ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

জাগো বাহে কোনঠে সবায় (শেষ পর্ব)

ফরিদ আহমেদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৫
জাগো বাহে কোনঠে সবায় (শেষ পর্ব)

শকুনে ছাওয়া শ্মশান ভূমি
দেবী সিংহের বাড়ি ছিলো পশ্চিম ভারতের পানিপথের কাছাকাছি এক গ্রামে। তিনি বৈশ্য সম্প্রদায়ের লোক।

এই ব্যক্তি ব্যবসা উপলক্ষে ভাগ্যান্বেষণে মুর্শিদাবাদ এসে উপস্থিত হন।

মুর্শিদাবাদ তখন গৌরবপ্রভায় মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লিকে লজ্জা দিতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যে সারা ভারতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে আসীন।

ইউরোপীয় এবং দেশীয় বণিক দিয়ে মুর্শিদাবাদ পরিপূর্ণ। বাণিজ্যের স্রোত তীব্রবেগে বয়ে চলেছে মুর্শিদাবাদের মাঝখান দিয়ে। এই স্রোতেই নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দেবী সিংহ নিজেকে। ভাসালেনও নিজেকে তিনি, কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না। ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে না পেরে ক্রমে ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়লেন তিনি। এই অবস্থায় ব্যবসায়ের আশা ত্যাগ করে কাজের চেষ্টায় ঘুরতে লাগলেন তিনি।

বাংলার ভাগ্যবিধাতা তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা। তাদের শোষণযন্ত্রকে আরো সক্রিয় করার জন্য তারা রাজস্ব আদায়কারী হিসাবে নিযুক্ত করেছে মহম্মদ রেজা খাঁকে। এই লোকের চোখের চামড়া এবং হৃদয় বলতে কিছুই ছিলো না। বাংলা-বিহারের সবটুকু রক্ত চুষে খেয়েছে ড্রাকুলার মতো। এর রাক্ষুসে ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করতে গিয়ে ছিয়াত্তরে বাংলা ও বিহারকে বরণ করতে হয়েছিলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষকে।

এই রেজা খাঁর পায়ের উপর আছাড় খেয়ে পড়লেন দেবী সিংহ। রতনে যেমন রতন চেনে, তেমনি দুর্বৃত্ত চেনে দুর্বৃত্তকে। দেবী সিংহকে চিনতে ভুল হয় না রেজা খাঁর। মোটা টাকা ঘুষ খেয়ে পূর্ণিয়ার জেলার রাজস্ব আদায় এবং শাসনভারের দায়িত্ব রেজা খাঁ অর্পণ করেন দেবী সিংহের উপরে। দেবী সিংহ পুর্নিয়ার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব লাভ  করে নিজ মূর্তি ধারণ করেন এবং সুযোগ পেয়ে প্রজাদের সর্বস্ব কেড়ে নিতে থাকেন। তাঁর অত্যাচারে পূর্ণিয়ার কৃষকরা ঘরবাড়ি ছেড়ে বনে-জঙ্গলে পলায়ন করে প্রাণ বাঁচায়। অল্প দিনের মধ্যে সমগ্র এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে যাবার উপক্রম হয়। আগে পূর্ণিয়ার ইজারার বন্দোবস্ত হতো নয় লক্ষ টাকায়।

কিন্তু, সুজন্মার সময়েও ছয় লাখের বেশি আদায় করা সম্ভব হতো না। কিন্তু, দেবী সিংহ এর বন্দোবস্ত নিয়েছিলো ষোল লক্ষ টাকায়। এই ষোল লাখ টাকা আদায়  করতে গিয়েই দেবী সিংহ পূর্ণিয়াকে জনমানবহীন শ্মশানে পরিণত করেন। এই অসহনীয় শোষণ-উৎপীড়নের ফলে যখন নানা জায়গায় কৃষক  বিদ্রোহ শুরু হয় তখন ইংরেজদের টনক নড়ে। জেনারেল হেস্টিংস তাঁকে পদচ্যুত করলেন।

