ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লঙ্কার রাবণ | শরীফ শামিল

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৫
লঙ্কার রাবণ | শরীফ শামিল

রাজ্যের প্রতিটি মোড়ে রাজার প্রতিকৃতি টাঙানো থাকে। ধুলো ময়লায় মলিন হবার পূর্বেই প্রতিকৃতিতে নতুন রঙ মিশিয়ে নতুন বৈশিষ্ট্য ও মসৃণ আদল দেয়া হয়।

প্রজাদের চোখে পৃথিবীর জঘন্যতম প্রতিকৃতি এটা, আরো খারাপ ব্যাপার যেটা তাদের কাছে, সেটা হলো রাজার চোখে থাকা জন্মসূত্রে পাওয়া ঔদ্ধত্য। রাজার এই ছবি জনগণের শারীরিক প্রতিক্রিয়াকে উসকে দিতে থাকে। আর অনেক প্রজা পথচলার সময় মুখ ঘুরিয়ে হাঁটে কিন্তু বেঢপ প্রতিকৃতিটাকে মনে মনে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়।

রাজপথের ১০০টি মোড়ে ও প্রতিটি জেলা এবং থানার মোড়ে মোড়ে সাইনবোর্ডে বড়বড় হরফগুলো (রাজ নোটিশ) ঝুলে থাকে:

ক. এ রাজ্যের রাজা—প্রজাহিতৈষী।
খ. প্রাকৃতিক দুর্যোগও বহিঃ শত্রুর আক্রমণ থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে রাজা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তথা প্রজাদের জান মালের নিরাপত্তা বিধানেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
গ. প্রজাদের অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে (রাজ) আইন কানুনের প্রতি।
ঘ. রাজস্ব (কর) যথাসময়ে প্রদান করতে হবে।
ঙ. রাজদ্রোহ ও রাজবিদ্বেষ ছড়ানো বড় অধর্ম, রাজসেবাই প্রজাদের বড় ধর্ম।
চ. রাজদ্রোহীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

রোদ বৃষ্টি আর ধুলোয়, পুরনো মলিন হয়ে যাবার পূর্বেই আবার নতুন করে লিখে—চিরকাল জিঁইয়ে রাখা হয় নোটিশগুলো। বৎসারান্তে নোটিশবাহী সেপাইরা ঘোড়ায় চেপে পাড়া-গাঁ-গ্রামেও যায়, নোটিশ টাঙে আর তদারকি করে থাকে।

এদিকে রাজদ্রোহের শাস্তির কথা ভেবে দ্রোহ চাপা থাকে না। প্রজাগণ সমালোচনা করে: ১. রাজা প্রজাবিদ্বেষী, ব্যভিচারী ও অত্যাচারী। ২. এ রাজ্যে জানমালের নিরাপত্তা নেই। ৩. রাজা বিদেশী প্রভুদের তোষণ করে আর দেশি প্রজাদের শোষণ করে। ৪. রাজ্যের আইনকানুন রাজার স্বরচিত। ৫. রাজ কর আদায় করা হয় দ্বিগুণ এবং তা জোর জবরদস্তিমূলক। ৬. রাজ্যের (প্রায়) প্রতিটি রাস্তাঘাট কঙ্কালের মতো। ৭. রাজার পতন হোক দ্রুত। ৮. প্রজাদের ক্রোধ রূপান্তরিত হোক শক্তিতে...

চতুর্দিকে ইশারা-ইঙ্গিতেও একই মতের কথা চলতে থাকল। পরিত্রাণই এখন বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ালো; আর বিদ্রোহের মাঝেই তাদের অস্তিত্ব নিহিত। অবশ্য অতীত বিদ্রোহের অজস্র দৃষ্টান্তের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা তাদের কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে দিতে চায়...

