হাতের বাঁয়ে তিনকোণা দ্বীপ। তার বিপরীতে এই চরটা।
আসলে হরিণে খেয়েছে কেওড়া পাতা। এই কেওড়া পাতাই তো অন্যতম খাবার সুন্দরবনের হরিণের। তাই পেছনের পায়ে ভর করে উপর পানে মুখ তুলে নাগালের মধ্যে পাওয়া পাতা খেয়ে নিয়েছে সুন্দরবনের মায়া কাড়া নিরীহ এই প্রাণী।
গায়ে গায়ে পাতা ছোঁয়া উপরের অংশে তাই দৃষ্টি ঠেকে গেলেও নিচের মাটি থেকে ফুট আটেক ওপর পর্যন্ত বহুদূরে দৃষ্টি চলে। মনে হয়, সরু সরু খুঁটির ওপর যেনো দাঁড়িয়ে আছে ঘণ সবুজ পাতার পাহাড়।
তিনকোণা দ্বীপখালের উপরের মুখটার কাছে আর একটা তিনকোণা ছোট দ্বীপ দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে জলধারাটাকে। এরকম ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৪শ’ নদী-খাল আর শ’ দুই দ্বীপ আছে সুন্দরবনে। হিমালয়ের ভূমিক্ষয়জনিত পলির সঙ্গে জোয়ারে ভাসা বালি, লবণ আর কাদামাটি জমে এসব দ্বীপ মাথা তুলেছে এখানে।
বাঁয়ের ছোট খালটার ওপর প্রান্তে পশুরের মোহনা সহজেই নজরে আসে। ওটাকে পেছনে রেখে ডানের কোর্স ধরে লঞ্চ পড়লো কোকিল মণি নদীতে। হাতের ডানে ফরেস্ট অফিস এলাকায় নির্ভয়ে হরিণ চরছে।
কোকিল মণির মুখে সবুজ শরীর নিয়ে ভরা জোয়ারে পানিতে ভাসছে টিয়ার চর। জয়মনির কাছে পশুর থেকে বেরিয়ে আসা বহুল আলোচিত শ্যালা নদীর মোহনা এটা। ট্যাংকার ডুবির পর পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হলেও ট্যুরিস্ট লঞ্চের সমস্যা নেই শ্যালায়।
কিছুটা জলপথ শ্যালার বুক বেয়ে লঞ্চ ঢুকলো বেতমারি গাঙে। তারপর বাটিঘাটা খাল হয়ে সুন্দরী খালে। এবার পাল্টে গেলো দু’পাশের দৃশ্যপট। ফেলে আসা প্রশস্ত নদী-খালগুলোর পাড়ে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ সঙ্গ দিয়েছে সারি সারি কেওড়া। সঙ্গে ছিলো গরাণ ঝোপ। ফাঁকে ফাঁকে ছিলো গেওয়া আর সুন্দরী। এবার সুন্দরী খালে সুন্দরী গাছের রাজত্ব। তার ফাঁকে ফাঁকে কেওড়া বন।
এতক্ষণ ভরা জোয়ারে ফুলে ওঠা সাগরের পানিতে ডুবে ছিলো পাড়ের গাছগুলোর গোড়া। এখন পানি সরে যাওযায় যুগ যুগ ধরে পলিজমা পাড় বেরিয়ে পড়েছে সুন্দরী খালে। দু’পাড় থেকে খালের ওপরে ঝুঁকে আসা গাছগুলোর নিচে অন্ধকার দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ওই অন্ধকারেই যেনো মাথা নামিয়ে পানিতে মুখ চুবাতে চাইছে সুন্দরীরা। জোয়ারের সময় তাহলে পানির আদরই গায়ে মাখে ওরা।
হিরণ পয়েন্ট ছেড়ে ঘণ্টাখানেক সাগর বাওয়ার পর থেকে নদী-খালে মাঝেমধ্যেই চোখের সামনে উড়ে খেলা দেখাচ্ছিলো ব্লাক ক্যাপ আর হোয়াইট থ্রট কিংফিশার বা মাছরাঙা। জীবনানন্দের কবিতা থেকে বেরিয়ে লঞ্চের মাস্তুলে বসার পাঁয়তারা করছিলো সোনালি ডানার চিলগুলো।
পাড়ের ভেজা বালু আর মরা গাছে বসে লঞ্চটাকে দেখছিলো মদন টাক, হাড়গিলা, ল্যানজা, কাদাখোঁচা আর শিকারি ঈগল। একটা বিলুপ্তপ্রায় বাংলা শকুনও চোখে পড়লো। এখানকার বেশিরভাগ পাখিও তো স্থায়ী বাসিন্দা সুন্দরী গাছ শাসিত সুন্দরবনের।
কিন্তু ১৫ কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা সুন্দরী খালে গোধূলীর ইশারায় সব বুঝি ফিরে গেছে নীড়ে। একটু পরই ঝপ করে আঁধার নামলো সুন্দরী খালে। সরু খালের উপর পাড়ের ঘন গাছপালা আরো জমিয়ে দিলো সে অন্ধকার। সার্চ লাইট বন্ধ করে তবু সেই সরু খালেই অন্ধকারে লঞ্চ চালিয়ে যেতে থাকলেন দু’যুগের দক্ষ নাবিক ইউনূস।
লঞ্চটা যখন নোনা পানির প্রজনন ক্ষেত্র কটকা খালের মোহনায় বেরিয়ে এলো তখন অন্ধকার জেঁকে বসে আড়াল করে দিয়েছে সাগরটাকেও। দু’পাড়ের বাঘের অভয়ারণ্যও লুকিয়ে পড়েছে আঁধারের আড়ালে।
আরও পড়ুন...
** হিরণ পয়েন্টে হৃৎকম্পন
** ঘুম সাগরে জল অভিযান
** চাঁদের সাথেই মাছের প্রেম
** দুবলার সৈকতে মৃতদের মিছিল!
** সাগরের বুকে ভাসমান রাত
** জলে ভাসা রকেট কাহিনী
** দ্বিতীয়ার চাঁদে মেঘনার হাসি
** সুন্দরী ছুঁয়ে পশুরে ভাসে গাঙচিল
বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৬
জেডএম/