তিনি রন্ধনশালার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার পাশাপাশি অন্দরের দুর্গন্ধময়-অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। তবে কি বাঙালি হিসেবে যুগ-যুগ ধরে এক চিরন্তন পুতিগন্ধময় হেঁসেলেরই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি? অন্তত ‘সুশীলন’ সে ভাবনায় কপাল চাপড়ানোর সুযোগ দেয় না।
সরকারঘোষিত পর্যটন বর্ষে দেশের শীর্ষ অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের ‘বছরজুড়ে দেশ ঘুরে’ কর্মসূচির শেষ পর্ব ‘সুন্দরবনে পর্যটন’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনায় অংশ নিতে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সুশীলন’ এর টাইগার পয়েন্ট গেস্ট হাউসে আসা। এর সদরে যেমন সুশীল ও পরিপাটি, অন্দরেও তেমনি পরিচ্ছন্ন। সকাল-দুপুর-রাত, প্রতিবেলার মুখরোচক খাবারেই ভিন্ন স্বাদ ও উপস্থাপনা। আথিতেয়তায়ও অনন্য এই সুশীলন।
এখন পৌষের প্রথমভাগ। মনে পড়ে যায় শৈশবের সেই কবিতাখানি, ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি, খুশিতে বিষম খেয়ে/আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে, মায়ের বকুনি পেয়ে। ’ পৌষের কোনো আতিথেয়তাই পূর্ণ হতে পারে না পিঠা ছাড়া। সমঝদার ‘সুশীলন’ তা ভালোই বোঝে, তাইতো শীতের সন্ধ্যায় সুশীলনে বাকি ছিল না পিঠার আয়োজনও। শুধু কি তাই? একেবারে ঢেঁকি ঘরের পাশে বসেই পিঠা খাওয়ার আয়োজন হয়।
পিঠা বানাতে সকাল থেকেই ছিল গেস্ট হাউসের ডান পাশের সেই ঢেঁকি ঘরে চিরচেনা ধুপধাপ ছন্দময় শব্দ- যা আমাদের নিয়ে যায় চিরন্তন গ্রামীণ-বাংলায়। পিঠা বানানোর জন্য ঢেঁকি দিয়ে চাল গুড়ো করে রাখা হয়। সেই গুড়ো দিয়েই বিকেল থেকে পিঠা বানানোর ধুম। সুশীলনের এ পিঠা উদ্যোগের সঙ্গে অনেক সহকর্মীও জড়িয়ে পড়লেন। এ যেন আথিতেয়তার এক ব্যতিক্রমী মেলবন্ধন। সুশীলনের দক্ষ পিঠা কর্মীরা বেশ দ্রুততার সঙ্গেই তৈরি করে ফেললেন পুলি পিঠা, আন্দুসা পিঠা, চিতই পিঠা, ছিট রুটিসহ কয়েক ধরনের পিঠা। সেইসঙ্গে জিভে জল এনে দেওয়া ঝোল-মাংস ও হরেক রকম ভর্তা।
বর্তমান সময়ে খাবারের মেনুটা যেমন তাৎপর্য বহন করে, তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব বহন করে সেই মেনুর পরিবেশনা। পরিবেশ ও অনুষ্ঠানভেদে খাবার পরিবেশনের ভিন্নতাও এখন রুচির অংশ, বলা যেতে পারে শিল্পও। আধুনিক রন্ধন শিল্পের অপিহার্য অংশ হচ্ছে এই পরিবেশনা।
গেস্ট হাউসের মূল ভবনের পাশে সেই ঢেঁকি ঘর লাগোয়া ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘর, এটা মূলত আড্ডখানা। পাটিতে বসে আড্ডা-গান আর খাওয়া-দাওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। এখানেই আয়োজন হয় সেসব মুখরোচক পিঠা পরিবেশনের। এই আয়োজন আরও ভিন্নতা লাভ করেছে মূল ভবন থেকে সেই কুঁড়ে ঘরে যাওয়ার পথটিকে প্রদীপ প্রদীপে সাজানোয়। আলো-আঁধারির পথ পেরিয়ে কুঁড়ে ঘরে ঢুকলেই সবার হাতে তুলে দেওয়া হয় পিঠাপুলি। এই আনন্দোৎসবে যোগ দেন বাংলানিউজের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ঢাকা ও খুলনা থেকে আসা অতিথিরাও।
