সুন্দরবন ঘুরে: শীতের সকাল। তখনও কুয়াশা কাটেনি।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়ি গোয়ালিনী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা খোলপাটুয়া নদীর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এটি। এর মাত্র ১০ মিনিট আগে নীলডুমুর খেয়াঘাট থেকে ট্রলার ছেড়েছে। নৌকা আকৃতির ট্রলারটি ভটভট শব্দ করে ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে খোলপাটুয়া নদীর উপর দিয়ে। উদ্দেশ্য, দোবেকি ফরেস্ট অফিস থেকে সুন্দরবন দেখা। তবে দু’পাশে বনের সবুজারণ্য আর পানিতে সূর্যের নাচ দেখে ক্রমশ সে উদ্দেশ্য গুরুত্ব হারাচ্ছিল।
খোলপাটুয়া নদীর উপর দিয়ে এগিয়ে চলছিল ট্রলার। এর মধ্যে ট্রলারচালক আব্দুল হালিম দেখিয়ে দিচ্ছিলেন নদীর দু’পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো। খোলপাটুয়া নদী থেকে দোবেকির দিকে যেতে ডান দিকের অংশে শুরুতেই ছোট কেয়াখালী খাল। সরু গলির মতো দেখতে হলেও খালটিতে রয়েছে বিপদের হাতছানি। তাই খালের শুরুতেই বড় সাইন বোর্ডে লেখা, সাবধান। আইলার সময় এ খালে বেশ কয়েকজনকে বাঘের শিকার হতে হয়েছে বলে জানান চালক।
একটু আগ বাড়িয়ে সামনের দিকে গেলেই বড় কেয়াখালী খাল। এ খাল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে এখানেও সাবধানী সংকেত। তবে খালটি ছোট কেয়াখালী খালের চেয়ে বেশ মোটা। এরপর এক এক করে ট্রলারটি পার হলো গারাদ্বরা, ফুলখালি, আম্মাদখালী খাল। অবশ্য এর মধ্যে কুয়াশাভেদ করে আকাশের দুয়ার খুলে বেরিয়ে এসেছে সূর্য। তার আলোয় যেনো বন আর নদীর রূপ আরও ঝলকানি দিচ্ছে।
হঠাৎ চোখে পড়লো নদীর মাঝখান দিয়ে যেনো পেন্সিলের লাইন এঁকে দিয়ে গেছে কেউ। লাইনের এপাশে খোলপাটুয়া নদীর সবুজ অংশ, অন্যপাশে মেটে রঙের ঘোলাটে ও একটু অশান্ত পানি। বোঝা গেলো, বিধাতা কতোটা সূক্ষ্মভাবে প্রকৃতিতে সৌন্দর্য দান করেছেন। এ সৃষ্টি দেখে বহু অদেখা সৌন্দর্য দেখার সাধ মিটে গেলো এক মুহূর্তেই।
এবার শুরু হলো কলাগাছিয়া নদী। নদীর পাশ দিয়ে সুন্দরবনের আরেক অংশ। যেখানে সুন্দরবনের ভেতরটা দেখাতে পর্যটকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে আরেকটি চমক। কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম। ট্রলার থেকে দেখা গেলো, নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে কী যেনো চিবোচ্ছে কয়েকটি বানর। এরপর দেখা গেলো মহাসড়কের মতো সোজা বয়ে গেছে ভুরখালি খাল। একটু সামনে এগোতেই ধানগোড়া, এরপর ছোট কলাগাছিয়া খাল। এ খালের খুব কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়লো সুন্দরবনের সৌন্দর্য। এরপর তেলাকাটা দুনে, রুপাখালি, সোনাখালি খাল। ছোট নদীর আকারে খালগুলো কলাগাছিয়া নদীর শাখা-প্রশাখা হয়ে ছড়িয়ে গেছে সুন্দরবনের চারপাশে। একসময় এগুলো গিয়ে ঠেকেছে শ্যামনগরের বিভিন্ন গ্রামের সঙ্গে।
ফেরার আবারও মুগ্ধ করলো সেই পানির বর্ডার। এবার অবশ্য মেটে রঙের পানির সঙ্গে মিশেছে গাঢ় সবুজ রঙের বর্ডার। দেখে মনে হচ্ছে, কোনো যন্ত্র দিয়ে ভাগ করে একসঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে দুই রঙের পানি। নিজের চোখে না দেখলে অবশ্য বিশ্বাস করানো খানিকটা মুশকিল হবে। হওয়ারই কথা। নদীর সঙ্গে নদীর এ সূক্ষ্ম মিলনমেলা প্রকৃতির আরেকটি নিদর্শন। ট্রলারচালক হালিমের বর্ণনা অনুযায়ী, কলাগাছিয়া নদীর সঙ্গে মিশেছে মালঞ্চ নদী।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী এটি। ৭৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৯১৯ মিটারের গড় প্রস্থের এ নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। দেখতে দেখতে মালঞ্চ নদীও পার হয়ে গেলাম।
জোড়া বয়েশিং খাল পেরিয়ে এ নদী জোড়া লেগেছে দোবেকি নদীর সঙ্গে। ‘এ নদী খান পার হলিই সাগর। সেখানে যাইয়ে আমরা মাছ ধরে নি আসি। বুঝতি পারিতিছেন?’
