ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

শিশুতোষ প্রকাশনায় গুরুত্ব দেওয়ার মত অভিভাবকদের

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৩
শিশুতোষ প্রকাশনায় গুরুত্ব দেওয়ার মত অভিভাবকদের অমর একুশে বইমেলায় শিশুতোষ প্রকাশনার হালহকিকত নিয়ে অভিভাবক ও কিশোর পাঠকদের অভিযোগের অন্ত নেই৷ ছবি: শাকিল আহমেদ

ঢাকা: ছয় বছর বয়সী মেয়ে জাহারা সারোয়ার বর্ণমালাকে নিয়ে সকালে বইমেলায় এসেছিলেন বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. মোফাজ্জল সারওয়ার৷ পড়ুয়া মেয়েকে তার পছন্দের বইগুলো উপহার দেওয়ার আগে রঙবেরঙে আঁকা কার্টুন আর গল্পগুলো যাচাই করতে গিয়ে আঁতকে উঠলেন তিনি। গাছের ডাল থেকে ঝুলছে এক রক্তাক্ত ব্যাঙ, সরীসৃপের ছবিও কী বিদঘুটে! ওই বইটি রেখে বর্ণমালা এগিয়ে যায় অন্য একটি প্রকাশনীর স্টলে।

এবার তার মা দিল আফরোজ তানিয়া দেখেন, গল্পের বইয়ে কন্যাশিশুকে দেখানো হয়েছে দুর্বলচেতা ভীরু নাগরিক হিসেবে৷ মেয়েকে তো এমন বই কিনে দেওয়া চলে না৷ ভালো বইয়ের সন্ধানে অমর একুশে বইমেলার শিশু চত্বর ঘুরে তারা বই কিনতে পেরেছেন হাতেগোণা কয়েকটি৷

শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) অমর একুশে বইমেলায় বর্ণমালাদের সঙ্গে কথা হয় শিশু চত্বরের ইকরিমিকরি'র স্টলে৷

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক দিল আফরোজ তানিয়া বলেন, শিশুরা বইয়ের গল্প পড়ার সময় একটি অন্য জগতে প্রবেশ করে৷ বইয়ের চরিত্র ও কাহিনিগুলোর সঙ্গে নিজের চেনা জগতের মেলবন্ধন ঘটায় তারা৷ তাদের সামাজিক বিকাশের বড় একটি মাধ্যম বই। এখানে সংবেদনশীলতায় বড় ঘাটতি চোখে পড়েছে৷

মো. মোফাজ্জল সারওয়ার বলেন, শিশুরা বড় হয়ে কী হতে চায়, তা কল্পরাজ্যে আঁকতে শুরু করে যখন তখন সে ওই ধরনের বই কিনতে চাইবে৷ শিশুমন কী চায় তা জেনে আসলে বই লেখা উচিত।

ছয় বছরের মেয়ে রাইকা আন্দ্রেলিনাকে নিয়ে এদিন বইমেলায় আসেন মা তাসনুভা৷ তিনি বেশকয়েকটি পপ আপ আর ফ্লিপ বই কিনে দেন এদিন। ফেরার পথে তাসনুভা বলেন, শিশুদের বয়স উপযোগী বই মেলায় খুব কম। রঙচঙে বই কিনে নিয়ে গেলেই তো আর হলো না৷ বইয়ের কনটেন্ট কী সেটাও বিবেচনায় রাখতে হয়েছে।

অমর একুশে বইমেলায় শিশুতোষ প্রকাশনার হালহকিকত নিয়ে অভিভাবক ও কিশোর পাঠকদের অভিযোগের অন্ত নেই৷ মানহীন প্রকাশনার দায়ে সতর্কবার্তা পেয়েও অনেক প্রকাশক সেই চিরায়ত ধারায় রূপকথা, কল্পকাহিনি ও গল্প বা ছড়ার বই প্রকাশ করে চলেছেন। শিশুদের বর্ণমালা ও শব্দগুচ্ছ চেনানোর প্রয়োজনীয় বইগুলোর মান নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছেন অনেক অভিভাবক৷

বইমেলার শেষভাগে এসে শিশু চত্বরে আসা অভিভাবকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন শিশুদের জন্য পছন্দসই বই কিনতে। রূপকথার গল্প, ভূত-প্রেত আর দৈত্য দানোর গল্পেই শিশুদের ঝোঁক বেশি৷ পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, কৌতুকের গল্পেও শিশুদের আকর্ষণ ছিলো বরাবরের মতো৷ এসব বই দেদারসে বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন বাবুই প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী কাদের বাবু।

