ওগো নিমপাতা
সবগুলা ব্যাঙ একটানা
অনেকক্ষণ ডাকে।
তারপর একটু বিরতি দিয়ে
আবার ডাকে।
গ্যা গোঁ ঘাৎ ঘোৎ ...
গ্যা গোঁ ঘাৎ ঘোৎ ...
আর বিরতির সময়ে
চিঁচিঁ চিঁ কুকরু কুকরু কুকরু...
বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই
একঘেয়ে ধ্বনিতে কান পেতে রাখা ছাড়া
আর কোনও অন্যতর বিবাহের সম্ভাবনা নাই।
জানালার পাশের নিমগাছের ফাঁক দিয়ে যে
চিরকালীন চাঁদ উঁকি মারতেছে,
তারও কোনও অন্যতর মোচড়ের উন্মাদনা নাই।
পাশে বউবাচ্চার মুখ।
আমি ভাবি, মানুষ এত নীরবে ঘুমায়!
গুড়ুম গুড়ুম করে মেঘ ডেকে ওঠে।
হঠাৎ বৃষ্টির ছন্দে
টিনের চাল যেন
নাচতে লাগে অন্ধকারে।
জীবনের পিছনে যতগুলা বছর ফেলে আসছি,
সামনে কি ততদিন আছে আর, ওগো নিমপাতা!
১৫-৭-২০১৩
নাসিমা খালা
তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি।
আব্বা আমাদেরকে রামধন থেকে
নিয়ে গেলেন তার চাকরীস্থল
দিনাজপুরের বীরগঞ্জে।
সেইখানের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।
নাসিমা খালার সাথে স্কুলে যাই।
বাসা থেকে খুব দূরে নয়।
ফেরার পরে তাদের বাসার সামনের
ফুলবাগানের বাঁশের ঘেরার উপরে
ফড়িঙ ধরি।
আমি তো ফড়িঙ ধরি যেভাবে,
সেইরকম গুপ্তপায়ে একদিন
পিছন থেকে এসে নাসিমা খালা
দুইহাতে আমার চোখ চেপে ধরল।
সেই হাত কেন রে মলিন হয় না, মন?
তার ঘরে গিয়া দেখি,
গান বাজে কিন্তু যন্ত্র নাই!
আমি নাসিমা খালাকে বলি,
গান কোত্থেকে বাজে!
সে বলে, বলো দেখি কোত্থেকে বাজে?
আমি খুঁজে পাইনা।
গানের ক্যাসেট কোথায় যেন
গোপন করে রাখা!
এরপর নাসিমা খালা আমাকে দুধ খাইতে দেয়।
তাদের গ্রামের বাড়িতে দুধের খামার আছে।
সেখান থেকে প্রতিদিন
তাদের বাসায় দুধ আসে।
১৩-৭-২০১৩
দাদার সঙ্গে
বিলের এপারে আমাদের বাড়ি
অইপারে ছিল এক ডাক্তারের বাড়ি।
হোমিও ডাক্তার।
মাসে একবার করে ইঞ্জেকশন দিতে
নিয়ে যাওয়া হইত আমাকে
সেই ডাক্তারের কাছে।
আমার দাদা খায়রুজ্জামান বখশীর
হাত ধরে অইপারের অই কালো গ্রামে যাইতে
আমার কত সময় লাগত,
আজ আর সেটা মনে নাই।
স্মৃতি ঝাঁপসা হয়ে গেছে।
ঝাঁপসা স্মৃতির গভীরে ছিপ ফেলে
আমি আর তেমন
কিছুই তুলে আনতে পারি না।
দাদার কণ্ঠও আমি চিনতে পারি না।
বিড়বিড় করে মনে পড়ে দাদা বলতেছেন,
‘যত মানুষ যাইবে দেখিস
সবাই আমাক সালাম দিবে’।
আমার তো বিশ্বাস হয় না। এহ!
পৃথিবীর সব মানুষ দাদাকে চেনে নাকি!
কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাইতাম।
পৃথিবীর সব মানুষই পার হওয়ার কালে
দাদাকে সালাম দিত!
পৃথিবীটা তো আগে অনেক বড় ছিল!
এখন কত ছোট হয়ে গেছে!
১০-৭-২০১৩
খয়বারের বউয়ের কালো মুরগি
বর্ষায় আদিগন্ত বিল
আর অন্য সময় অবারিত প্রান্তর, ধানক্ষেত।
এর পশ্চিমপাড়ের গ্রাম।
দুপুরে গাবের গাছের তলের টং-এর উপরে শুয়ে
বাতাসের আদরে নিশ্চিন্তে ঘুমায়া পড়া যায়।
উপরে আকাশে উড়িতেছে হায় চিল।
হায় চিলের ভয়ে চিৎকার করতে করতে
দশ-বারোটা বাচ্চা নিয়া দৌড়ে
বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে
খয়বারের বউয়ের কালো মুরগিটা।
কলের পাড়ের বেড়ার নিচ দিয়া
হঠাৎ সেই ধোমড়া গুইসাপটা বা’র হয়ে
একটা পোনে-তিনদিনের বাচ্চা মুখে নিয়া
সরসর করে ঢুকে গেল বাঁশঝাড়ের ভিতরে।
খয়বারের বউয়ের গজরগজর আর থামতেছে না।
রাগ তার গুইসাপের উপরে
খয়বারের উপরে
নাকি আল্লাহর উপরে
বোঝা যাইতেছে না।
৩-৭-২০১৩
ছোট্ট আঙুল
তুনির বয়স চার বছর।
বাইরে ছোট ছোট শাদা বেগুনি
ফুল ফুটে আছে।
ফুলে ফুলে মৌমাছিরা
মধু সংগ্রহ করতেছে।
তাদের গুঞ্জরণে মুখর পৃথিবী!
‘আম্মুমা, চলো চলো ফুল দেখতে যাই’
বলে আমি তুনিকে বাইরে নিয়ে আসি।
আমার তর্জনী ধরে গুটিগুটি পায়ে সে হাঁটে।
বলি, মৌমাছি ধরবা?
সে ধরতে চায়!
কিন্তু ধরতে তো পারে না!
অনেক কায়দা করে
একটা মৌমাছি ধরে দিলাম তাকে।
সঙ্গেসঙ্গে বসায়া দিল হুল!
ছোট্ট তুলতুলে নরম আঙুল
লাল হয়ে ফুলে উঠল ব্যথায়!
আমি জানতাম, মৌমাছি হুল ফোটাবেই।
শৈশবে শাদাফুলের কুসুম থেকে
হুলবিদ্ধ না হয়ে মৌমাছিকে কব্জা করা ছিল
আমার নানার বাড়ি যাওয়ার কালের
পথের ধারের খেলা!
এই খেলা খেলতে গিয়া
আমি কতদিন মৌমাছির কামড় খাইছি!
ছোট্ট আঙুল ব্যথায় টনটন করছে!
২-৭-২০১৩
বাংলােদশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৫