ছয় ঋতুর এই রাজ্যটি হঠাৎ করে তিনটি ঋতুতে থিতু হয়ে গেল। বিশ্বে কোথায় যেন একটি ষড়ঋতুর দেশ আছে বা ছিল, স্মৃতি হাতড়িয়ে স্মরণ করতে পারে না প্রজাগণ।

এ সবই রাজার পাপ আর পাপের ফল। প্রজাগণ করে বিষোদগার। জাতীয় উৎসব তেমন জাঁকালোভাবে পালিত হয় না। এ রাজ্যে নববর্ষ, ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব পালন করে প্রজারা নির্বিকারভাবে। অসুখী প্রজাগণ উৎসবপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। রাজার হ্যাজাকবাতি ঘিরে পোকারা উৎসব পালন করে যায় শুধু।

সেদিন। নববর্ষ পালনের রাত্রিতে, রাজসেনারা যখন অত্যধিক মদ্যপী হয়ে ওঠে, তখন নিয়মিত টহল তাদের হয়ে পড়ে বিশৃঙ্খল। হ্যাজাকবাতিগুলো নিভে গেল। আর ৫ জন যুবক জোনাকি হয়ে গেল। মোক্ষম এই রাতেই যুবকরা রাজ্যের প্রধান সড়কের মুখে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিল:

ক. রাজার দুর্নীতি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধাচারণ করা অধর্ম নয়।
খ. কৃষকপুত্রের মাথাতেও শোভা পেতে পারে রাজমুকুট।
গ. মালিনী পুত্রকেও ভালোবাসতে পারে, এ রাজ্যের সুন্দরী রাজকন্যা সুস্মী।
ঘ. মুখ্যমন্ত্রী তনয়ও অর্ধাঙ্গিনীর মর্যাদা দিতে পারে একজন কুলি কন্যাকে।
ঙ. রাজার দুঃশাসনের দিন শেষ।
চ. প্রজাদের ক্রোধ পরিণত হয়েছে সাহস ও শক্তিতে।

প্রজাদের স্বাধীন কথার বুলি ফুটলো যেন এভাবেই। হুলস্থূল পড়ে গেল রাজ্যময়। রাজা তার সৈন্যদের বকা দিয়ে, বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দিলেন: ‘প্রার্থনার সাথে সাথেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। ’

রাজসভা বসল এবং চলল সারাদিন। নানারকম আলোচনায় রাজকার্যালয় গমগম করতে থাকল। সবশেষে বিদ্রোহের হোতা ৫ জন যুবককে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিলেন রাজা।

প্রজাদের মাঝেও পড়ে গেছে সাড়া। বিদ্রোহীবাণী সম্বলিত সাইনবোর্ড প্রত্যেকের হাতে হাতে শোভা পেতে থাকল। মূল ৫ বিদ্রোহীর একটি বাণীই যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হতে থাকল গোটারাজ্যে। রাজ্যের প্রধান সড়কের ধারে একজন মালি থাকে। তার যুবকপুত্র ‘অকিল’ লিখে ফেলল তার খাতায় একটি লাইন: ‘সুস্মী, তোমার বুকের পাঁজরে হাত দিয়ে দেখো, তোমার হৃদয়ের স্বাভাবিক অনুপাত; সুস্মী আমি তোমার হৃদয়ের মানুষ হতে চাই, ইতি মালিপুত্র ‘অকিল’।

অকিলের বাক্যটি খাতায় এঁকেবেঁকে যেতে থাকল; অক্ষরগুলো সর্পিলাকারে উপরের দিকে উঠতে শুরু করল এবং একটি সাপে পরিণত হলো। সাপ ছুটতে শুরু করল রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে।

রাজকন্যা সুস্মী তার ঘরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিল। একটি গোলাপ বর্ণের বাক্য ফুটে উঠল রাজকন্যার বাম হাতে: এ এক আশ্চর্য সর্পিল অলঙ্করণ! মুগ্ধ হলো সুস্মী। বাক্যটি পড়ে ঠোঁটে হাসির ফোয়ারা ছুটলো তার। পরক্ষণেই ভীত হয়ে ওঠে সুস্মী। সাপে কাটলে জ্বালা ধরে নাকি। ছোটকালের কথা স্মরণ হলো, একটা রাজ আত্মীয় মারা গেছিল সাপের ছোবলে। সুস্মীও কি মারা যাবে? দংশিত স্থানে হাত বোলায় সে। আশ্চর্য! কোনো জ্বালা যন্ত্রণা নেই তো! দংশিত স্থান থেকে অক্ষরগুলো আকার পেয়ে গেছে...

