দুবলার চর থেকে: সন্ধ্যার পর থেকে আবদুল কাহহারের দোকানে ভিড় লেগেই থাকে। দিনের বেলায়ও মানুষের আসা-যাওয়া থাকে তবে সন্ধ্যায় একটু বেশি।
ধুম-ধাড়াক্কা গান চলছে। বিটের তালে শরীর স্থির রাখাই দায়। দুর্ধর্ষ অ্যাকশন দৃশ্য- বেধড়ক মারপিট চলছে, হিরো একাই ধোলাই দিচ্ছে কুড়ি-পঁচিশজন গুন্ডাকে। নিবিষ্টমনে দেখতে থাকা চোখগুলো অন্ধকার ঘরে জ্বল জ্বল করে ওঠে।
পরক্ষণেই শাশুড়ি-বউ-ননদ-জায়ের মেলোড্রামাটিক লড়াই, আবেগঘন দৃশ্য। পছন্দকারী গ্রিন সিগন্যাল দিতেই ‘সেন্ড টু’ হয়ে চলে যাচ্ছে ছহিরের মেমরি কার্ডে। ছহির পেশায় জেলে। বাড়ি বরগুনা। বছরের অক্টোবর-ফেব্রুয়ারি এই পাঁচ মাস সুন্দরবনের দুবলার চরে এসে সাগরে মাছ ধরেন জহিরের মতো আরও প্রায় ছয় হাজার তিনশো জেলে। চাঁদের তিথি ও জোয়ার-ভাটার হিসাব করে একদিন-দু’দিন, কখনও সাত-দশ দিনের জন্যও সমুদ্রে চলে যান ট্রলার নিয়ে। সমুদ্রে মাছ ধরার পর অবসর সময় কিংবা চরে ফেরার পর তেমন কোনো কাজ থাকে না তাদের। নেই টিভি-ডিভিডিও। এই সময়গুলো কাটান মোবাইলে গান-সিনেমা-সিরিয়াল দেখে।
বছর দুই আগেও নাকি টিভি ছিলো, মোবাইলের দাপটে তাও উঠে গেছে বলে জানান পাইগাছার জেলে প্রদীপ। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেন, এখন টিভি কেউ দেখে নাকি! (বলেই সিঙারায় কামড় বসান)দু’জন কার্ড লোড নিয়ে উঠে যায়। একটু কাছে গিয়ে বসতেই ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে তাকান কাহহার। জানান, বাংলা সিনেমা খুব একটা চলে না এখানে। আউট ছবি বেশি চলে। আউট ছবি মানে- তামিল, চাইনিজ ও হলিউডি সিনেমা। কিরণমালা, পটলকুমারের মতো সিরিয়ালগুলোরও ব্যাপক চাহিদা। হাইবিটের গানের রয়েছে আলাদা কদর।
বছর বাইশের কাহহার ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর খুলনা গিয়ে নতুন নতুন কালেকশন নিয়ে আসেন। এরপর ভিড় লাগে নতুন ছবি-গান নেওয়ার। দেখা হয়ে যাওয়া সিনেমা ফেলে দিয়ে নতুন সংগ্রহে ভরে ওঠে কার্ড। গোটা মৌসুমজুড়ে ভালোই ইনকাম হয় কাহরারের। রোজ পাঁচ-ছয়শো টাকা পকেটে আসে চোখবুজে। কার্ড লোডের রেটও ঠিক করা। এক মেগাবাইট থেকে দুই গিগাবাইট পর্যন্ত ২০ টাকা, চার গিগাবাইট ৩০ টাকা ও আট গিগাবাইট ৫০ টাকা। যতো গিগাবাইট বেশি ততো টাকা কমতে থাকে। এই হিসেবে চাহিদা অনুযায়ী কার্ড লোড নিয়ে যান দুবলার চরের মৌসুমী বাসিন্দারা। এখানে ‘চাহিদা’ শব্দটি যথেষ্ট তাৎপর্যবহুল। সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের এমনিতেই চিত্তবিনোদন দরকার। এর ওপর ঘরবাড়ি, পরিবার-পরিজন ছেড়ে দিনের পর দিন এখানে পড়ে থাকেন তারা। বৈরি আবহাওয়া, স্বজন কাছে না থাকার বেদনা, জেলে ও চর জীবনের টানাপড়েন, রোজকার লেনাদেনা- সবকিছু ভুলে থাকেন মোবাইল স্ক্রিনের চারকোণা পর্দায় চোখ রেখে। সেখানে তাদের যে সিনেমা বা গান টানবে সেটিই তারা দেখবেন, এটাই স্বাভাবিক।
এর পাশাপাশি রয়েছে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। দেশের সরকারি টেলি-অপারেটর টেলিটকের বাইরে আর কোনো বেসরকারি নেটওয়ার্ক এখানে কাজ করে না। তবে জেলেরা জানান, এখানে ভারতীয় সিমের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এক সহকর্মীর কাছে ভারতীয় সিম ছিলো। তথ্যের সত্যতা মেলে নেটওয়ার্কের দাগ দেখে।
দুবলার চরে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা এগোয় রাতের গন্তব্যে। মেমরি কার্ড হাতে তাগাদা দেন সাগর থেকে ফেরা জেলেরা। কাহহারই বা কী করবেন। একসঙ্গে দু’টি কার্ডে ফাইল ট্রান্সফার হচ্ছে। শেষ হলে পরের জন।
পৌষের তীব্র ঠাণ্ডা। মুখে মাফলার পেঁচিয়ে হাত জ্যাকেটের পকেটে দিয়ে অপেক্ষা বাড়ে রাজন, শফিকুলদের। কখন আসবে তার নম্বর…
আরও পড়ুন...
** একটু-আধটু কুমড়া-মুলায় দুবালার চর
** দুবলার চরের জেলেদের জীবনগাথা
** না দেখলেই নয় হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র!
**এইসব দিনরাত্রি রয়ে যাবে গাবখান-বলেশ্বরের বাঁকে
** বুড়িগঙ্গা-মেঘনা ছুঁয়ে পশুর নদীর ডাকে
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৬
এসএনএস