ফরেস্ট অফিসের ঠিক উল্টো দিকটা অর্থাৎ মালঞ্চ নদীর মাঝখান দিয়ে দেখলে পূর্ব দিকের অংশটায় বঙ্গোপসাগর। নিজের চেনা জায়গাগুলো দেখিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হতেই এমন প্রশ্ন করলেন হালিম।
এরও প্রায় মিনিট পর হালিম দেখিয়ে দিলেন দোবেকি ফরেস্ট অফিস। সেখানে চারতলা সমান উঁচু করে বানানো সিঁড়ির চূড়া থেকে দেখা গেলো এক টুকরো সুন্দরবন। যা গেওয়া, কেওড়া, গড়ান, গোলপাতা, সুন্দরীসহ নানা গাছের সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে। এ এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। ফরেস্ট অফিসে ঘোরাঘুরির কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা হলো ট্রলার। এবার হালিম হাত উচিয়ে দেখিয়ে দিতে লাগলেন মালঞ্চ নদীর ডান পাশের অংশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ডাকাতির খাল। জানালেন, আমরা শুনিছি, আগে এই খালে সব থেকে বেশি ডাকাত পড়তো। তার জন্যি এর নাম দেছে ডাকাতির খাল। ’
এরপরের পরের খালটির নাম বাদুর ঝোলা। এ খাল পেরিয়ে ছোট আকারের আরেকটি খালের সঙ্গে লাগানো বনে দেখা গেলো হরিণের মাথা। অবশ্য ট্রলারের শব্দ শুনে ভোঁ দৌড়ে বনের ভেতরে ঢুকে গেলো। পায়ের শব্দে বোঝা গেলো, ঝাঁক ধরে খাবার খাচ্ছে সুন্দরবনের এই মায়াবীনিরা।
হালিম জানালেন, এ খালের নাম লেবু বুনিয়া। প্রকৃতি ছেড়ে লোকালয়ে ফিরে চলছিল ট্রলার। বিষণ্ন মনের ভাবনাগুলোকে তখন এলোমেলো করে দিচ্ছিল বার বার। মনে হচ্ছিল কী যেনো রেখে যাচ্ছি এখানে। তবে নয়ন ভরে নিয়ে যাচ্ছি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। যা না দেখলে হয়তো জীবনের অনেক অপূর্ণতা রয়ে যেতো।
ভাবতে ভাবতে কলাগাছিয়া নদী পার হয়ে খোলপাটুয়া নদীর উপর কখন যে ট্রলারটি নীল ডুমুরে এসে ভিড়লো টেরই পাইনি। সেখানে দেখা গেলো, প্রায় শ’খানেক ট্রলার ভিড়ে রয়েছে ঘাটে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগতরা নদী-বন-সূর্যের সেই সে অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে ছুটছেন ট্রলারে করে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসযোগে মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে অটোযোগে শ্যামনগর উপজেলা হয়ে বুড়ি গোয়ালিনী পরন্ত যেতে হবে। এরপর আসতে হবে নীলডুমুর খেয়াঘাট। ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকে অসংখ্য ট্রলার। মাত্র দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকায় এসব ট্রলারে করে ঘুরতে ঘুরতে উপভোগ করা যাবে বিধাতার অপরূপ সৃষ্টিগুলো। সুন্দরবনকে আরও কাছ থেকে দেখতে চাইলে ফরেস্ট অফিস থেকে পাস নিয়ে নৌকা অথবা ট্রলারযোগে সুন্দরবনে যাওয়া করা যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬
জেডএফ/এসএনএস