ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (২) || অনুবাদ : মাহমুদ মেনন

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (২) || অনুবাদ : মাহমুদ মেনন

‘১৯৮৪’ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।

২০০৪ সালে ‘দি গার্ডিয়ান’র জরিপে উপন্যাসটি বিশ্বের চিরায়ত গ্রন্থের তালিকায় উঠে আসে সবার উপরে। ইংরেজি ভাষার এই উপন্যাসটি কালজয়ী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। এতে ফুটে উঠেছে সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি, যুদ্ধ, শান্তির প্রেক্ষাপট। বইটির প্রথম বাংলায় অনুবাদ করছেন মাহমুদ মেনন। উল্লেখ্য, জর্জ অরওয়েলের মূল নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার। ১৯০৩ সালের ১৫ জুন ব্রিটিশ ভারতের বিহার রাজ্যের মথিহারিতে তার জন্ম। মৃত্যুবরণ করেন লন্ডনে ১৯৫০-এর ২১ জানুয়ারি। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘দি রোড টু উইগ্যান পাইয়ার’, ‘হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া’, ‘এনিমাল ফার্ম’ ইত্যাদি।

১ম কিস্তির লিংক


ভালোবাসা মন্ত্রণালয় সাক্ষাৎ এক ভীতির নাম। এই মন্ত্রণালয়ের ভবনে একটি জানালাও নেই। উইনস্টন এই মন্ত্রণালয়ে কখনোই ঢোকেনি, এমনকি এর চৌহদ্দির আধা কিলোমিটারের মধ্যেও যায়নি। দাপ্তরিক কাজ ছাড়া এখানে ঢোকাও যায় না। আর যদি যেতেই হয় তো কাঁটাতারে ঘেরা সরু পথ বেয়ে ইস্পাতের দরোজা গলিয়ে লুকোনো মেশিন গানের নলের সামনে দিয়ে ঢুকতে হবে। এমনকি যে সড়ক দিয়ে এতোসব বাধার মুখে গিয়ে পড়তে হবে তাতেও দেখা যাবে গরিলামুখো পাহারাদাররা কালো পোশাকে অস্ত্র আর মোটা বেত হাতে টহল দিচ্ছে।

হঠাৎই উল্টো ঘুরলো উইনস্টন। ততক্ষণে মুখমণ্ডলে একটি আশাবাদিতার অভিব্যক্তি সে মেখে নিয়েছে। টেলিস্ক্রিনের সামনে দাঁড়াতে এমনটাই উপদেশ রয়েছে। কক্ষ ছেড়ে সোজা ঢুকে পড়লো ছোট্ট রান্নাঘরে। দিনের এই সময়টাতে মন্ত্রণালয় থেকে বাইরে থাকায় ক্যান্টিনে তার জন্য বরাদ্দ দুপুরের খাবার নষ্ট হলো। সে ভালো করেই জানতো রান্না ঘরে বড় এক টুকরো কালচে রুটি ছাড়া আর কিছুই নেই। আর সে রুটিও পরের দিনের নাস্তার জন্য বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। তাক থেকে বর্ণহীন পানীয়র একটি বোতল নামিয়ে আনলো। সাদা লেবেলে লেখা ‘ভিক্টরি জিন’। একটা অস্বস্তিকর, তেলতেলে গন্ধ নাকে লাগলো- চীনাদের চাল থেকে স্প্রিটের যে গন্ধটি বের হয় ঠিক তেমন। এককাপ পরিমাণ পানীয় উইনস্টন গলায় ঢেলে, একটি ঝাঁকি সহ্য করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে, ঢক করে পেটে চালান করে দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ লালচে হয়ে উঠলো, চোখ দিয়ে পানি ছুটলো। জিনিসটি মনে হলো নাইট্রিক এসিড বা তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু। এটি পেটে গেলে মনে হবে মাথার পেছনের দিকটাতে কেউ রাবারের লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। পরের মূহূর্তেই পাকস্থলীর আগুন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলে পৃথিবীকে আবার ছন্দ-আনন্দময় মনে হবে। ভিক্টরি সিগারেট লেখা কুঁচকে যাওয়া একটি প্যাকেট থেকে একটি শলাকা বের করলো উইনস্টন। কিন্তু অসচেতনতায় এর উপরের দিকটা উল্টো করে ধরায় তামাকগুলো মেঝেতে পড়ে গেলো। পরের সিগারেটটি বের করে সতর্কভাবে হাতে নিয়ে লিভিং রুমে ফিরলো। টেলিস্ক্রিনের বাম দিকে পেতে রাখা ছোট্ট টেবিলটির ওপর বসলো। ড্রয়ার টেনে প্রথমেই বের করলো একটি কলমদানি। এরপর বের করে আনলো কালির দোয়াত আর মোটা কোয়ার্টো সাইজের নোটবুকটি। এর পেছনটা লাল আর কভারটি মারবেল রঙের।