প্রজাদের জীবন-জীবিকা ও জীবনাচার সম্বন্ধে পূর্ণ ওয়াকিবহাল না হলেও সে দাস-দাসী মারফত জেনেছে, এমনকি নিজেও দু’একদিন পথের ধারে দেখেছে; সাপুড়ে কর্তৃক সাপেরা খেলে, কিন্তু এ কেমন সাপের খেলা। কোন সাপুড়ে নেপথ্য থেকে খেলাচ্ছে সাপকে? দংশিত স্থান পুনরায় পরখ করে দেখে সুস্মী (সর্পিল অলঙ্করণ ট্যাটু হয়ে গেছে)! তার ভেতরে একটা ইচ্ছাশক্তি জেগে উঠছে, ভালোবাসার ইচ্ছা। অবাক হয়ে শুনছে, ভেতরে তার বাজছে প্রেমের আবহ সংগীত।

সুস্মী একটা প্যাড টেনে হাতে কলম নিল। প্রথমে ছন্দ মিলালো দু’লাইন: ধন নয়, মান নয়, ধরণীর এক কোণে এতটুকু বাসা, করছি আশা, নিচে লিখল, অকিল প্রিয়তম আমার হৃদয়ের মানুষ আমার—তোমার প্রেমবাক্য শুধু আমার শরীরেই দাগ কাটেনি হৃদয়েও কেটেছে। শিগগিরই দেখা হবে আমাদের আর সেদিনই প্রমাণিত হবে, তোমার আমার হৃদয়ের অনুপাত একই সমান...

নদীর ধারের কাছে এক কুঁড়ে ঘর থেকে এক কুলি কন্যা (কুসুমী) লিখল মুখ্যমন্ত্রীপুত্র বাবনের উদ্দেশ্যে: প্রিয়তম আমার, প্রেমের নাছোড় দাবি আছে একটা, সেই দাবিটি কি তুমি পূরণ করবে? সুখী করতে পারবে কি এই দ্বীন-দুঃখিনীকে? ইতি কুলিকন্যা কুসুমী।

কুসুমীর বাক্যটিও পরিণত হলো সাপে এবং ছুটতে শুরু করল। মুখ্যমন্ত্রীপুত্র বাবন অবাক হয়ে দেখল, সাপটি তার বাম হাতে কামড়ে, প্রস্থান করছে এঁকে বেঁকে দরজার চৌকাঠ দিয়ে। তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে। ছোটকালে একটা চিওড় তার ডান হাতের তালুতে কামড়ে দিয়েছিল আর তারই জ্বালায় সে অস্থির হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এ কেমন সাপ। যার দংশনে একটুকুও জ্বালা নেই!

হঠাৎ একটা যন্ত্রণা অনুভব করল বাবন। সেটা মিষ্টি যন্ত্রণা। প্রেমের যন্ত্রণা। কুসুমী প্রেরিত যে বাক্যটি তার বাম হাতে ফুটে উঠেছে সেটি পড়ল বারবার। আর হৃদয়ের কিনারে তার আছড়ে পড়ছে ভালোবাসার অসংখ্য ঢেউ। ঢেউগুলো ভাঙছে কিন্তু ভালোবাসা জমাট হচ্ছে কঠিন শিলার মতো... বাবন বেরিয়ে পড়ল বাইরে।

ওদিকে অকিলের উদ্দেশ্যে (ছদ্মবেশ নিয়ে) পথে নেমেছে সুস্মী। পথের ধারে এবং বনের ধারে যত গাছ আছে, সবগাছেই ফুল ফুটতে শুরু করল হঠাৎ একসঙ্গেই। অনেকদিন হয় এ রাজ্যে ফুল ফোটেনি। প্রকৃতিতে যৌবন এল আজ। সুস্মীর হাসি আর ফুলেদের সম্মিলিত হাসিতে ঝলমলিয়ে উঠল চতুর্দিক।

