ভৌগলিক অবস্থান, পুঁথি সাহিত্য আর ইতিহাসের খোলা পাতা অনুযায়ী, বেতনা নদীর দক্ষিণ তীরে এই স্থানটার নাম লাবসা। এখানেই বসবাস করতেন গাজী পীর।
এই গাজী পীর সুন্দরবন এলাকার জনপ্রিয় পুঁথি সাহিত্য গাজী কালু চম্পাবতীর প্রধান চরিত্র। আর মায়ী চম্পা তার স্ত্রী। যার পিতা ১৪ শতকের প্রথমার্ধের প্রতাপশালী রাজা মুকুট রায়। যার রাজ্য ছিলো দক্ষিণে সুন্দরবন ও পশ্চিমে হুগলি পর্যন্ত বিস্তৃত। পাবনা, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, নদীয়া, বর্ধমানের বিস্তৃত এলাকায় দাপটের সঙ্গেই জমিদারি করেছেন এই ব্রাহ্মণ। তার রাজধানী ছিলো ঝিকরগাছা সদর থেকে দেড় মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে লাউজানিতে। সুন্দরবনের বাঘের দেবতা হিসেবে পূজিত ব্রাহ্মণ দক্ষিণ রায় ছিলেন এই মুকুট রায়েরই সেনাপতি।
আর গাজী পীর লোকজ দেবতা হিসেবে পূজিত হন। হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত সুন্দরবনের সবাই তাকে স্মরণ করে। যে কেউ সুন্দরবনে ঢোকার আগে হাতজোড় করে বনবিবির পাশাপাশি গাজীর নামে দোহাই দিয়ে ঢোকে। সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়গুলোতে সাদা বর্ণের মুখে দাড়িসহ কোথাও জামা-পায়জামা-পাঞ্জাবিসহ মূর্তি, কোথাও লুঙ্গি পরা ঘাড়ে গামছাসহ মূর্তি পূজিত হয়। এই পূজার নিরামিষ নৈবেদ্য হলো বাতাসা, পাটালি, আতপচালের শিরণি ইত্যাদি। গ্রামের সাধারণ মানুষ জঙ্গলে প্রবেশ ছাড়াও গৃহপালিত পশুপাখি কামনা করেও গাজী সাহেবকে স্মরণ করে থাকেন।
মুকুট রায়কে পরাজিত করে তার রাজ্য ও রাজধানী ছারখার করে তার কন্যা চম্পাবতীকে বিয়ে করেন এই গাজী পীরই।
তার প্রকৃত নাম গাজী মিয়া বা বড়খান গাজী। পিতা জাফর খান গাজী বা শাহ সিকান্দার ছিলেন ত্রিবেনী ও সপ্তগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্তা। গাজী পীর এর বংশ পরিচয় পুঁথিতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
গোড়া বাজা গয়েপদি, তার বেটা সমসদি
পুত্র তার সাঁই সেকান্দার, তার বেটা বড়খান গাজী
খোদাবন্দ, মুলুকের কাজী
কুলযুগে তার অবসর বাদশাই ছিড়িল বঙ্গে
কেবল ভাই কালুর সঙ্গে, নিজ নামে হইলো ফকির।
ত্রিবেনীতে জাফর খান গাজীর মাজারে সংরক্ষিত কুরসীনামার সঙ্গে পুঁথি সাহিত্যে উল্লেখিত বংশ তালিকার অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। কুরসীনামার তথ্য বলছে, জাফর খান গাজীর মৃত্যু হয় ১৩১৩ সালে। তার পুত্র সংখ্যা ২। একজনের নাম উগওয়ান খান, অপরজনের বড়খান গাজী। বড় শব্দটি থাকায় বড় খান গাজীকেই জ্যেষ্ঠ পুত্র ধরা হয়।
বাল্যকালেই ফকির-দরবেশের সাহচর্যে আধ্ম্যাতিক সাধনায় উন্নতি লাভ করেন গাজী। পিতার কাছে শাসন ক্ষমতা নিতেও অস্বীকার করেন তিনি। ইসলাম প্রচার শুরু করেন দক্ষিণ বঙ্গের যশোর-খুলনা অঞ্চলে। ধর্ম প্রচারে বাধা প্রাপ্ত হয়ে রাজা মুকুট রায়ের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয় তার।