এই কয়েক মাসের মধ্যেই ইংরেজ চরিত্র সম্বন্ধে দেবীর বেশ ভালো একটা ধারণা গড়ে উঠেছে। তাই খুব একটা ঘাবড়ালেন না তিনি। ছুটে গেলেন হেস্টিংস সাহেবের কাছে। তার পায়ের কাছে ঢেলে দিলেন লক্ষ লক্ষ মুদ্রা।   নিজের টাকা নয়, পূর্ণিয়ার জনসাধারণের বুকের রক্ত থেকে নিংড়ানো টাকা। উৎকোচ পেয়ে দেবী সিংহের প্রতি দরদ উথলে উঠলো হেস্টিংসের। তিনি  রাতারাতি কয়েকজন ইংরেজ তরুণকে নিয়ে প্রাদেশিক রেভিনিউ বোর্ড গঠন করলেন। আর দেবী সিংহকে নিয়োগ দিলেন এই সভার কার্যাধক্ষ্যের পদে। এ প্রসঙ্গে নিখিলনাথ রায় তাঁর ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ বইতে লিখেছেনঃ

“এই সময় হেস্টিংস নিজের সুবিধামত কয়েকজন অনভিজ্ঞ ইংরেজ যুবককে লইয়া মুর্শিদাবাদে ‘প্রাদেশিক রেভিনিউ বোর্ড’ গঠন করেন। দেবী সিংহ সেই বোর্ডের সহকারী কার্যাদক্ষ্যের পদে নিযুক্ত হয়। দেবী সিংহ সুযোগ বুঝিয়া বিপুল অর্থ উৎকোচ দিয়া এবং বোর্ডের সভ্যদের জন্য একটি নর্তকী-সমাজ গঠন করিয়া বোর্ডের সদস্যদের বশীভূত করে। এইভাবে দেবী সিংহ প্রকৃতপক্ষে বাংলার রাজস্বের কর্তা হইয়া বসে। ”

রাজস্বের কর্তা হয়ে শুধু রাজস্ব নয়, আরো নানাবিধ করও আদায় করা শুরু করলেন দেবী সিংহ। প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করলেন ঠিকই, কিন্তু এর এক কানাকড়িও জমা দিলেন না সরকারি তহবিলে। তার বদলে স্বনামে এবং বেনামে কিনতে লাগলেন জমিদারির পর জমিদারি। এই অবস্থা চরম সীমায় পৌঁছুলে শাসকদের চৈতন্যোদয় ঘটে। চারিদিক থেকে হেস্টিংসের উপর চাপ আসতে থাকে দেবী সিংহকে পদচ্যুত করার। এবার সত্যি সত্যিই বেশ মুশকিলে পড়লেন হেস্টিংস। আর কোনো উপায় না দেখে রেভিনিউ বোর্ড ভেঙে দিলেন তিনি।

এরকম পরিস্থিতিতে কী করতে হয়, তা দেবী সিংহ খুব ভালো করেই জানেন। আবারো তিনি ছুটে গেলেন হেস্টিংসের কাছে। টাকায় কথা বলে, রাগকেও জল বানিয়ে দেয়। হেস্টিংসেরও তাই হলো। তিনি নরম হয়ে গেলেন। কিন্তু, লোকজন সব ক্ষেপে আছে দেবী সিংহের  উপর। কাজেই, তাঁকে মুর্শিদাবাদে রাখার সাহস পেলেন না। মাসে এক হাজার টাকা বেতনে দিনাজপুরের নাবালক রাজার দেওয়ান নিযুক্ত করে তাঁকে মুর্শিদাবাদ থেকে সরিয়ে দিলেন। তখন থেকে  দিনাজপুর আর রংপুরই হলো দেবী সিংহের শোষণ-উৎপীড়নের প্রধান রঙ্গভূমি।

এবার আর সমালোচনা করার কেউ থাকলো না। সরকারি ক্ষমতার কেন্দ্রভূমি থেকে অনেক দূরে তিনি। শুরু হলো রংপুরের বুকে দেবী সিংহের অত্যাচার।   ইংরেজরা এমনিতেই রাজস্ব বাড়িয়েছিলো ক্ষমতা দখলের পর। দেবী সিংহ বাড়ালেন আরো দশগুণ। এই কর দেবার সাধ্যি কৃষক সম্প্রদায়ের ছিলো না। বাকি পড়তে থাকলো কর। কর যাদের বাকি পড়লো তাদেরকে দেবী সিংহের লোকেরা ধরে নিয়ে এসে নির্মমভাবে প্রহার করলো। লুটে নিলো তাদের সহায়-সম্বল যা কিছু আছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। কখনো কখনো প্রহারের মাত্রা এতো বেশি হতো যে, ওই প্রহারের চোটেই ভবপারে পাড়ি দিতো অনেক কৃষক।  