অকিলের ভাঙা বাড়ি ঘিরে ভিড় জমে গেল রীতিমত। আকাশের চাঁদ মাটির সাথে মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে দেখে যারপরনাই খুশি হলো প্রজাগণ। রাজকন্যা পথে নেমেছে। তাই ফুল ফুটেছে, প্রজারা বাসন্তী উল্লাস প্রকাশ করল—রাজকন্যাকে বসন্তরানী আখ্যা দিয়ে এবং তার চলার পথে ফুল বিছিয়ে অভিবাদন জানালো তারা। প্রজাদের এই প্রকাশ ভঙ্গি দেখে অভিভূত হলো সুস্মী আর ডান হাতে ধরে রাখল অকিলের বামহাত। ভালোবাসার অপরাধে রাজদণ্ড দেয়া হয়েছিল পূর্বে, এমন করে একজন প্রজা ভালোবেসেছিল রাজপুরীর এক মেয়েকে। সে কথা স্মরণ করে প্রজাগণ সতর্ক হলো।

কোনো প্রকার হুমকি-ধমকি ছাড়াই খুন হতে পারে অকিল। অকিলকে রাজরোষ থেকে বাঁচাতে তৎপর হলো প্রজাগণই। রাজ গোয়েন্দাদের দৃষ্টি এড়িয়ে পাহারা দিতে থাকল; যখন তখন শত্রু (রাজ) সেনারা ঢুকে পড়তে পারে তাদের গ্রামে। কাজেই সাবধানতা অবলম্বন ও পাহারা জোরদার করল তারা।

এদিকে সাপেদের দংশন অভিযান চলতে থাকল। রাজ্যের প্রতিটি পুরুষের (যুবক) শরীরে কামড় দিল তারা। তৎক্ষনাৎ (৫ জন বিদ্রোহীর লেখা) সাইনবোর্ডের বাক্যগুলো ফুটে উঠল তাদের গায়ের চামড়ায়। অকিলের ছায়াতলে একতাবদ্ধ হলো তারা।

অকিল কেন যেন ভয় পেল—প্রজাদের এই রাজরোষ প্রত্যক্ষ করে কিন্তু সুস্মী অকিলের এই ভয়কেই-ভয় দেখালো। তবু গাঁইগুই করছিল অকিল। আইস্টাইনের মতো তারও বলতে ইচ্ছা করছিল আমার কাছে সমীকরণের গুরুত্ব বেশি। কারণ রাজনীতি শুধু বর্তমানের জন্য কিন্তু সমীকরণ চিরকালের জন্য।
তবে নেতা হলো অকিল, মানে হতেই হলো। আর নেতার মতোই বক্তব্য দিল সে: মনে রাখুন সবাই, আমরা একজন শক্তিশালী রাজার প্রতিপক্ষ। আমাদের ৫ জন বিদ্রোহী বন্দি হয়ে আছে ভেতরে আর আমরা বন্দি হয়ে আছি বাইরে। বর্তমানের এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গোটা রাজ্যে যে একটা প্রত্যাশা জেগে উঠেছে তাতে উদ্বেগও আছে। যুদ্ধে জয়-পরাজয় থাকে। জয়ী হলে কী করণীয় আর পরাজিত হলে করণীয়টা কী? তবে গণজোয়ারে রাজা এবার ভেসে যাবে খড়কুটোর মতো, এই আশাবাদ ব্যক্ত করে, সকলকে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বার আহ্বান জানাচ্ছি।

অকিলের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে আর রাজা নিপাত যাক বলতে বলতে সকলে নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। যেতে যেতে আলোড়িত হতে থাকল তাদের দেহ মন মস্তিষ্ক।

