ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

বৈরী আবহাওয়ায় পাবনায় মৌসুমি ফলের ব্যাপক বিপর্যয়

মুস্তাফিজুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০২৪
বৈরী আবহাওয়ায় পাবনায় মৌসুমি ফলের ব্যাপক বিপর্যয়

পাবনা: চলতি বছরে বৈরী আবহাওয়া ও তীব্র তাপদাহের কারণে জেলার বেশিরভাগ লিচু ও আমের বাগানে ফলের গুটি ঝরে পরায় ফলনে ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এ কারণে এ অঞ্চলের ফল চাষিরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

 

এই মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় খরায় ঝরে পড়ছে লিচু ও আমের গুটি। সেচ ব্যবস্থা ও গাছে পানি দিয়েও রক্ষা হচ্ছে না ফল। আর এই সমস্যা মোকাবিলায় কৃষি বিভাগের দায়িত্বশীল কাউকে পাশে পাচ্ছেন না পরামর্শ গ্রহণের জন্য। তাই এ বছরে ফল চাষিরা চরমভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তারা।

কৃষি ফসল ও ফল ভাণ্ডার হিসেবে দেশের অন্যতম জেলা পাবনা অঞ্চলের বেশ সুনাম রয়েছে। এই অঞ্চলের কৃষকেরা কৃষি ফসলের পাশাপাশি ব্যাপক হারে ফলের চাষাবাদ করে থাকেন। বিশেষ করে পাবনা সদরসহ ঈশ্বরদী অঞ্চলে আগাম জাতের লিচুসহ নানা প্রজাতের দেশি ও হাইব্রিড জাতের আমের চাষাবাদ করে থাকেন। ঈশ্বরদী অঞ্চলের বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে যেদিকে চোখ যাবে শুধু লিচু ও আমের বাগান চোখে পড়বে। পাশাপাশি এই অঞ্চলে আবহাওয়া ও মাটির কারণে আম, লিচু ও কাঁঠালের ব্যাপক ফলন হয়ে থাকে। যা জেলার মানুষের চাহিদা মিটিয়ে সারাদেশে সরবরাহ হয়ে থাকে।

তবে চলতি মৌসুমে প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে লিচুর ও আমের গুটি ঝরে পড়ছে। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না ফল ঝরে পরা। একইসঙ্গে এই বছরে বিশেষ করে আম গাছে কালো কালির মতো এক প্রকারের ছত্রাক দেখা দিয়েছে। তাই বিগত বছরের চাইতে এই বছরে ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন বাগান মালিক ও ফল চাষিরা। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাগানের ফল রক্ষায় পরামর্শ দিতে স্থানীয় কৃষি বিভাগের কাউকে তারা কাছে পায়নি বলে অভিযোগ করেন। একই সঙ্গে ফল চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী ও ফল চাষিদের সরকারি প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসার দাবি তাদের। তাপপ্রবাহের কারণে শুকিয়ে পচে মাটিতে পরে যাচ্ছে গুটি আম ও লিচু। গাছের ফল টিকিয়ে রাখতে প্রতি সপ্তাহে একদিন করে গাছের গোড়ায় ও সপ্তাহে দুইদিন করে গাছের ওপরের অংশে পানি স্প্রে করছেন তারা।  

তবে কৃষি বিভাগ বলছে কৃষকদের অসচেতনতার কারণে বলার পরেও তারা দিনের বেলাতে প্রখর রৌদ্রের ভেতরে গাছের ওপরে পানি স্প্রে করছেন আর এই কারণে গাছের ও ফলনের আরও ক্ষতি হচ্ছে। তাই দিনের বেলা নয় রাতের বেলা অথবা সকাল বেলা রোদ ওঠার আগে গাছের পানি দেওয়া উত্তম।

পাবনা ঈশ্বরদী উপজেলার চররূপপুর গ্রামের লিচু বাগান মালিক পলাশ আহম্মেদ বলেন, বিগত বছরে দুই কোটি টাকার লিচুর বাগান কিনে প্রায় ৭০ লাখ টাকা লস হয়েছে। একটি বাগান ৫ থেকে ৬ ধাপে বিক্রি হয়। এই জমি ও বাগানের প্রকৃত মালিক যারা তাদের কাছ থেকে আমরা বাগান কিনে ফলের ব্যবসা করি। এই বছরে যে পরিমাণ মুকুল হয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল লস হবে না। তবে যতদিন যাচ্ছে গাছ থেকে মুকুল শুকিয়ে ঝরে পরছে। এটা মুকুল নয় টাকা পচে পড়ছে। নিজেরা যতটুকু জানি গাছের পরিচর্যার জন্য সব কিছু করেছি। সার, বিষ, কীটনাশক, মেডিসিন সব কিছু দিয়েছি কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।