লিভিং রুমে টেলিস্ক্রিন বসানো জায়গাটি কিছুটা অস্বাভাবিক। শেষ দেয়ালে বসালে গোটা রুমই এর আওতায় আসতো, কিন্তু এটি বসানো হয়েছে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ দেয়ালটির ওপর, ঠিক জানালার উল্টোদিকে। এতে একদিকে স্ক্রিনের চোখ এড়িয়ে একটি চোরকুঠুরি তৈরি হয়েছে, আর ঠিক সেখানটিতেই এখন বসে আছে উইনস্টন। হতে পারে ফ্ল্যাটগুলো বানানোর সময় এই অংশটিকে বুক শেল্ফের জন্য ভাবা হয়েছিলো। চোরকুঠুরিতে বসে উইনস্টন তখন টেলিস্ক্রিনের চোখের বাইরে। কোনো শব্দ করলে তা শোনা যাবে কিন্তু যতক্ষণ এখানে বসে থাকবে তাকে দেখা যাবে না। এমনই একটি অবস্থায় ঠিক যে কাজটি করতে সে যাচ্ছে সেটি করার জন্য অংশত কক্ষের ওই ভৌগলিক আকার-প্রকৃতিই তাকে উৎসাহিত করেছে।

অথবা হতে পারে ড্রয়ার টেনে এইমাত্র যে নোটবুকটি বের করে আনলো সেটিই এর কারণ। নোটবুকটি অদ্ভুত রকমের সুন্দর। এর পাতাগুলো মসৃণ ক্রিমের মতো। অনেক দিনের পুরোনো বলে কিছুটা হলদেটে। আর এরকম কাগজতো গত চল্লিশ বছর ধরে তৈরিই হচ্ছে না। উইনস্টন অনুমান করতে পারে, নোটবুকটি চল্লিশ বছরেরও বেশি পুরোনো হবে। শহরের বস্তির মতো একটি এলাকায় পুঁতিগন্ধময় ভাঙারির দোকানের জানালা দিয়ে প্রথম তার চোখে পড়ে নোটবুকটি। দেখেই ওটি পাবার ভীষণ ইচ্ছা হয় উইনস্টনের। দলের সদস্যদের সাধারণ দোকানে যাওয়া বারণ আছে। তবে তা যে খুব কড়াভাবে মানা হয়, এমনটা নয়। বেশ কিছু জিনিস আছে যেমন জুতোর ফিতা, রেজর ব্লেড এগুলো ওসব দোকানেই মেলে। রাস্তায় এদিক-ওদিক, মাথাটি ঘুরিয়ে খুব দ্রুত দেখে নিলো উইনস্টন। সুযোগ বুঝে আস্তে করে দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়লো আর আড়াই ডলার দিয়ে চট করে নোটবুকটি কিনেও ফেললো। ওই সময় উইনস্টনের মাথায় এটি কেনার পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেনি। অনেকটা অপরাধীর মতোই নোটবুকটি ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর এমনকি একটি আঁচড়ও এতে কাটা হয়নি। এ যেনো তার আপস করে পাওয়া এক সম্পত্তি।

উইনস্টন ঠিক যে কাজটি করতে যাচ্ছিলো তা হচ্ছে- ডায়েরি লেখা শুরু করা। কাজটি অবৈধ ছিলো না। (আসলে কোনও কাজই অবৈধ ছিলো না কারণ আইনই ছিলো না। ) তবে এটা সত্য একবার ধরা পড়ে গেলে সাজাটা হয় মৃত্যুদণ্ড, নয়তো দাসদের ক্যাম্পে কম করে হলেও ২৫ বছরের বাস। উইনস্টন কলমদানিতে একটি নিব বসিয়ে তাতে চুষুনি টিপে কালি তুলে নিলো। কালির কলম এখন সেকেলে। এর ব্যবহার বলতে গেলে উঠেই গেছে। এমনকি সই দিতেও এখন কলমের ব্যবহার কদাচই দেখা যায়। উইনস্টন কিন্তু এরই মধ্যে স্রেফ নোটবুকটিতে লেখার জন্যই একটি কলম কিনে ফেলেছে। কারণ তার মন বলছিলো, অমন সুন্দর ক্রিমের মতো মসৃণ পাতাগুলোতে আঁচড় কাটতে একটি সত্যিকারের নিবের কলমই যথার্থ। ইঙ্ক-পেন্সিল দিয়ে দিয়ে এই অমূল্য পাতায় ঘষাঘষি করার ইচ্ছা তার মোটেই ছিলো না।

