অথচ এ নদীরই উজানে ধুমঘাটে রাজধানী গড়েছিলেন যশোরের মহারাজা প্রতাপাদিত্য। এর পশ্চিম তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছিলো ঐতিহাসিক জনপদ ঈশ্বরীপুর।
অথচ এখন ভেলা ভাসানোও কঠিন হয়ে উঠেছে কদমতলীতে। তার তীরের ঈশ্বরীপুর সাপের মতো খোলস পাল্টে ভুলতে শুরু করেছে ঐতিহ্য আর ইতিহাস। খোল-নলছে পাল্টে গেছে টেঙ্গা মসজিদের। পরিত্যক্ত হাম্মামে ইঁদুর-আরশোলার বাস। পড়ো পড়ো ভাবে ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে আছে যশোরেশ্বরীর নাট মন্দির-দেওয়াল।
চণ্ড ভৈরব আর যিশুর গির্জা তো ক্ষয়ে যেতে যেতে একেবারে নেইই হয়ে গেছে। ভগ্নপ্রায় যশোরেশ্বরীর পূর্ব দিকে যেখানটাতে চণ্ড ভৈরবের মন্দির ছিলো সেখানে এখন দোকানঘর। আর কদমতলীর তীরে যেখানে যিশুর গির্জা ছিলো সেখানে চাষ হয় শীতের সবজি। মূলা আর পাতাকপির চারা মাথা তুলছে এখন।
অথচ কয়েক বছর আগেও কেবল দেওয়াল টিকে ছিলো বাংলাদেশের বিস্ময়কর স্থাপত্য চণ্ড ভৈরব মন্দিরের। পুরনো একটি ছবিতে দেখা যায়, ঘুঁটে শুকানো হচ্ছে ভগ্নপ্রায় প্রাচীন দেওয়ালে।
এমন ত্রিভূজ আকৃতির স্থাপনা এই বাংলায় তো আর কোথাও নেইও। প্রাচীন শিবলিঙ্গের কালো পাথরের একচেটিয়ে উপস্থিতিতে এখানকার বাণলিঙ্গই তো কেবল টিকে ছিলো সাদা পাথরের অনন্য উদাহরণ হয়ে।
কিন্তু অনেক আগেই মূর্তি ব্যবসায়ীদের ঝোলায় গেছে শ্বেতপাথরের বাণলিঙ্গ। আর উনিশ শতকের শেষ ভাগে তোলা যিশুর গির্জার যে ছবি পাওয়া গেছে তাতেও ভগ্নদশা প্রায় স্পষ্ট। নগ্ন দেওয়াল-ইটের উপরে আগাছা-পরগাছার সদম্ভ উপস্থিতি দেখা গেছে তাতে।
অথচ চণ্ড ভৈরবের মন্দিরে পাওয়া গিয়েছিলো সেন যুগের নিদর্শনও। মহারাজা লক্ষ্মণ সেনই ওই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বলেও তথ্য-প্রমাণ মিলছিলো। বলা হচ্ছিলো, সেন যুগে চণ্ডভণ্ড নামে যে আর্য জাতিগোষ্ঠীর বাস ছিলো তারাই পূজা-অর্চনা করতো এখানে। প্রতাপাদিত্য যশোরে রাজধানী নির্মাণ করলে চণ্ড মন্দিরটিও সংস্কার করেন। সাড়ে ২৫ ফুট দৈর্ঘ্য ছিলো এর প্রতিটি দেওয়ালের। দেওয়ালের পুরুত্ব ছিলো ২ ফুট ৪ ইঞ্চি।
আর যিশুর গির্জাটি ছিলো বাংলাদেশেল প্রথম খ্রিস্টান গির্জা। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে জেসুইট বা যিশু সম্প্রদায় গঠিত হওয়ার পর ১৫৯৯ সালে ফনসেকা নামে এক খ্রিস্টান পাদ্রি নদীপথে প্রতাপাদিত্যের রাজধানী যশোরে পৌঁছান। তিনি আর এক পাদ্রি ফাদার সোসাকে নিয়ে প্রতাপাদিত্যের দরবার কক্ষ বারোদুয়ারীতে গিয়ে বেরিঙ্গান নামে এক প্রজাতির সুস্বাদু কমলালেবু উপহার দেন।
ওই সময়ই বারোদুয়ারী ভবনের উত্তর-পূর্ব কোণের খ্রিস্টান পল্লীতে গির্জা নির্মাণের প্রস্তান দেন ফাদাররা। প্রতাপাদিত্য তাদের প্রস্তাবে সম্মতি তো দেনই, সদ্য খ্রিস্টান হওয়া হিন্দুদের কর আদায়ের ক্ষমতাও দেন ফাদারকে।
শুরু হয় গির্জা নির্মাণের কাজ। অর্থ সহায়তায় এগিয়ে আসেন প্রতাপ বাহিনীতে কর্মরত পর্তুগিজ সৈন্যরা। সেই বছরেই ডিসেম্বরের মধ্যেই গির্জার নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ইট দিয়ে অল্প সময়েই নির্মিত গির্জাটি ছিলো অপূর্ব কারুকার্যময়। ১৬০০ সালের ১ জানুয়ারি এর উদ্বোধন।
কিন্তু ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন, খ্রিস্টানদের ঈশ্বরীপুর ছেড়ে অন্যত্র গমন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয় যিশুর গির্জা।
চাষাবাদ কালে মাটির নিচে মানুষের অনেক হাড়গোড় উদ্ধার হয়েছে এখান থেকে। পাওয়া গেছে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা অন্তত ৪০টি কবরের ধ্বংসাবশেষ।
তবে সেসবও এখন অতীত। যেনো যিশুর গির্জা আর চণ্ড মন্দিরের অস্তিত্ব এখানে কখনো ছিলোই না।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৬
জেডএম/এএ