সবাই মিলে উপভোগ করলাম পৌষের প্রথম পিঠা উৎসব। এমন একটি পিঠা উৎসবের মূল আয়োজক সুশীলনের নির্বাহী প্রধান মোস্তফা নূরুজ্জামান। পিঠা উৎসবের পর শুরু হলো আড্ডা-গান-কবিতা-কৌতুক ইত্যাদি। সুশীলন প্রধান এখানেও অনন্য। তিনি রবীন্দ্রনাথের এক অনবদ্য কবিতা ‘শিশুতীর্থ’ আবৃত্তি করে শোনান। সবাইকে মুগ্ধতায় ভাসিয়ে এসময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’র কিছু অংশ শোনান বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. অপরূপ চৌধুরীও।
বঙ্গোপসাগর আর সুন্দরবনের আশীর্বাদপুষ্ট সাতক্ষীরা। নদী আর বন তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। পর্যটক সুশীলনে আসবে, সুন্দরবন দেখবে আর নদী-সাগরের তাজা মাছ খাবে না, তা কি হয়? সেজন্য আতিথেয়তার ষোলকলা পূর্ণ করতে রাতের খাবারে যোগ হলো সমুদ্রের তাজা মাছ রান্না, ভাজি-ভর্তা আর অন্যান্য দেশীয় রসনাবিলাসী খাবার।
রশিদ বাবুর্চির হাতের ছোঁয়ায় সব খাবারে অমৃতযোগ হয় যেন। সঙ্গে আন্তরিকতা ছিল তার দুই সহযোগী সালমা ও মাজেদার। সুশীলনের রান্না ঘরের প্রধান রশিদের বয়স ৩৫। সুশীলনে রশিদ প্রায় ১৫ বছর ধরে হেঁসেলের হাল ধরে আছেন। লবণের কম-বেশি ছিল না, বাড়াবাড়ি ছিল না হলুদ-মরিচ-মসলারও। সব মিলিয়ে খাবারের স্বাদ ও মান ধরে রাখতে রশিদ যেন আপোসহীন মাস্টার শেফ।
রাতের খাবারের পরিবেশনা পিঠা উৎসবের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। শিম ভর্তা, শীতের হরেক পদের সবজি-ভাজি এসময় সবার কাছেই প্রিয়। তাই অন্যান্য আয়োজনের পাশাপাশি এসব পদের ওপরই সবার নজর ছিল বেশি। মাছের মধ্যে স্থানীয় মাছ দাদিনা, কাইন, ট্যাংরা, পায়রা ও পারশে খাওয়া নিয়ে বেশ প্রতিযোগিতা ছিল। সঙ্গে সাতক্ষীরার চিংড়ি সবার থালায় আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। প্রত্যেকটি পদের মাছই ছিল ভিন্ন স্বাদের। সাগরের তাজা মাছ, রশিদ বাবুচির্র রান্না আর সুশীলনের আন্তরিকতায় স্বাদে ও তৃপ্তিতে হয়ে ওঠে অনন্য।
রাতের খাবার বলি আর পিঠা-পুলি বলি সবই তো হলো। তবে আর কী? আছে বৈকি। ওই যে প্রথমেই আওয়াজ তুলেছিলাম রান্না ঘর নিয়ে। সুশীলনের খাবার যতোই স্বাদে পরিপূর্ণ হোক, বিশ্বাস ছিলো- রান্না ঘরে গেলে খুঁজে পাবো সেই চিরন্তন অপরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধময় পরিবেশ। কিন্তু তারপরও হেঁসেলে গিয়ে ভাঙলো সেই ভুল। মনে হলো, একি? ভেতরে যেতে কেউ তো কোনো বাধাও দিচ্ছে না, আবার কোনো অজুহাতও দিচ্ছে না। তবে কি রান্না ঘর নেই। না অন্য কোথাও থেকে রান্না করে আনে? একটু এগিয়ে যেতেই সে ভুল ভাঙলো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও রুচিশীল এক রন্ধনশালা।
বাজারের জিনিসপত্রগুলো আলাদাভাবে রাখার জন্য ব্যবস্থা আছে। আছে রশিদ বাবুর্চির গায়ে শেফের পোশাক। রান্নার পর খাবারগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে। নোংরা-ময়লার কোনো বালাই নেই। অবশেষে রন্ধনশিল্প, রন্ধনশালা ও আতিথেয়তার এক নতুন পরিচয় মিললো সুশীলনে। সুশীলনে ‘সুন্দরের এই অনুশীলন’ অব্যাহত থাকুক।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬
এইচএ/