প্রতিটি বাগানে নিজেরা মেশিন দিয়ে গাছে পানি দেওয়া হচ্ছে তবু কাজ হচ্ছে না ভাই। আমরা এখন পর্যন্ত কোনো কৃষি বিভাগের দায়িত্বশীল কাউকে পায়নি বুদ্ধি পরামর্শের জন্য। কৃষকদের ফল চাষিদের নাকি তালিকা করে প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে কই একটি পয়সা তো আমরা পাইনি। তাই সরকারের কাছে আমাদের আবেদন একটু নজর দিন আমাদের দিকে। তবেই ফল চাষিরা বাঁচবে কৃষক বাঁচবে।

একই উপজেলার ফলচাষি মো. আখতারুজ্জামান মিঠু বলেন, একদিকে ফল নষ্ট অন্যদিকে আম গাছে কালি পড়ে ফল পচে নষ্ট হয়ে ঝরে পড়ছে কোনোকিছু দিয়েই কাজ হচ্ছে না। কয়েক হাজার কৃষকের বছরের আয়ের একমাত্র উৎস এই ফলের বাগান ফল চাষ। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে ফল ঝরে যাচ্ছে। কোনো কৃষি অফিসার আমাদের ফল রক্ষায় পরামর্শ দিতে এগিয়ে আসেনি। কোনো মেডিসিন দিয়েই ফল রক্ষা করা যাচ্ছে না। গাছে কালা ছত্রাক আক্রমণ করেছে। প্রথমদিকে আমাদের আশা ভরসা ছিল ফলন এবার ভালো হবে। কিন্তু আবহাওয়ার কারণে ফলনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে ফল চাষিরা। তাই সরকারি সহযোগিতা দরকার কৃষি বিভাগের সহযোগিতা দরকার। যখন মূল বের হয় তখন খুব খুশি ছিলাম। কিন্তু এখন যে অবস্থা তাতে লস হবে আমাদের।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দিন বলেন, কৃষি সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে পাবনা জেলার নাম রয়েছে। এই অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সারা দেশে সরবরাহ হয়ে থাকে। ফল মৌসুমে বিশেষ করে আগাম জাতের লিচু ও আম হয়ে থাকে এই জেলাতে। এই বছরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ফলনে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে সেটি কাটিয়ে উঠতে কৃষক ও কৃষি বিভাগ কাজ করছে। এই বছরে ৯০ শতাংশ ফল গাছে মুকুল ও ফল এসেছে যা বিগত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। ৬০ শতাংশ বাগানে ফলন হয়েছিল এই বছরে ৯০ শতাংশ গাছে ফল ধরেছে। বৈশ্বিক আবহাওয়ার কারণে ফলনে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সেটি রক্ষায় আমরা কৃষকদের সব সময় পরামর্শ দিয়ে আসছি। দিনের বেলাতে সেচ বা স্প্রে না করে ভোর বা বিকেল বেলা অথবা রাতের বেলায় পানি স্প্রের করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কৃষক ভুল করে দিনের বেলায় প্রখর রৌদ্রের মধ্যে গাছে পানি ছিটাচ্ছে। এই কারণে গাছ ও ফলের ক্ষতি বেশি হচ্ছে। ১০টি মনিটরিং দল গঠন করা হয়েছে উপ-সহকারী কৃষি অফিসারদের নিয়ে। তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। আশা করছি সব বিপর্যয় মোকাবিলা করে কৃষকের মুখে হাসি ফুটবে।

জেলাতে এই বছরে ৪,৭২১ হেক্টর জমিতে আগাম জাতের লিচু ও ২,৭৩০ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। এই বছরে আগাম জাতের লিচুর গড় ফলনের সম্ভাবনা দেখছেন প্রায় ৮শ মেট্রিক টন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরেও প্রায় ৭শ মেট্রিক টন লিচু পাওয়া সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন কৃষি বিভাগ। জেলাতে কৃষি বিভাগের তথ্য অনুসারে তালিকাভুক্ত ফল চাষি রয়েছেন প্রায় ৩ হাজার। বৈরী আবহাওয়ার সময়ে গাছের যত্ন ও কৃষক বা ফল চাষিদের পরামর্শ প্রদানের জন্য জেলাতে উপ-সহকারী কৃষি অফিসার নিয়ে ১০টি টিম গঠন করে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের নিয়ে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।  

পাবনা সদর ও ঈশ্বরদী অঞ্চলের হিমায়েতপুর, চর আশুতোষপুর, গয়েশপুর, নাজিরপুর, আওতাপাড়া, সিলিমপুর, চর গড়গড়ি, জয়নগর, মানিক নগর, দাশুড়িয়া অঞ্চলে আম ও লিচুর বাগান রয়েছে। বিগত বছরে জেলায় লিচুর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ হাজার ৭৪৬ মেট্রিক টন। চলতি বছরে প্রতি হেক্টর জমিতে ৮ মেট্রিক টন ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ধরে ৩৭ হাজার ৭৬৮ মেট্রিক টন লিচু ফলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। আর প্রতি হেক্টরে ১৬ মেট্রিক টন হিসেবে চলতি বছরে আমের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৩ হাজার ৬৪০ মেট্রিক টন। যা বিগত বছরের চেয়ে প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন বেশি লিচুর ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।