নিখিলনাথ রায় তাঁর মুর্শিদাবাদ কাহিনীতে লিখেছেনঃ
“দিনাজপুরের দেওয়ানী লাভ করিবার পরের বৎসরই দেবী সিংহ দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগনার ইজারা বন্দোবস্ত করিয়া লইল। ইহার পর হরেরাম নামক এক  পিশাচ প্রকৃতির মনুষ্য তাঁহার সহকারী নিযুক্ত হইয়া  দেশমধ্যে ভয়াবহ কাণ্ডের ক্রীড়া দেখাইতে লাগিল। কি জমিদার, কি প্রজা, কি স্ত্রী কাহারও বিন্দুমাত্র নিষ্কৃতি ছিল না। এরূপ লোমহর্ষক অত্যাচার কেহ কখনও দেখে নাই, কেহ  কখনও শুনে নাই। ”

ইজারা গ্রহণ করার পরে শুধু প্রজাদের উপরই অত্যাচার শুরু করলেন না দেবী সিংহ। অন্যান জমিদার এবং ভূস্বামীদের উপরেও অবিশ্বাস্য রকমের কর বসালেন তিনি। এই কর এমনই অবিশ্বাস্য যে, কারো পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব নয়। ফসল বিক্রি করে তো দূরের কথা, ঘর-বাড়ি বিক্রি করেও করের টাকা যোগানো সম্ভব ছিলো না। কর আসছিলো না বলে শুরু হলো জমিদারদের উপরও অত্যাচার। জমিদাররা জমি হারালো। আর সেই জমি  নামমাত্র মূল্যে কিনে রাখতে লাগলেন দেবী সিংহ। এমনকি ‘লাখেরাজ’ (করবিহীন জমি এগুলো) জমিও বাজেয়াপ্ত করা হলো। কর আদায়ের জন্য জমিদারদের স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য করা হলো। সেই সময় রংপুর ও দিনাজপুরে অনেক নারী জমিদার ছিলেন। তাঁদের  জমিদারি তো বিক্রি হলোই, সাথে তাঁদের গহনাপত্রও বাদ গেলো না।

নিরীহ চাষীদের উপর দেবী সিংহের  অত্যাচার ভয়াবহ আকারে পৌঁছুলো। দেবী সিংহ এবং তাঁদের লোকেরা চাষীদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাদের পথের ভিখারিতে পরিণত করলো। চাষীরা প্রাণ বাঁচাতে গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়ে বনে-জঙ্গলে আশ্র্য নিতে থাকলো। তাদের না পেয়ে তাদের ঘরবাড়ি সব তছনছ করা হলো, জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। এ যেনো এক শ্মশানভুমি। এই অবস্থা সম্পর্কে দেবী সিংহ নিজেও লিখেছেনঃ

“ইহা অত্যন্ত বিড়ম্বনার বিষয় যে, বাংলার অন্যান্য স্থান অপেক্ষা রংপুর প্রদেশের কৃষকদের মধ্যেই অধিক অন্নকষ্ট উপস্থিত হইয়াছে, শস্য কাটার সময় ব্যতীত অন্য কোন সময় তাহাদের ঘরে কোনরূপ সম্পদ পাওয়া যায় না। কাজেই তাহাদিগকে অন্য সময়ে অতিকষ্টে আহারের  উপায় করিতে হয়, এবং এই জন্য দুর্ভিক্ষে বহুসংখ্যক লোক কাল-কবলে পতিত হইতেছে। দুই-একটি মৃৎ পাত্র ও একখানি পর্ণ কুটীর মাত্র তাহাদের সম্বল, ইহাদের সহস্রখানি বিক্রয় করিলেও দশটি টাকা পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। ”

একে বলে মাছের মায়ের  পুত্রশোক। দেবী সিংহ অতি নির্ভুলভাবে রংপুর অঞ্চলের কৃষকদের দুঃখ দৈন্যের কথা তুলে ধরেছেন। শুধু, এইটুকু বলতে  ভুলে গেছেন যে, তাদের এই দুর্দশার জন্য মূলত তিনিই দায়ী।   তাঁর বলা  এইসব হতভাগ্য ‘পর্ণ কুটীর’ বাসীরাও তাঁর রাহুগ্রাস থেকে রক্ষা  পায়নি। নিখিলনাথ রায় তাঁর ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’-তে লিখেছেনঃ

