প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ২০৩০ সালের মধ্যে ৬.৭৩ শতাংশ (বহিঃসাহায্য ছাড়াই) থেকে ২১.৮৫ শতাংশ (বহিঃসাহায্য সাপেক্ষে) গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। জ্বালানি রূপান্তর শুধু একটি আকাঙ্ক্ষা নয়, এটি একটি প্রয়োজন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি এই চাপ কমিয়ে দেশের দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৪.৬৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে আসে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চুক্তি বাতিল করেছে, দুর্নীতির ঝুকি কমাতে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সৌরবিদ্যুৎ উতপাদনে ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১০টি গ্রিড সংযুক্ত করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ভূমির ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছে।
তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের মতো নবীন এবং অধিক ঝুকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগের প্রতিদান নিশ্চিত হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে প্রণোদনা কম থাকায় তা অনেক কম। তাই স্বচ্ছতা বজায় রেখেই কিভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অধিক প্রণোদনা দেওয়া যায়, যা যৌক্তিক বটে, তা ভাবা দরকার। প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো লক্ষ্য নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ৬.৭১ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন পেয়েছে। ২০২১-২২ জলবায়ু বাজেটে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড এবং ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের সহায়তায় প্রায় ১৯৮ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ প্রদান করা হলেও যথাসময়ে তা ছাড় না দেওয়ায় অর্থের সংকট থেকেই যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র নবায়নযোগ্য শক্তি এবং গবেষণার জন্য এক বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কখন, কোন খাতে, কিভাবে বরাদ্দ প্রদান করা হবে তা সুনিশ্চিত নয়।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য প্রকল্পগুলোর জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৭.২ বিলিয়ন এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নবায়নযোগ্য প্রকল্পে জাতীয় জলবায়ু বাজেটের মাত্র ৩.২ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া উচ্চ আমদানি শুল্ক, যেমন—সোলার প্যানেলের জন্য ২৭ শতাংশ এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য ৩৮ শতাংশ শুল্ক আরোপের কারণে প্রকল্পগুলোর খরচ বেড়ে যায়। তদুপরি জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানিতে ব্যাপক ভর্তুকি প্রদান এবং স্থানীয় ব্যাংকগুলো থেকে সাশ্রয়ী মূলধনের অভাবও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে।
এই উদ্যোগগুলো দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলেও এর বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তি নীতিমালায় অর্থায়নের যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, যা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ঘাটতি সৃষ্টি করেছে। অনেক উন্নয়ন লক্ষ্য এবং প্রণোদনা, যা নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগকে উত্সাহিত করার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট এবং তাতে আন্তর্জাতিক অর্থায়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যার ফলে এখন পর্যন্ত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা থাকলেও কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি তহবিল গঠন করা হয়নি। আইএমএফ-আরএসএফ ও ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের প্রতিশ্রুত প্রায় এক বিলিয়ন ডলার দিয়ে তা শুরু করা যেতে পারে।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্র নতুন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার প্রদান করবে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিবছর প্রায় ২৫ বিলিয়ন (প্রায় ২৯.৩ বিলিয়ন ডলার) প্রদান করছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে। জলবায়ু ঋণ না নিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অনুদান এবং বিদেশি বিনিয়োগ পেতে দ্বিপক্ষীয়ভাবে অগ্রাধিকার প্রদান করতে পারে।
আন্তর্জাতিক তহবিল ব্যবহারের পাশাপাশি ডেট-ফর-ক্লাইমেট সুয়াপ এবং গ্রিন বন্ড ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের ১০ বিলিয়ন ডলার গ্রিন বন্ড প্রগ্রাম, যা নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পগুলোতে সফলভাবে অর্থায়ন করেছে, ইন্দোনেশিয়া বর্তমানে তাদের ঋণের একটি অংশ মওকুফের বিনিময়ে জলবায়ু প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন পার্টনারশিপস (জেইটিপি) একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তি রূপান্তরে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৮.৫ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করা হয়েছে, যা তাদের জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর ত্বরান্বিত করেছে এবং শক্তি খাতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে।
এ ছাড়া বিদ্যুকেন্দ্রগুলোর জন্য কোনো নির্দিষ্ট মানসম্পন্ন চুক্তির কপি (standardized contract) নেই। প্রতিটি সিদ্ধান্ত পৃথকভাবে গ্রহণ করা হয়, যা বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর চাহিদা এবং পরিস্থিতিতে জটিলতা সৃষ্টি করে। যেমন—টাকা-ডলার বিনিময় হার, জ্বালানির মূল্য এবং মুদ্রাস্ফীতি হারের পরিবর্তন সাপেক্ষে ট্যারিফ সমন্বয়ের ব্যবস্থা সব প্রকল্পে দেওয়া হয় না। বায়ুশক্তি খাতে বিনিয়োগ এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় কোনো অগ্রগতি হয়নি। এই খাতে অর্থায়ন এবং নীতিগত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবই এর প্রধান কারণ। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকি ধীরে ধীরে কমিয়ে ২০৩৫ সালের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় ৪.৩৫৮ বিলিয়ন ডলার সঞ্চয় হবে, যা জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে তা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।
এর পাশাপাশি জলবায়ু, পরিবেশ, দুর্যোগ এবং জনস্বাস্থ্য অর্থায়নে কার্বন কর এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ফি/দূষণ করারোপের মাধ্যমে বছরে সর্বোচ্চ ৩.৪ বিলিয়ন ডলার সবুজ অর্থায়ন সম্ভব, যা দিয়ে প্রায় ৩০০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি (বিশেষ করে সৌর) উৎপাদন করা সম্ভব। ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে ক্যাপাসিটি চার্জ ধীরে ধীরে কমালে আনুমানিক মোট সঞ্চয় হবে প্রায় ১.৮৭২ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য প্রকল্পের জন্য একটি মানসম্মত পাওয়ার পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট (PPA) প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য ট্যারিফের ন্যায্য সমন্ব্বয় নিশ্চিত করবে।
বিকেন্দ্রীভূত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি প্রণয়ন, কমিউনিটি গ্রিডের মাধ্যমে গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন এবং জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের জন্য সৌর মিনিগ্রিড ও অফ গ্রিড সৌর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। এ ছাড়া স্মার্ট গ্রিড ও মিনিগ্রিড প্রযুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎ গ্রিড উন্নত করা জরুরি। জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ করতে সৌরবিদ্যুতের সরবরাহ বেশি, এ রকম জায়গায় জমি নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে যথাযথ সেবা প্রদানে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে প্রতিবছর ১০ হাজার প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান তৈরি করা প্রয়োজন। সর্বোপরি, যথাযথ নীতিমালা, কার্যকর অর্থায়ন প্রক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই রূপান্তর ত্বরান্বিত করা সম্ভব। বাংলাদেশের উচিত এই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে টেকসই শক্তির একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা।
তথ্যসূত্র
1. Advancing Bangladesh’s Green Energy Transition, Change Initiative, 2024
2. Renewable Energy Finance- A Critical Analysis, Change Initiative, 2023
3. How Legal and Policy Regime can be Conductive for Promoting Re-finance in Bangladesh, Change Initiative, 2023.
4. Renewable Energy Finance Risk Factors and De-risking Mechanisms, Change Initiative, 2023.
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