ওদিকে সাপ-আতংক ছড়িয়ে পড়ল রাজ সেনাদের মধ্যেও। দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ল তারা। অনেক সেনা চাকরিতে ইস্তফা দিল। সৈন্যদের বেতন-ভাতা তিনগুন বৃদ্ধি করলেন রাজা। অবশিষ্ট সৈন্যগণ অস্ত্র উচিঁয়ে সাপ-পাহারায় নিযুক্ত থাকল। তাদের চোখে সাপগুলো দৃশ্যমান হয় মাত্র এক পলক। মুহূর্তেই গায়েব হয়ে যায়। অস্ত্র তাক করবার সুযোগই হয় না এবং সমস্যা হলো যে, সাপেরা মানুষের রক্তের টানে আসে না। মানুষের ক্লান্তি আছে আর সাপেরা নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারে। মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর, ঘর-বাড়ি, প্রজাদের দেউড়ি ও আঙিনাতে রাজা তাঁর পদাতিক সৈন্যদেরকে প্রেরণ করলেন। সেনারা কোনো খানচিতেও তেরছা দৃষ্টি বোলায়। পুরনো দেয়ালের শরীর থেকে খুলে পড়া ক্যালেন্ডার কিংবা কোনো পোস্টার ঝুলতে দেখলে সাপের খোলস ভেবে অস্ত্র তাক করে সৈন্যগণ। গাঁয়ের সামনে ন্যাড়াগাছ পরিবেষ্টিত কায়েক বিঘত ফাঁকা জমি, তারই পাশে কয়েকটা পরিত্যক্ত বাড়ি। ঐ বাড়ির খসে পড়া কয়েকটি দরজা ও কবাটগুলো অবাক চোখে দেখতে থাকল সৈন্যদের কীর্তিকলাপ।

সেদিন সন্ধ্যার পর রাজ্যে সান্ধ্য আইন জারি হয়ে গেল। আকাশের পূর্বকোণে ফল্স বিদ্যুৎ আর ফল্স মেঘ ডাকছিল। এই বিদ্যুৎ ও মেঘের পথরেখা দেখে প্রজারা নির্ণয় করতে পারে যে, বিজলি তুফান বায়ু ঘূর্ণন কিংবা সামান্য দু’ফোঁটা বৃষ্টিও আসবে না। মেঘ ও বিদ্যুতের এই ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করল প্রজারা।

ক্রমেই রাজ্যে আইন শৃংখলা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে থাকল। প্রজাদের বাড়িতে সাপের পাহারা দিতে গিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল সৈন্যরা—প্রজাদের সাথেই। অনেক সৈন্য প্রজাদের সাথে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানালো। কেউ কেউ গোপনে কেটে পড়ল। বিস্ময়কর ক্ষিপ্রতার সাথে অস্ত্র হাতে একদিন রাজা নিজেই নেমে পড়লেন বাকি সৈন্যদের সাথে।

কথিত সাপ খুঁজতে খুঁজতে একসময় এসে পড়লেন কয়েদখানায়। তখন রাজাকে দেখে মনে হচ্ছিল দীর্ঘ এক সফর শেষ করে এলেন। সেই পাঁচজন বন্দির মুখোমুখি হলেন তিনি। দু’পক্ষই নিশ্চুপ। শুধু তাকাচ্ছেন পরস্পরের দিকে। মনে হচ্ছে তারা একই মনস্তাপে পুড়ছেন।

রাজা হয়ে পড়লেন অতীতচারী; এই বন্দিদের পিতামহরা কিভাবে রাজসেবা করেছে। ঘোড়ায় চড়ে, রাজা চাবুকের শাসন দেখিয়েছেন, প্রজাগণ কিভাবে দ্রুত সরে যেত সামনে থেকে... রাজার মনে দার্শনিক চিন্তা খেলে যায়; সময় (কাল) এক আশ্চর্য জিনিস। সময় তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে কী খেলায় না খেলে যায়। আর মানুষকে বাধ্য করে সে কালের বিন্যাসের অদল-বদলকে মেনে নিতে। আর খুব দৃঢ়ভাবেই কাল (সময়) খুলে দিতে চাইছে তার আরেকটা কিস্তি। এই কালেই নাকি ইশ্বরের অবস্থান। বন্দিরা তখন ভাবছে; রাজ্যময় কী কী ঘটছে এখন? রাজা কি এখন তাদের মুক্তি দেবেন? নাকি রাজার বন্দুক থেকে গর্জে উঠবে পাঁচটি গুলি। পরক্ষণেই তাদের মনে পড়ল, মহান এক বিপ্লবীর কথা: ‘আমার মৃত্যু প্রমাণ করে না যে, আমি পরাজিত হয়েছি। ’

