কিন্তু এইখানে দু’টি পড়ো পড়ো ইমারতকেও বলা হচ্ছে সেই মানিক পীরেরই দরগা। এখান থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দূরে এই দেবহাটায়ই বনবিবির বটতলার কবরটাকেও মানিক পীরের মাজার বলা হয়ে থাকে।
পাকা ইমারতগুলো কে কখন নির্মাণ করেন তা ঐতিহাসিকভাবে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। কিন্তু স্থানীয়রা এগুলোকে মানিক পীরের দরগা বলেই মনে করেন। এমনকি বিভিন্ন পালা-পার্বন, মানতে এখনো কেউ কেউ দুধ ঢেলে যান ভাঙ্গা ইটের ফাঁকে।
ভাঙাচোরা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ইমারত ভেঙে এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে পাশের মসজিদের পরিসর। মসজিদ লাগোয়া ইমারতটার পুরনো ইট যেনো দাঁত বের করে ভেংচাচ্ছে। পড়ো পড়ো ছাদ দেওয়ালে বাধাহীন বেড়ে উঠছে উটকো আগাছা। অসহায় ইতিহাসের নীরব কান্নায় যেনো স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ভিজে উঠেছে দেওয়ালের কোনো কোনো স্থান। পাশেরটার অবস্থাও অনেকটা একইরকম হুমকির মুখে। তবুও খিলান দেখে বুঝা যায় এককালে কতোটা নান্দনিক ছিলো ইমারতগুলো। এ এলাকার পুত্রবধূ হয়ে আসা মাছুমা আক্তার মুক্তার কণ্ঠে তাই আবেদন, “ভাই, দেখেন তো সংস্কার করা যায় কি না। এতো সুন্দর ঐতিহ্য চোখের সামনে নষ্ট হচ্ছে!”
এই দেবহাটাতে কিন্তু অনেক জমিদার ছিলেন ব্রিটিশ আমলে। ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের জন্ম এখানেই। থানা সদরেরই মহল্লা টাউন শ্রীপুরে তো একগ্রামেই ১১ জমিদারের বসবাস ছিলো। সেখানকার ইউনিয়ন অফিসের সামনে এখনো ১৮৬৭ সালে মিউনিসিপ্যালিটির ভিত্তি প্রস্তর দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু দেবহাটা আর টাইন শ্রীপুরের ইতিহাস আরো পুরনো। অন্তত মানিক পীরের দরগা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ইমারতগুলো অন্তত কয়েক শতাব্দীর পুরনো তো হবেই। নির্মাণ শৈলীতে তার মুঘল প্রভাব স্পষ্ট। ইটের গাঁথুনি আর কারুকাজেও মুসলিম শাসন আমলের নিদর্শন।
বর্গাকৃতির প্রতিটি ইমারতের প্রতিটি বাহু ১১ ফুট করে লম্বা। উচ্চতা প্রায় ১২ ফুট। সাতক্ষীরা সদরের ভারতীয় সীমান্তবর্তী বৈকারী শাহী মসজিদ এলাকায় নির্মিত হোজরাখানার সঙ্গে এগুলোর দারুণ মিল।
স্থানীয়ভাবে বলা হয়ে থাকে, এক সময় এখানে চুনারুরা থাকতো। ওরাই সমাধি হিসেবে এসব ইমারত নির্মাণ করেন। কিন্তু সুদূর অতীতে চুন তৈরি করে ইমারত গড়ার বাস্তবতা এখানে কষ্টকর কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। বরং মানিক পীর কখনো এখানে এসে বসবাস করলেও করতে পারেন। কিন্তু তিনি কখনো এখানে এসেছেন কি না বা অন্য কোথাও এমন ইমারত গড়েছেন কি না তার নজিরও কোথাও পাওয়া যায় না।
আর যেখানে ইতিহাস থাকে না, সেখানে ডালপালা মেলে গল্প। মিথ বা জনশ্রুতিই সেখানে হয়ে ওঠে ইতিহাসের মজ্জা। এখানে মানিক পীরকে নিয়েও তাই মিথের অন্ত নেই। মাঝিদের কাছে তিনি বিশেষ মান্য দেবতা। নৌকা ভাসানোর সময়ে তারা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে মানিক পীরকে। হিন্দুদের গবাদি পশু অসুখে পড়লে তারা মানিক পীরের উদ্দেশ্যে মুরগি মানত করে। গাভী হলে ২১তম দিনে দরগাহে দুধ দিয়ে তারপর নিজেরা খায়।
তাই মানিক পীর কার্যত পশু সম্পদ রক্ষক দেবতা বলে স্থানীয়ভাবে কল্পিত। সুন্দরবনের লোক বিশ্বাসেও তার ব্যাপক দাপুটে উপস্থিতি। এখনো যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়াতে মানিক পীরের বেজায় খ্যাতি। তাকে নিয়ে অনেক কাব্যও রচিত হয়েছে। যেমন-ফকির মোহাম্মদ রচনা করেছেন মানিক পীরের গীত, মুন্সী মোহাম্মদ গিরিজ উদ্দিন রচনা করেছেন মানিক পীরের কেচ্ছা, জয়রদ্দিন রচনা করেছেন মানিক পীরের জহুরানামা, মানিক পীরের গান রচনা করেছেন নসর শহীদ, বয়নদ্দীন ও খোদা নেওয়াজ।
মানিক পীরকে উদ্দেশ্য করে গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন লৌকিক আচার-উৎসবে এসব গান ও কবিতা গাওয়া হয়ে থাকে। এশিয়াটিক সোসাইটির সাতক্ষীরার পুরাকীর্তি বইতে পাওয়া এমন একটি গান হলো-
মাথায় রঙীন টুপি বোধের জাম্বিল
হাতে লয়ে ‘আসা’ বাড়ি ফেরে মানিক পীর।
সেই জনে দিব আমি দুনিয়ার ভাব
কলিকালে মানিক হবে অবতার।
মনিক পীরকে নিয়ে আর একটি গান হলো-
সোনাপীর উঠে বলে মানিক পীর রে ভাই
এসেছি গোয়ালপাড়া জাহির রেখে যাই।
আগে নডি পাস করি বাতানে দিল বাড়ি।
নব লক্ষ ধেনু, ম‘ল বিশ লক্ষ বাছুরি।
বাতাসে পড়ে মলো বাতাসে ভাসুর।
দরবারে পড়ে মল দরবারে শ্বশুর।
এখনো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে মানিক পীরের দরগা হিসেবে পরিচিত ইমারতগুলো দেবহাটায় পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে। সাতক্ষীরা শহর থেকে অটোরিকশা ভাড়া করে এখানে আসতে পৌনে ১ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না। পথের দু’পাশে কোথাও ফসলের ক্ষেত, কোথাওবা মাছের ঘের নজর কাড়ে। বনবিবির বটতলা আর জমিদার বাড়ি পড়ে মানিক পীরের দরগায় আসার পথেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৭
এইচএ/জেডএম/