ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

সংস্কারের অভাবে বিলুপ্তির পথে হরিপুরের রাজবাড়ি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১৯
সংস্কারের অভাবে বিলুপ্তির পথে হরিপুরের রাজবাড়ি

ঠাকুরগাঁও: ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে হরিপুর উপজেলার ঐতিহাসিক রাজবাড়ি। হরিপুর উপজেলার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রাজবাড়িটি ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর অগোচরে হারিয়ে যাচ্ছে। সরকারিভাবে সংস্কার করা হলে রাজবাড়িটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।

এই প্রাসাদোপম অট্টালিকাটি নির্মিত হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে। এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন ঘনশ্যাম কুন্ডুর বংশধর রাঘবেন্দ্র রায় চৌধুরী।

আর সম্পন্ন করেন তারই পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী।

মুসলিম শাসন আমলে আনুমানিক ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে ঘনশ্যাম কুন্ডু নামক একজন ব্যবসায়ী এন্ডি কাপড়ের ব্যবসা করতে হরিপুরে আসেন। তখন মেহেরুন্নেসা নামে এক বিধবা মুসলিম নারী এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। তার বাড়ি মেদিনীসাগর গ্রামে। জমিদারির খাজনা দিতে হতো তাজপুর পরগনার ফৌজদারের কাছে। খাজনা অনাদায়ের কারণে মেহেরুন্নেসার জমিদারির কিছু অংশ নিলাম হয়ে গেলে ঘনশ্যাম কুন্ডু কিনে নেন। ঘনশ্যামের বংশধরদের একজন রাঘবেন্দ্র রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বৃটিশ আমলে হরিপুর রাজবাড়ির কাজ শুরু করেন। কিন্তু তার সময়ে রাজবাড়ির কাজ শেষ হয়নি।

বাড়িটি ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়।  ছবি: বাংলানিউজ

রাঘবেন্দ্র রায়ের পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে রাজবাড়ির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। এসময় তিনি বৃটিশ সরকার কর্তৃক রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত হন। জগেন্দ্র নারায়ণ রায়ের সমাপ্ত করা রাজবাড়ির দ্বিতল ভবনে লতাপাতার নকশা এবং পূর্ব দেয়ালের শীর্ষে রাজর্ষি জগেন্দ্র নারায়ণের চৌদ্দটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে।

এক শতাব্দীরও বেশি পুরানো এই অট্টালিকাটির দৃষ্টিনন্দন কারুকাজের বিলুপ্তপ্রায় নিদর্শনগুলো প্রাচীনত্বের বিবেচনায় খুব মূল্যবান না হলেও স্থাপত্য কীর্তি হিসেবে এখনো মানুষকে কাছে টেনে নিয়ে যায়। জগেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী বৃটিশ সরকার কর্তৃক রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। সেসময়ে বৃটিশ সরকার তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই সামন্তপ্রভুদের বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করে খুশি করতে চাইতেন। জগেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরীকে এই একই উদ্দেশ্যে রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন সত্য। কিন্তু এই উপাধি দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভবত আরও একটি বিষয় কাজ করেছিল। আর সেটি হলো তার বিদ্যানুরাগ ও শিল্প সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপারে আগ্রহ।

সংস্কার করা হলে হরিপুর রাজবাড়ি হতে পারে অন্যতম পর্যটন গন্তব্য।  ছবি: বাংলানিউজ

রাজর্ষি জগেন্দ্রনারায়ণ যেমন আকর্ষণীয় স্থাপত্যশৈলীর প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তেমনই তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারও। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাজর্ষির এই অনুরাগ শুধু তার ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে তা নয়, হরিপুরবাসীর মানসিক ঐশ্বর্যের উজ্জ্বল দিকটি তুলে ধরে।

শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার এই ধারায় আলোকিত জীবনের যে আকাঙ্ক্ষা সেদিন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল তা আজও অনেকটাই বহমান রয়েছে এই হরিপুরে।

ভবনটির পূর্বপাশে একটি শিব মন্দির এবং মন্দিরের সামনে নাট মন্দির রয়েছে। রাজবাড়িতে ছিল একটি বড় পাঠাগার যার অস্তিত্ব এখন নেই। রাজবাড়িটির যে সিংহদরজা ছিল তাও নিশ্চিহ্ন হয়েছে।  

১৯০০ সালের দিকে ঘনশ্যামের বংশধররা বিভক্ত হলে হরিপুর রাজবাড়িও দু’টি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। রাঘবেন্দ্র-জগেন্দ্র নারায়ণ রায় কর্তৃক নির্মিত রাজবাড়িটি বড় তরফের রাজবাড়ি নামে পরিচিত। এই রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে নগেন্দ্র বিহারী রায় চৌ. ও গিরিজা বল্লভ রায় চৌ. ১৯০৩ সালে আরেকটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন যার নাম ছোট তরফ।

হরিপুর উপজেলার রাজবাড়ি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ৮৫ বছরের বয়সী নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলা উপজেলা সহ দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ বাড়িটি দেখতে আসেন। পুরাতন ঐতিহাসিক রাজবাড়ি। যদি রাজবাড়িটি ঠিক মতো সংস্কার করা যায় তাহলে হয়তো এটা দর্শনার্থীদের জন্য একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যাবে। আর সংস্কার না করলে হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।  

রাজবাড়ি এলাকার শারমিন আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, রাজবাড়িটি জরুরি ভিক্তিতে সংস্কার করা না হলে আমাদের পরের প্রজন্ম হয়তো আর দেখতে পাবে না। বাড়িটি ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে লোকজনের আনাগোনা চলে সবসময়। এটা রক্ষা করা দরকার।

প্রাসাদোপম অট্টালিকাটি নির্মিত হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে।  ছবি: বাংলানিউজ

হরিপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম. জে আরিফ বেগ বাংলানিউজকে বলেন, হরিপুর উপজেলার প্রাচীন এই রাজবাড়িটি সংস্কার করার জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বাড়িটি পরিদর্শ করে গেছে। স্থানীয়ভাবে আমরা বাড়িটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করি সবসময়। যদি সরকারিভাবে অনুদান পাওয়া যায় তাহলে খুব দ্রুত এর সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।

ঠাকুরগাঁও জেলার প্রশাসক এ কে এম কামরুজ্জামান সেলিম জানান, ঠাকুরগাঁওয়ের সব ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আবেদন করা হবে।

হরিপুর উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ চায় এই রাজবাড়িটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের যেন সব ধরনের সহযোগিতা করে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া না হলে কালের সাক্ষী হিসেবে থাকা রাজবাড়িটি লোকচক্ষুর অগোচরে বিলীন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৯
এইচএডি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