রাজার নির্দেশে একজন প্রহরী নিয়ে আসলো একটি সাদা হার্ডবোর্ড ও মার্কার কলম। রাজা একটা লিখিত কাগজ বের করে একজন বন্দির হাতে দিলেন। রাজার ইঙ্গিতে যে আদেশ আছে, সে আদেশ পালন করল বন্দিটি। বাকি চারজনকে পড়তে দিল। কাগজে লেখা বাক্যগুলো পড়ল তারা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে এবং না বোধক মাথা ঝাঁকালো। আর কাগজটাকে ঠোঁঙা বানালো তারা। রাজার মুখ তখন রক্তচাপে যেন পীড়িত দেখাচ্ছিল।

রাজা বন্দুক তাক করলেন এবং অবাক হয়ে শুনলেন, বন্দিদের মুখের হিস হিস শব্দ। সম্মিলিত হিস হিস শব্দ যেন সইতে পারছিলেন না রাজা। পরদিন পাঁচ বন্দিকে পৃথক পৃথক কারাগারে পাঠালেন। এভাবেই রাজা তাদের ঐক্য নষ্ট করতে চাইলেন যেন। কিভাবে এদের মাঝে ভাঙন ধরানো যায়? দুঃখের বিষয়, বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা নেই রাজ্যে। নইলে একদলকে দিয়ে উস্কানি দেয়া যেত অন্যদলগুলোকে।

রাজদরবারে উপস্থিত পরিষদবর্গের মধ্যে আজ আছে রাজ জ্যোতিষি ও রাজ্যের প্রধান গণক। তপ-জপ শেষে জ্যোতিষি ও গণক দুজনেই একসাথে ঘোষণা করলো: রাজা এই উদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন, যদি রাজা ও মুখ্যমন্ত্রী তাদের প্রিয় পাত্রকে বলি দিতে পারেন। আর সেই বলির রক্তে নিজ পা রাঙাতে পারেন। কঠিন শর্ত। কিন্তু তার চেয়েও কঠিন বর্তমান সময়। রাজার চোখের সামনে তার প্রিয় কন্যা সুস্মীর মুখ ভেসে উঠল আর মুখ্যমন্ত্রীও একমাত্র পুত্র বাবনের চেহারাটা দেখতে পেলেন চোখের সামনে। রাজা ও মুখ্যমন্ত্রী দৃষ্টি বিনিময় করলেন। এত্তেলা পাঠানো হলো অন্দরে। পরক্ষণেই খবর এলো: গতরাত থেকে রাজকন্যা সুস্মী ও মুখ্যমন্ত্রীপুত্র বাবনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না...

খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল রাজ্যময়। রাজা-মন্ত্রীর যাবতীয় দপ্তর প্রধান ও দেহরক্ষীরা ঝিম মেরে থাকল।

এখন থেকে পরবর্তী করণীয় বিষয় নিয়ে নিভৃতে আলোচনা করতে থাকলেন রাজা ও মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের প্রতি ইঞ্চি মাটি কণা তাদের পরিচিত অথচ আজ... মুখ্যমন্ত্রী দোষ দিচ্ছেন রাজার (স্বৈর) বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে গেছে। অনুরূপভাবে রাজাও দোষ চাপাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রীর ওপর...

