বেতাগা ঘুরে (বাগেরহাট থেকে): ইউনিয়নের পিচঢালা পাকা রাস্তা দিয়ে ঢুকতেই পথ নির্দেশক সহযাত্রী বলতে থাকলেন, এই সেই বেতাগা। তারপর আর কিছু তার বলতে হলো না।
কেবল প্রবেশপথ নয়, ২৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের পুরো ইউনিয়নজুড়েই এমন শতভাগ বৃক্ষশোভিত সড়ক। সড়ককে শতভাগ বৃক্ষে শোভিত করাই শুধু অর্জন নয়, সাড়ে ১৫ হাজার মানুষের এ ইউনিয়ন পরিষদে সামাজিক বনায়ন, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, শতভাগ হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়, প্রতি ৮ পরিবারের জন্য একটি করে গভীর নলকূপ, ইউনিয়নজুড়ে নিরাপদ পানি সরবরাহ, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অনুশীলন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রার (এমডিজি) প্রায় সব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে যাত্রা এই বেতাগাকে পরিণত করেছে এক টুকরো ‘সোনার বাংলা’য়।
খুলনা-মংলা মহাসড়কের শুকদাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে ডানপাশে ঢুকতেই ‘ছবি মতোন ইউনিয়ন’ বেতাগা। অথচ যুগ-দেড়যুগ আগেও এখানকার অশিক্ষা-কুশিক্ষা এবং সেকেলে কৃষিতে পিছিয়ে ছিল বেতাগাবাসী। লিপ্ত ছিল সাম্প্রদায়িকতা আর হানাহানিতে।
কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বেতাগার বাসিন্দাদের সদিচ্ছা ও কর্ম এই এটিকে সারাদেশের ‘মডেল’ হিসেবে জায়গা করে দিয়েছে।
মাসকাটা, ধনপোতা, চাকুলী, বেতাগা, নিকলেপুর, চাঁদেরচোন, তালবাড়ী, ষাটতলা, কুমারখালী, বিঘাই, ষাটতলা আদর্শগ্রাম ও কুমারখালী গুচ্ছগ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা এই ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেলো, সবুজ গাছে গাছে যেমন সুশোভিত করা হয়েছে বেতাগাকে, তেমনি এখানটার চাষবাসেও অনুসরণ হচ্ছে প্রকৃতি ও মাটিবান্ধব পদ্ধতি।
ইউনিয়নের প্রায় ৫০-৬০ একর জায়গাজুড়ে অর্গানিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফলমূল চাষ হচ্ছে। কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের বদলে কেবল গোবর, খৈল কচুরিপানাসহ জৈবসারের ব্যবহারের কারণে বেতাগার এ প্রকল্পের নাম ‘অর্গানিক বেতাগা’। নিরাপদ সবজি উৎপাদনে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠা এই ‘অর্গানিক পল্লী’তে উৎপাদিত হচ্ছে টমেটো, ঝিঙ্গা, শসা, আনাচ, আল, বাঁধাকপি, পুঁইশাকসহ হরেক সবজি।
মাসকাটা গ্রামে কয়েক একর জায়গাজুড়ে সবজি উৎপাদন হচ্ছে। ঘুরে ঘুরে গ্রাম দেখার সময়ই খেয়াল করছিলেন ওই চাষের জমির কৃষাণ-কৃষাণিরা। এগিয়ে যেতেই সামনে এলেন সত্তরোর্ধ্ব দুই ভাই মোহাম্মদ মোশাররফ ও ফিরোজ শেখ। সবজি ক্ষেত থেকে অনিষ্ঠকারী পাখি তাড়ানোর জন্য তার ওপর দড়ি টেনে বেঁধে দিয়েছেন কয়েকটি প্লাস্টিকের বোতল। এই বোতলে আবার রয়েছে ছোট ইট বা পাথরের খণ্ড। একদিক ধরে টান দিলেই পুরো দড়িতে থাকা বোতলগুলো বেজে ওঠে। পাখির দল ভয়ে পেয়ে উড়ে যায়।
একবার দড়ি টান দিয়েই ফিরোজ শেখ বলেন তাদের চাষবাসের কথা। জানান, বেতাগায় এ অর্গানিক চাষে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা কৃষি অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট কার্যালয়গুলো। জৈব সার থেকে শুরু করে অনিষ্টকারী পোকামাকড় ধ্বংসে এবং বালাই নির্মূলে টিএসপি দিয়ে থাকে কৃষি অধিদফতর।
এখানে নিরাপদে চাষ হয় বলে এসব তরি-তরকারি বাজারে অন্য সবজিগুলোর চেয়ে দাম সামান্য বেশি রাখা হয়। বেতাগার অর্গানিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি বেচতে কর্তৃপক্ষ আলাদা বাজারও গড়ে দিয়েছে।
ফিরোজ শেখের ভাই মো. মোশাররফ জানান, মাসকাটা ও পার্শবর্তী গ্রামে তারা প্রায় ৩০০ পরিবার এই অর্গানিক চাষবাসে রয়েছেন। ধানের মৌসুমে তারা ধান করেন। এরপর তারা ব্যস্ত থাকেন নিরাপদ সবজি চাষবাসে।
মাসকাটা থেকে শ্যামবাগাতের দিকে বেরোতে রাস্তার ডান দিকে দেখা গেলো ১ বিঘার মতো জায়গাজুড়ে অর্গানিক পদ্ধতিতে সবজি-ফলমূল উৎপাদন হচ্ছে। এই জায়গাটা খোদ ইউপি চেয়ারম্যানের। তিনিই অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষবাসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার এ ক্ষেতে চাষ হচ্ছে শসা, কূল, নারিকেল, মাল্টা, লেবু, লিচু, ভুট্টা, হলুদ ও বেগুন।
বেতাগার মাঠে-ক্ষেতে সমানভাবে কাজ করতে দেখা গেলো নারীদেরও। কৃষকেরাই বললেন, বেতাগাকে ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করতে সমানভাবে অবদান রাখছে নারীরাও।
** রিয়েলাইজেশন অব ডিজিটালাইজেশন
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৬
এইচএ/এএ/