ঢাকা: এই বাবু ব্যাগটা নিতে পারবি? হাতের লাঠিটা ফেলে সঙ্গে সঙ্গে ১২-১৩ বছর বয়সী শিশুটি বলে উঠলো, ‘হ আপা, কোন কাউন্টারে যাইবেন?
উত্তর পাওয়ার আশা না করেই ভারী ব্যাগটা মাথায় নিয়ে চলতে থাকলো সামনে। ওর চলা দেখে মনে হচ্ছিল ওকে কেউ রুখতে পারবে না।
কমলাপুর রেল স্টেশনে দেখা হলো স্টেশন দাপিয়ে বেড়ানো এই ছিন্নমূল শিশুটির সঙ্গে। নাম বাবু, যে কিনা বুঝে্ ওঠার আগেই কাঁধে নিয়েছে জীবনের বোঝা। ৫-১০ টাকার আশায় প্রতিদিনই যাত্রীদের ভারী বোঝা কাঁধে নিতে হয় তাদের।
অপেক্ষা ছিল চিত্রা এক্সপ্রেসের জন্য। সন্ধ্যা ৭টার ট্রেন। অথচ স্টেশনে ট্রেন এসে পৌঁছুলো রাত ৮টায়। ট্রেনের অপেক্ষা করতে করতে গল্প হচ্ছিল বাবুর সঙ্গে। বলছিল তার ব্যস্ত জীবনের কথা। ‘সকালে উঠি। সেন্টার থাইকা কয়ডা খাই। তারপর বারায়ে (বেরিয়ে) পড়ি। স্টেশনে আসি। তারপর যহন যারে পাই তারই বোঝা উবাই (বহন করা)।
পড়াশোনা? ‘সেন্টার থাইকাই পড়ায়। তয় রাইতে পড়ায় তো, সারাদিন কাম কাজের পর পড়াশোনা ভালো ঠেকে না। ’
তাইলে এখানে কষ্ট করে কেন থাকে জানতে চাইলে তার সহজ উত্তর, ‘কই যামু। মার কাছে আছিলাম। মা খালি কামে যাইতে কয়। জোর কইরা এক চাচার দোকানে কামে দিল। দুইদিন না যাইতেই খুন্তি দিয়া আমারে এছাই (এতো) মারন মারলো। পিডে (পিঠে) চাক্কা চাক্কা হইয়া গেলো। ভয়ে পালাইয়া আইলাম। ’
বাবুর বাড়ি দিনাজপুরের রামনগরে। ছয় বছর বয়সে বাবা মো. সবুজ তাদের তিন ভাইবোনের সংসার ছেড়ে আরেক জায়গায় বিয়ে করেন। দিশেহারা মা আন্জু সংসার চালাতে পারছিলেন না। শেষমেষ বাবু আর তার বড় বোন বাবলির কাঁধে চাপে সংসারের ঘানী।
কথা হচ্ছিল বাবুর স্বপ্ন নিয়ে। বড় ব্যবসায়ী হতে চায় সে। তার ভাষায়, ‘টেকা জড়ো করতাছি। মুদি দোকান দিমু। একদিন মেলা কয়ডা (অনেকগুলো) দোকান হইবো আমার। ’ তবে মায়ের কাছে থাকা দুই বছর বয়সী বোনটাকে নিয়েও স্বপ্ন দেখে বাবু। বললো, ‘বোনডারে পড়ামু। ও বড় চাকরি নিব। ’
দুজনের কথপকোথনের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হলো নাজির নামের আরেক ছিন্নমুল। বাবুর ঘাড় চাপরে বললো, ‘একজনের বোঝা লইয়াই রাত পাড় করবি?’ খাইতে যাবি না?
বাবু ঘাড় নেড়ে বললো, ‘আইজকা সেন্টারের খাবার খামু না। প্রতিদিনই এক ডাল সবজি ভাললাগে না। হোটেল থাইকা ১০ টাকার মাছ ভর্তা কিনুম। ভর্তা দিয়া পেট ভইরা ভাত খামু। ’
নাজির বললো, ‘তাইলে চল যাই’। দু’জন গলা জড়াজড়ি করে সামনে হাঁটা দিতেই পাশে এসে দাঁড়ালেন লুঙ্গি পরা এক লোক। উপহাসের সুরে বলতে লাগলেন, ‘ভর্তা ক্যান গরুর ঠ্যাঙ্গ (পা) দিয়া খা। ’ তার কথায় মুখ ভেঙচে দিল বাবু ও নাজির। বললো, ‘তোমার শিখাইয়া দিতে হইবো না’।
হাসতে হাসতে বললো লোকটি, ‘টোকাইদের কপালে ভাত জোটে এইডাই তো মেলা। আবার মাছ ভর্তা!’।
তার কথায় যেন বাবুর চোখে প্রতিবাদের বিস্ফোরণ ঘটলো। রেগে গিয়ে বলতে লাগলো, ‘আমি টোকাই না। কাম করি খাই। ’
হাত দিয়ে শার্টের নিচের অংশটুকু পেঁচাতে পেঁচাতে এসে প্রশ্ন ছুড়লো, ‘আপা আমি কি টোকাই কন? সবাই আমগো টোকাই কইয়া ডাকে’।
বাবু কথার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে স্টেশনে ট্রেন এসে হাজির। সব রাগ ভুলে নিচে রাখা ব্যাগটি ট্রেনের কামরায় পৌঁছে দিয়ে দৌড় দিল বাবু। ১শ’ টাকা পারশ্রমিক পেয়ে কিছুক্ষণ আগের বাবু আবারো স্বাভাবিক হয়ে গেলো। যাওয়ার আগে অবশ্য নির্মল, নিষ্পাপ হাসির রেখা ফুটে উঠলো তার চোখে মুখে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৬
জেডএফ/এসআই