স্থানীয় মানুষ এ দুর্গ সম্পর্কে জানা তো দূরে থাক, বাংলানিউজের ‘বছরজুড়ে দেশ ঘুরে- পর্যটনে সুন্দরবন’ টিমকে জায়গামতো চিনে যেতেই যথেষ্ট বেগ পেতে হলো! বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে উত্তর মেলে, ভাই আমরা এই পুরনো বাড়ি সম্পর্কে কিছু জানি না।
রঙচটা লালচে-কালচে ইটের প্রাচীন দুর্গের ভেতরে হাঁটতে লাগলে ইতিহাস পাতা ওল্টায়, রাজা প্রতাপাদিত্যের তৎকালীন রাজধানী ঈশ্বরীপুরের উত্তর দিকে ছিলো সচল প্রবাহের যমুনা নদী।
রাজা প্রথমদিকে পোত নির্মাণকারী কারিগর এনেছিলেন সপ্তগ্রাম থেকে। পরবর্তীতে এই কাজের দায়িত্ব দেন ফ্রেডারিক ডুডলিকে। তিনি জাহাজ নির্মাণ কাজের অধ্যক্ষ ছিলেন। জাহাজঘাটার একটু দূরে তার নামানুসারে একটি গ্রামের নাম হয়েছে দুদলী। ওই গ্রামে জাহাজ নির্মাণের ডক ছিলো।
সেসময় ইউরোপের জাহাজ নির্মাণের প্রধান কাঠ ছিলো ওক। রাজা প্রতাপের কাছাকাছি ছিলো সুন্দরবন, সেখানে প্রচুর সুন্দরী গাছ। জাহাজের তলা ও ডেকের কাঠ হিসেবে সুন্দরী বেশ প্রশংসা পায়।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানা সদর থেকে চার কিলোমিটার উত্তরে এ নৌ দুর্গের অবস্থান। তবে মৌতলা বাজারে না নেমে খানপুর নামাই ভালো। একটু সামনে এগিয়ে পাকা রাস্তার পূর্বপাশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাইনবোর্ড। নৌ দুর্গে যেতে ঢুকতে হবে এদিক দিয়েই। বায়ে ফাউন্ডেশনের দোতলা ভবন রেখে ছোট্ট পুকুরের পাড় ধরে এগোলেই দুর্গ।
এখানেই রাজা প্রতাপাদিত্যের নৌ বাহিনীর জন্য নানা প্রকার নৌকা তৈরি ও মেরামত করা হতো। তখন আজকের দিনের মতো ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছিলো না, ছিলো নানা আকৃতি-প্রকৃতির নৌকা। যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত নৌকাগুলো ছিলো কোনোটি সরু, কোনোটি বৃহদাকার পাল তোলা।
ষোড়শ শতকে নির্মিত এ নৌ দুর্গ কালের সাক্ষী হয়ে এখনও ৪১০ ফুট বাই ২১০ ফুট আয়তন বিশিষ্ট ভাঙা একতলা দালান হয়ে টিকে রয়েছে।
দূর্গের মূল নকশা অনুযায়ী, উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এ নৌ দুর্গটি দৈর্ঘ্যে ১০০ ফুট। মোট ৫টি কক্ষ বিশিষ্ট দুর্গের কক্ষ মাপ হলো- উত্তর দিক থেকে প্রথমটি ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি বাই ১৪ ফুট, দ্বিতীয়টি ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি বাই ১৪ ফুট, তৃতীয়টি ২ ফুট ৬ ইঞ্চি বাই ৯ ফুট ৬ ইঞ্চি। কক্ষের উপর দু’টি ও চতুর্থ কক্ষের উপর একটি গম্বুজ ছিলো। কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও নকশা অনুযায়ী কক্ষগুলো চিনতে অসুবিধা হয় না।
অবয়ব দেখে অনুমান করা যায়, প্রথম কক্ষটি জনসাধারণের জন্য, দ্বিতীয়টি অফিস, তৃতীয়টি মালামাল, চতুর্থটি শয়নকক্ষ ও পঞ্চমটি গোসলখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
কিন্তু দুর্গের অন্দর-বাহিরে এখন বেহাল দশা। কক্ষগুলো বাদুড়-মাকড়সার ডেরা। দেয়ালের ইট খসে খসে যাচ্ছে।
ধ্বংসপ্রায় এ ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি সংস্কারের দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর কাজ শুরু করেছিল ১৯৯৬-৯৭ সালে। কিছু অংশ সংস্কারের পর আর এগোয়নি।
এই নৌ দুর্গের তৈরি জাহাজ-নৌকা নিয়ে একসময় প্রতাপের সঙ্গে মোঘল বাহিনীর সঙ্গে লড়েছেন রাজা প্রতাপাদিত্য। সেসময় এর শান-শওকত সবই ছিলো। সময়ের পরিক্রমায় নৌ দুর্গের অবস্থা এখন ঠিক তার উল্টো। তবে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে এর মূল্য অনেক। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুর্গটি ধ্বংস হতে চলেছে। খুব শিগগিরই যে এর সংস্কার ও সংরক্ষণ প্রয়োজন, এটি বলতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই!
আরও পড়ুন:
** তেঁতুলিয়া গ্রামের সিকান্দার আবু জাফর
** কপোতাক্ষের স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে!
** রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ডেরায় পাঁচ ঘণ্টা
** সুন্দরের শীলন- সুশীলন
** বাঘের খোঁজে কটকার টাইগার পয়েন্ট
** সুশীলনের ব্যাঘ্রতট থেকে সুন্দরবনের হাতছানি
** সিরিয়াল-তামিল-চাইনিজ ছবির দখলে দুবলার চর
** একটু-আধটু কুমড়া-মুলায় দুবালার চর
** দুবলার চরের জেলেদের জীবনগাথা
** না দেখলেই নয় হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র!
**এইসব দিনরাত্রি রয়ে যাবে গাবখান-বলেশ্বরের বাঁকে
** বুড়িগঙ্গা-মেঘনা ছুঁয়ে পশুর নদীর ডাকে
বাংলাদেশ সময়: ০৭০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১৭
এসএনএস/এমজেএফ/এএ