তাদের আদর-স্নেহে মাচাজুড়ে শিমের বান ডেকেছে। কলাগাছও বেড়ে উঠছে হাত-পা ছড়িয়ে।
শামসুলদের খড়ের চালা উঠেছে সাতক্ষীরার তালা ব্রিজের গোড়ায়। নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে ‘দুগ্ধস্রোতরূপি‘ কপোতাক্ষ নদ। তাদের মতো অনেকেই খড়-টিনে ঘর তুলেছেন কপোতাক্ষ পাড়ে। পাড়জুড়ে তাদের তেল, নুন, মাটির কলসির সংসার।
তালা উপজেলার উত্তরে যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলা ও সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া। পূর্বে পড়েছে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলা, দক্ষিণে খুলনার পাইকগাছা ও সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলা এবং পশ্চিমে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা।
যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলায় ভৈরব নদী থেকে এ নদ উৎপত্তি হয়ে, সাগরদাঁড়ি ঘুরে তালাকে আলিঙ্গন করে খুলনা জেলার কয়রায় খোলপটুয়া নদীতে গিয়ে পতিত হয়েছে। খোলপাটুয়া নদী আবার সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।
সাতক্ষীরা সদর থেকে তালার পথে যেতে কপোতাক্ষের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় পাটকেল ঘাটায়। পৌষের সকালে সূয্যিমামা কেবলি আড়মোড়া ভাঙছেন। কুয়াশার চাদরের ফাঁক দিয়ে পাখির পালকের মতো নরম রোদ আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে নদের জল।
ততোক্ষণে জেগে উঠেছে নদপাড়ের ক্ষণস্থায়ী বেদে পল্লী। তাঁবুর সামনে শাল-চাদর-সোয়েটার জড়িয়ে আগুনের ওম নিচ্ছে পাঁচ থেকে পঞ্চাশ। গৃহকর্ত্রীর চুলায় হাঁড়ি উঠে গেছে। তাদের সঙ্গে জেগে উঠছে সকাল।
কপোতাক্ষ নদের জলস্পর্শে ধন্য হয়েছে তিন মনীষী- মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিজ্ঞানী-দার্শনিক-কবি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (পিসি রায়) ও কবি সিকান্দার আবু জাফর।
কপোতাক্ষ তীরে শৈশব কাটানো মাইকেল মধুসূদন তখন ফ্রান্সে। সেখানে বসেই স্মরণ করেন কপোতাক্ষ নদকে। লেখেন কালজয়ী সনেট ‘কপোতাক্ষ নদ’। ১৮০ কিলোমিটার (১১০ মাইল) দৈর্ঘ্য ও ১৫০ মিটার (৪৯০ ফুট) গড় প্রস্থের এ নদকে নিয়ে কবি লেখেন, ‘বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে/
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে/
দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে’। সত্যিই তাই। প্রায় ৮শ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে পরম স্নেহ বিলিয়ে চলেছে কপোতাক্ষ নদ।
কপোতাক্ষ পাড়ে বসে কবিতা লিখেছেন সিকান্দার আবু জাফরও। অন্যদিকে, প্রফুল্ল রায় জন্মেছিলেন কপোতাক্ষ ছোঁয়া খুলনা জেলার পাইকগাছার পাড়ুলি গ্রামে। স্মৃতি তারও যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
মাইকেল লিখেছিলেন কপোতাক্ষের কলকল ধ্বনির কথা। এরপর বয়ে গেছে বহু জল, স্রোতধারা। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দা বকুল পালের ভাষ্যে, কপোতাক্ষ এখন বয়ে চলেছে ‘মিনমিন’ (মন্থন) গতিতে। জোয়ার-ভাটা আগের মতো নেই বললেই চলে। বছর দুই আগে নদ খনন করে স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা করার ব্যবস্থা নেওয়া হলেও, এখন আর কোনো পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ তার। গড় গভীরতাও নেমে এসেছে ১১.৫ থেকে ১৬.৪ ফুটে।
দূর থেকে পাড়ে বাঁধা নৌকা নজরে আসে। পেছনে কলাগাছঘেরা বাড়ি। উদয়-অস্ত কপোতাক্ষ পাড়েই তাদের গৃহস্থালি। পাড়ঘেঁষা সারি সারি গাছ, গ্রাম, জীবনের গল্প পেছনে রেখে আসি। সতত, হে নদ তুমি পড়বে মোর মনে। সতত তোমার কথা ভাববো এ বিরলে!
আরও পড়ুন
** রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ডেরায় পাঁচ ঘণ্টা
** সুন্দরের শীলন- সুশীলন
** বাঘের খোঁজে কটকার টাইগার পয়েন্ট
** সুশীলনের ব্যাঘ্রতট থেকে সুন্দরবনের হাতছানি
** সিরিয়াল-তামিল-চাইনিজ ছবির দখলে দুবলার চর
** একটু-আধটু কুমড়া-মুলায় দুবালার চর
** দুবলার চরের জেলেদের জীবনগাথা
** না দেখলেই নয় হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র!
**এইসব দিনরাত্রি রয়ে যাবে গাবখান-বলেশ্বরের বাঁকে
** বুড়িগঙ্গা-মেঘনা ছুঁয়ে পশুর নদীর ডাকে
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬
এসএনএস/এটি