রাজ্যের চারপাশকে ঘিরে থাকছে উত্তেজনা এবং আতঙ্ক। কখন কী ঘটে যায় বলা মুশকিল। একটি নতুন দিন দেখতে চাইছেন রাজা কিন্তু (প্রতিটাদিন) আগের দিনেরই পুনরাবৃত্তি। রাজার সহজ-কঠিন কৃত কৌশলগুলো ব্যর্থ হলো। প্রয়োজনীয় সামর্থও ফুরালো। ভরাডুবি চূড়ান্ত হতে আর দেরি নেই। প্রজাদের ক্রুদ্ধস্বর ও ধাবমান পদশব্দ হাওয়ায় ভেসে এলো রাজার কানে। ‘রাজ বন্দিদের মুক্তি দাও, রাজা এবার সিংহাসন ছাড়ো। ’ লক্ষ কোটি প্রজার মিছিলের প্রথম সারিতে একটি ছেলে সবার দৃষ্টি কাড়ল। রোগা পটকা একটি ছেলে। যাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে হাড়-হাড্ডি দিয়ে তৈরি। ছেলেটা তার হাতটা উর্ধ্বে ওঠালে, একটা শব্দ হয়তো এখনো শোনা যাবে: হাড়ের ঘণ্টির শব্দ...

প্রজারা সৈন্য নয় কিন্তু সেনাসদৃশ অসংখ্য সেনারা যেন ধেয়ে আসছে হিস হিস শব্দ তুলে। এই শব্দকেই ভয় পাচ্ছেন রাজা। চরম এই পরিস্থিতিতে চরম উপস্থিতি আরেকটা আছে; মিছিলের অগ্রভাগে দেখা যাচ্ছে: বাবনের ডান হাত। ঊর্ধ্বমুখি আর বাম হাত বেষ্টন করে আছে কুসুমীর ডান হাতকে। পাশাপাশি সুস্মীর বামহাতও ঊর্ধ্বে ওঠানো। ডান হাতটা তার অকিলের হাত পেঁচিয়ে ধরা। রাজা ঢোক গিললেন।

স্রোতের মতো মানুষ ধেয়ে আসছে। খরা একেবারেই মানুষকে মেরে ফেলে না। কিন্তু বিপুল বন্যা একেবারেই ডুবিয়ে মারে। এতদিন রাজা (বিদেশি যুদ্ধেও) পেয়ে এসেছেন ঐশ্বরিক অনুগ্রহ; আজ (দেশি) এই যুদ্ধে ঈশ্বরের কৃপানলে পতিত হয়েছেন। আজকের বিশেষ ঈশ্বর পূজা কাজে লাগছে না রাজার। ব্রজশব্দের পটভূমিতে জন-দৃশ্যের মাঝখানে ঘুরতে থাকল রাজার দৃষ্টি, রাজার নিয়তি ও চূড়ান্ত পরিণতি। রাজাবাড়ি ৩য়, ৪র্থ, ৫ম তলার বারান্দা থেকে অসংখ্য দাস-দাসী কর্মচারী দেখছিল অপূর্ব দৃশ্যটা। আর শুনছিল মাটি থেকে অবিশ্রাম উঠে আসা গুম গুম এবং হিস হিস শব্দ। একটা উত্তপ্ত হাওয়া আর হিস হিস ধ্বনি রাজবাড়ির দিকে ছুটে আসছে দ্রুত গতিতে।

রাজসৈন্যদের হুকুম দিলেন রাজা। সৈন্যদের বন্দুক থেকে গুলি বেরুনোর আগে রাজার দুর্ভাবনায় ছুটে যেতে থাকল। দূর-নিয়ন্ত্রক বোমার বোতাম টিপে কাজ হচ্ছে না; সৈন্যদের বন্দুক থেকে বুলেট বেরুচ্ছে না। সৈন্যদের হাত সৈন্যদেরই হুকুম তামিল করছে না। হিস-হিস ধ্বনি শুনে, এবার সৈন্যরাও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল; অনেকের হাত থেকে খসে পড়ল অস্ত্র। রাজবাড়ির শতাব্দি জোড়া উচ্চতা ক্রমেই খাটো হতে থাকল।

