যায়। নৌকা ভ্রমণ বর্তমানে পুরোপুরি ফ্রি। তবে মাছ শিকারের জন্য গুণতে হবে দুই হাজার টাকা (সারাদিন তিনটি হুইল)।
নীরবতারও যে বিশেষ ভাষা রয়েছে তা প্রান্তিক লেকে না গেলে আন্দাজ করা কঠিন। এখানে গেলে আপনি পাবেন হিরন্ময় নীরবতায় ছোঁয়া। যান্ত্রিক শব্দ এখনো আসেনি লেকটিতে। আসার সম্ভাবনাও কম। কারণ এর অবস্থান প্রধান সড়ক থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে।
বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের পাশে হলুদিয়া নামক স্থানে অবস্থিত এই প্রান্তিক লেক। বান্দরবান আর সাতকানিয়া সীমান্তে বলেই এর নামের সঙ্গে প্রান্তিক বিশেষণ। মূল অংশ বান্দরবানে হলেও লেকটির কিছু অংশ তো চট্টগ্রামের সাতকানিয়াতেও পড়েছে। পশ্চিমের পাহাড়গুলো ওই সাতকানিয়াতেই। শহর থেকে এর দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। জলাভূমির আয়তন ২৫ একর। এতোদিন অনাদরে থাকলেও বান্দরবান জেলা প্রশাসন একে পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়তে উদ্যোগী হয়েছে।
জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক জানিয়েছেন, এটিকে আমরা মনের মাধুরি দিয়ে সাজাতে চাই। আশা করছি এক সময় বান্দরবানের এক নম্বর পর্যটন স্পট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে প্রান্তিক লেক। আমাদের নতুন প্রজন্ম দেশীয় বৃক্ষরাজির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে এখানে এলে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৬
এসআই/জেডএম
আরও পড়ুন
** নীলাচলে বিকৃত মস্তিকের আঁচড়