হাতে লেখায় অভ্যস্ত ছিলো না উইনস্টন। দুই-একটি ছোটখাটো নোট লেখা ছাড়া আজকাল স্পিক-রাইট পদ্ধতিরই ব্যবহার চলে। তবে ঠিক এই মূহূর্তে সে প্রক্রিয়ার ব্যবহার কোনো কাজে দেবে না। কলমটি কালির দোয়াতে চুবিয়ে এক সেকেন্ডের জন্য দমে গেলো উইনস্টন। গোটা শরীরের ভেতরটা যেনো ঝাঁকুনি খেলো। কাগজের ওপর দাগ কাঁটা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর সেটাই সে করলো। ছোট ছোট প্যাচের অক্ষরে সে লিখলো-

৪ঠা এপ্রিল ১৯৮৪।

পিঠে হেলান দিয়ে বসলো উইনস্টন। পুরোপুরি একটা অসহায়ত্বের ভাবনা ভর করলো তার ওপর। শুরুতো হলো কিন্তু সে মোটে নিশ্চিতই হতে পারছিলো না এটা ১৯৮৪ সাল। স্পষ্ট করেই জানা তার বয়স এখন ঊনচল্লিশ। আর ১৯৪৪ অথবা ১৯৪৫ এর কোনো একটি দিনে তার জন্ম। কিন্তু গত এক বা দুই বছরে একটি বারের জন্যও কোনো তারিখ লেখা হয়নি। এতে সে যেনো সালটাই ভুলে বসে আছে।

হঠাৎ আরেকটি ভাবনা ভর করলো- কার জন্য এই ডায়রি লিখছে সে? ভবিষ্যতের জন্য, অনাগত প্রজন্মের জন্য। নোটবুকের পাতার ওপর লেখা অনিশ্চিত তারিখটির চারিদিকে চোখ ঘুরপাক খেতে থাকে, আর মাথায় আসে নিউস্পিকের একটি শব্দ ‘ডাবলথিঙ্ক’ (দ্বৈতচিন্তা)। এই প্রথমবারের মতো তার মনে হলো যা সে করতে যাচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে না। ভবিষ্যতের সঙ্গে আপনি কিভাবে যোগাযোগ করবেন? এটি প্রকৃতিগতভাবেই অসম্ভব। ভবিষ্যততো বর্তমানেরই সন্নিবেশ; তা যদি হয় তাকে কথা শোনানো দায়; আর হতে পারে ভবিষ্যত বর্তমানের চেয়ে ভিন্ন কিছু; তাহলে এই যোগাযোগের প্রচেষ্টাই বৃথা।

কিছুটা সময় কাগজের দিকে বোকার মতো চোখ ফেলে বসে থাকলো সে। টেলিস্ক্রিনে ততক্ষণে উচ্চস্বরে সামরিক সংগীত বাজতে শুরু করেছে। উইনস্টন বুঝতে পারছিলো না, সে কি নিজেকে ব্যক্ত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, নাকি যা কিছু সে লিখতে চেয়েছিলো তা সব ভুলে বসে আছে। গত কটি সপ্তাহ ধরে ঠিক এই মুহূর্তটির জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করছিলো। আর তার মন থেকে এই কথাটি একবারের মতোও আলাদা হয়নি যে, এজন্য তার আর কিছুই না, কেবল সাহসের প্রয়োজন। মূল লেখার কাজটি খুব যে কঠিন হবে তা নয়। তাকে একটি কাজই করতে হবে, বছরের পর বছর ধরে সারাক্ষণ মাথার ভিতর যা কিছু ঘুরপাক করছে তা কলম ঘুরিয়ে কাগজে চালান করে দেওয়া। কিন্তু এই মুহূর্তে যেনো সবকিছুই শুকিয়ে গেছে। উপরন্তু পায়ের গোড়ালির ওপরের ঘায়ে একটু বাড়াবাড়ি রকমের অসহনীয় চুলকানি অনুভূত হচ্ছে। তবে চুলকানোর সাহস করলো না সে। কারণ যখনই চুলকায় তখনই ঘায়ের জায়গাটি ভীষণ জ্বলতে থাকে। টিক টিক করে একেকটি সেকেন্ড বয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে সামনে কাগজের শূন্য পাতা ছাড়া যেনো আর কিছুই তার অনুভূতিতে নেই। এমনকি তার গোড়ালির ওপরের ঘা, টেলিস্ক্রিনের বাজনা আর জিনের মদিরায় সামান্য বুঁদ হয়ে থাকার ভাবটুকুও।

৩য় কিস্তির লিংক




বাংলাদেশ সময়: ১২১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।