ভূগর্ভস্থ একটি ঘরে পুষে রেখেছেন রাজা একটা দৈত্যকে। রাজা ঢুকলেন সেখানে। দৈত্যটা রাজার ইচ্ছেমতো কাজ করত। রাজার নির্দেশে বিশেষ বিশেষ মানুষকে ভক্ষণ করত সে। আর একনাগাড়ে ঘুমাত তিন মাস। এখন তার ঘুমের বয়স ২ মাস। দৈত্যটার ঘুম ভাঙানোর মন্ত্রটাই ভুলে বসেছেন রাজা। এ ফাঁকেই ঘটে গেল দুর্ঘটনা। এই ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়ালেন রাজা। নিজকে দেখেন ১, ২, ৩ যথাক্রমে ১০ জন রূপে। রাজা একই সাথে অনেকজন। বস্তুত রাজা কেউ একজন নন। এমনই মনে হচ্ছে রাজার।

প্রজাদের হাতে রাজার মৃত্যু হলে রাজসিংহাসন খালি পড়ে থাকল। রাজার মৃত্যুর পর তাঁর একাধিক পুত্র থাকলে (অবশ্য রাজার পুত্র নেই) রাজসিংহাসন নিষ্কণ্টক থাকে না (একজন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত পুত্রের জন্য) তেমন একাধিক রাজকন্যা থাকলেও সেরকম আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু সুস্মীর বোনেরা (বোন জামাইরাও) মেনে নিল সুস্মী তথা অকিলকে। আর প্রজাদের পূর্ব ঘোষিত রাজা তো অকিলই।

জীবদ্দশায় রাজারা নানারকম জোর জবরদস্তি করে থাকেন কিন্তু মরণকালে আরেকটি জোর খাটিয়ে যান। তাদের দেহকে সমাধিস্থ করা হয় কিন্তু আত্মাকে সমাধিস্থ করা যায় না। এই রাজ বংশের প্রতিটি রাজার আত্মা রাজদিঘিতে এসে আশ্রয় নেয়। প্রতি অমাবস্যায় গভীররাতে আত্মাগুলো চিৎকার চেঁচামেচি করে থাকে। দিঘির পাশেই রাজগৃহ। গৃহের ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে জোরসে একটা বাতাস ঢোকে প্রতি অমাবস্যার রাতে।

অকিল রাজা ঘুমিয়ে থাকে। এক অমাবস্যার রাতে তার ঘরে প্রবেশ করে শ্বশুরের আত্মা। অকিলকে জাগায় এবং বলতে থাকে: ভূ-গর্ভস্থ ঘরে ঘুমিয়ে থাকা দৈত্যটার কথা। যে দৈত্য শুধু রাজ-আজ্ঞা পালন করে থাকে। রাজ-শত্রুদের চিবিয়ে খায়। অকিল অবাক হয়। শ্বশুর আবার বলে ওঠে: দৈত্যতার ঘুম ভাঙানি মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। শুধু সময়ের হিসেবটা কষতে হবে সঠিকভাবে। কাল (সময়) আমার প্রতিকূলে চলে গেছিল।

তুমি রাজপুত্র না হও, রাজ-জামাতো তো। তোমার অতীত ভুলে যাও এখন থেকে। রাজসিংহাসনে বসলে, রাজাই হতে হয়।

সর্বত্র (গণসংগীতের মতো) গানটা বাজে; গান গায় প্রজারা হাসিমুখে: ‘আমরা সবাই রাজা, এই রাজার রাজত্বে’ পূর্বে গানটি অকিলের কানে সুধা বর্ষণ করত। উদ্দীপনা জাগাতো প্রাণে। এখন গানটার সেই আবেদন নেই তার কাছে। বরং গানটা শুনে, সে অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করে; মাথার চুলে ঘনঘন আঙুল চালায়। গানটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যায় কি-না, তাও ভাবে মনে-মনে। অকিল প্রথমে ছিল রাজার মতো, এখন ‘রাজা’ হয়ে গেল। শুরু হয় রাজ্য শাসন। দিঘি থেকে উঠে আসা (পাক খাওয়া) বাতাসটা প্রতি অমাবস্যায় তার ঘরে ঢুকতে থাকে জোরসেই।

[এখন থেকে অকিল রাজার গল্প শুনবে জনগণ, অন্য কোনো গল্পকারের কাছ থেকে]



বাংলাদেশ সময়: ১৪৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।