পুঁথি সাহিত্যের তথ্য অনুযায়ী, মুকুট রায়ের স্ত্রী লীলাবতীর ৭ পুত্র। ১ কন্যা চম্পাবতী বা শুভদ্রা। তার রূপের খ্যাতি ছিলো জগৎজোড়া। এ নিয়ে পিতার গর্ব ছিলো সীমাহীন। কিন্তু গাজী তার প্রেমে পড়েন। পুঁথিতে বলা হচ্ছে-
বিধুমুখী চম্পাবতী কার কাছে আছে বসি
জ্বলিতেছে রূপ যিনি লক্ষ কোটি শশী।
হঠাৎ চম্পার রূপ নয়নে হেরিয়া
মূর্চ্ছিত হইয়া গাজী পড়িলো ঢলিয়া।
কিন্তু চম্পাবতীর রূপে গাজীর এভাবে চেতনা হারানোর ঘটনাকে অলীক বলেই মনে করেন এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত সাতক্ষীরার পুরাকীর্তি বইয়ের লেখক মিজানুর রহমান। তার যুক্তি, পুঁথিতেই আছে, গাজী ছিলেন সংসার বিবাগী মানুষ। তাই তার রূপ দেখে গাজীর মুর্চ্ছিত হওয়ার কথা নয়। এমনকি চম্পার জন্য তার যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াটাও অস্বাভাবিক। কার্যত মুকুট রায়ের কাল হয় জাতিবিদ্বেষ।
ভাই কালুকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে মুকুট রায়ের দরবারে পাঠিয়েছিলেন গাজী। কিন্তু মুকুট রায় তাকে বন্দি করেন। এরই জেরে ঝিকরগাছার লাউজানিতে মুকুট রায়ের সঙ্গে গাজী পীরের যুদ্ধ হয় ১৩৬৫ সালে। গাজীর দল যুদ্ধে জেতে। মুকুট রায় সপরিবারে আত্মহত্যা করেন। তার কনিষ্ঠ পুত্র কামদেব ও চম্পাবতী বন্দি হন গাজী বাহিনীর হাতে। পরে ইসলাম গ্রহণ করে কামদেব হন পীর ঠাকুর। আর ভক্তদের অনুরোধে চম্পাকে বিয়ে করেন গাজী।
পরবর্তীতে গাজীর নামেই গড়ে ওঠে গাজীর হাট, গাজীপুর, গাজীর জাঙ্গাল, গাজীডাঙ্গা, গাজীর ঘাট, গাজীর দেউল, গাজীর খাল, গাজীর ঘুটো ইত্যাদি এলাকা।
কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল কাব্যেও চম্পাবতীর পরিচয় ও বিয়ের গল্প একই। তবে কেউ কেউ মুকুট রায় নিজেই চম্পাকে গাজীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বলে দাবি করে থাকেন। আবার নৌকাডুবির কারণে মায়ী চম্পা এই লাবসায় এসে আস্তানা গাড়েন বলেও গল্প প্রচলিত আছে।
তবে যশোরের বারোবাজারে গাজী, কালু, চম্পাবতীর মাজার আর এই মায়ী চম্পার মধ্যে যোগসূত্রটা আসলে কি, আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে জি না তা আর এখন নিশ্চিত হওয়ার জো নেই।
চৈত্র, বৈশাখ আর জৈষ্ঠ মাসে এখনো মেলা বসে মায়ী চম্পার দরগায়। যে মেলা পরিণত হয় বহু ধর্ম আর জাতির মিলন কেন্দ্রে। সাতক্ষীরা শহর থেকে লাবসার এই দরগার দূরত্ব ৩ কিলোমিটারের বেশী নয়। শহর থেকে যশোরগামী বাস বা অটোরিকশায় করে সহজেই আসা যায় মায়ী চম্পার দরগায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৬
জেডএম/