তার স্টল থেকে টিপু কিবরিয়ার থ্রিলার 'ডাইনোসর', শাহেদ ইকবালের কাব্যগ্রন্থ 'অলৌকিক ছাতা হাতে জলপাই বনে', রাজিব-উল-আহসানের 'শিশুনিবাসের কাণ্ডকারখানা' বইগুলোর প্রতি কিশোর পাঠকের ভালো চাহিদা রয়েছে৷ শিশুপ্রকাশ থেকে রহীম শাহর 'ছোটদের বিজ্ঞানজগৎ', ইমদাদুল হক মিলনের 'ছোটদের নানারকম গল্প' বইগুলোর প্রতি দারুণ আকর্ষণ রয়েছে কিশোরদের৷ শৈশব প্রকাশনী থেকে এবার লোপা মমতাজের 'ট্রাকোভন ও হাঁসের বাচ্চাগুলো' বইটি প্রকাশিত হয়েছে৷

স্টলের কর্মীরা জানান, বইটির প্রতি পাঠকের তুমুল চাহিদা রয়েছে৷ বইমেলায় আসা শিশু কিশোরদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঢাকা কমিকস, ইকরিমিকরি ও কিন্ডার বুকসের স্টল৷ ঢাকা কমিকস থেকে এবার এসেছে ফাহিম আনজুম রুম্মানের 'মফিজউদ্দীন' ও এষা আহসানের 'কার্টুন টার্টুন' কমিক সিরিজ৷ দুই কমিক সিরিজের প্রতি কিশোর পাঠকের যে তুমুল আগ্রহ, তা দেখা গেলো শুক্রবার বিকেলে৷ ইকরিমিকরি থেকে জামিল বিন সিদ্দিকের 'গ্লস্টারের দর্জি' শিরোনামে কিশোর গল্প ভালো বিক্রি হয়েছে৷ কিন্ডার বুকস থেকে এসেছে নয়টি বই৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'সুয়োরাণীর সাধ', 'তোতাকাহিনি'র সঙ্গে আহসান হাবীবের কৌতুকসমগ্র ইলাস্ট্রেশনের মাধ্যমে তুলে আনা হয়েছে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিশুদের জন্য।

শিশুতোষ প্রকাশনা ডাংগুলির প্রকাশক মহিউদ্দিন কলি শিশুতোষ প্রকাশনার বেহাল দশার কথা স্বীকার করে নিয়ে বলেন, আমাদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে আরও আধুনিক হতে হবে৷ প্রযুক্তিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে না নিয়ে উপায় হিসেবে নিতে হবে৷ আগামী বছর থেকে প্রিন্ট ভার্সনের বইয়ের পাশাপাশি আমরা অডিও বুক এবং ই-বুকও প্রকাশ করব৷ ইলেকট্রনিক গেজেটে বুঁদ হয়ে থাকে যে কিশোর, তাকেও আমরা বইপড়ুয়া হিসেবে গড়ে তুলব৷ পাশাপাশি বইয়ের কনটেন্ট হিসেবে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে শিশুমন উপযোগী করে প্রকাশ করব।

শিশুতোষ প্রকাশনার বেহাল দশা নিয়ে কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশীদ বলেন, একদল প্রকাশক, একদল লেখককে দিয়ে লিখিয়ে নেয় বটে, কিন্তু সেই লেখকের লেখাটা হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য কেউ নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশকই সম্পাদনা করেন। অথচ ভালো প্রকাশনার জন্য এডিটর প্যানেল খুব দরকার। দুই নম্বর হচ্ছে, ছোটদের জন্য লেখা যতটা পরিচ্ছন্ন করে ছাপা প্রয়োজন সেটাও হচ্ছে না। যেনতেন একটা কিছু করে দিলেই যেন হয়ে গেল। শিশুদের বইয়ে এখানে-ওখানে কাট কপি পেস্ট। এটা খুব অবহেলার, খুব অপমানের শিশুদের বইয়ের ক্ষেত্রে। তাছাড়া আমি যদি ৭-৮-১০ বছরের শিশুদের কথা ধরি, তাদের জন্য লেখাটা হচ্ছে না। আমি বলবো, শিশুসাহিত্যিক হতে হলে প্রথমেই তাকে শিশু মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে।  

এবার বইমেলায় শিশুচত্বরটি এবার বাংলা একাডেমির মন্দিরের পাশের গেইট দিয়ে প্রবেশের ঠিক ডান দিকে বড় পরিসরে রাখা হয়েছে। শিশু চত্বরে এবার ৭১টি প্রতিষ্ঠানকে ১১১টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মাসব্যাপী এ মেলায় সপ্তাহের দুদিন শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত থাকবে শিশুদের জন্য, এই সময়টাকে ঘোষণা করা হয় শিশু প্রহর হিসেবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৩
এইচএমএস/এসএ


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।