“কৃষকগণ খাজনার দায়ে দলে দলে শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া কারাগারে প্রেরিত হইল, অবিরত  বেত্রাঘাতে তাহাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত হইল। অধিকাংশ কৃষক পলায়ন করিয়া বনে-জঙ্গলে আশ্রয় লইল। ক্রমে ক্রমে সমস্ত দেশ মহাশ্মশানের  ন্যায় হইয়া উঠিল। যাহারা অবশিষ্ট রহিল তাহদের নিকট হইতে সমস্ত টাকা আদায়ের চেষ্টা হইল। ”

ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুল্লিতে পড়া বলে একটা কথা আছে না, অনেকটা সেরকম দশা হয়েছিলো তখন চাষীদের। এই অঞ্চলে শুধু দেবী সিংহই ছিলো না, ছিলো সুদখোর মহাজনেরাও। দেবী সিংহের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য কৃষকেরা মহাজনদের কাছে হাত পাতা শুরু করে। জমি-জমা বন্ধক রেখে সুদে টাকা ধার করে  দেবী সিংহের কর শোধের চেষ্টা করা শুরু করে। কিন্তু, তারা জানে না যে, এই অঞ্চলের জল-ডাঙা কোনোটাতেই নিরাপদ নয়  তারা। দেবী সিংহ যদি হয় ডাঙার বাঘ, তবে মহাজনেরা হচ্ছে জলের কুমীর।

এদের সুদের হার এতো বেশি ছিলো যে, এই ঋণ শোধ দেওয়া কৃষকদের  জন্য অসম্ভবই ছিলো। চক্রবৃদ্ধিহারে এই সুদ বেড়ে এমনই অবস্থা গেলো যে, কৃষকরা তাদের জমিজমা, গৃহ, লাঙ্গল, বলদ, মই সব হারালো মহাজনদের সর্বনাশা লোভের ফাঁদে পড়ে। তারপরেও তাদের জীর্ণ পর্ণকুটিরে সামান্য যে দুই একটা বস্তু থাকতো, তাও লুটে নিত দেবী সিংহের অনুচরেরা। লুটে নেবার পরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যেতো সেই পর্ণকুটিরে। শত কষ্ট স্বীকার করেও যারা এতো দিন আশ্রয় ত্যাগ করে নি, তারাও এখন বাধ্য হয়ে বন্য পশুর মত বনে জঙ্গলে বসবাস করতে লাগলো। পিতা বিক্রি করলো পুত্রকে, স্বামী বিসর্জন দিলো স্ত্রীকে, ভাই হারালো ভাইকে।

নিখিলনাথ রায় ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’-তে দেবী সিংহের অত্যাচারের ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো, তার করুণ বিবরণ লিখেছেন এভাবেঃ
“যদি কেহ অত্যাচারের বিভীষিকাময়ী মূর্ত্তি দেখিতে ইচ্ছা করেন, যদি কেহ মানবপ্রকৃতির মধ্যে সয়তানবৃত্তির পাপ অভিনয় দেখিতে চাহেন, তাহা হইলে একবার দেবীসিংহের বিবরণ অনুশীলন করিবেন। দেখিবেন, সেই ভীষণ অত্যাচারে কত কত জনপদ অরণ্যে পরিণত হইয়াছে। কত  কত দরিদ্র প্রজা অন্নাভাবে জীবন বিসর্জ্জন  দিয়াছে। কত কত জমীদার ভিখারীরও অধম হইয়া দিন কাটাইয়াছে। কুলললনার পবিত্রতাহরণ, ব্রাহ্মণের জাতিনাশ, মানীর অপমান, এই সকল পৈশাচিক কাণ্ডের শত শত দৃষ্টান্ত ছত্রে ছত্রে দেখিতে পাইবেন। দেবী সিংহের নাম শুনিলে, আজিও উত্তরবঙ্গ প্রদেশের অধিবাসিগণ শিহরিয়া উঠে! আজিও অনেক কোমলফৃদয়া মহিলা মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়েন। শিশুসন্তানগণ ভীত হইয়া, জননীর ক্রোড়ে আশ্রয় লয়! সমগ্র মানবজাতির  ইতিহাসে এরূপ পাশব অত্যাচারের দৃষ্টান্ত অধিক নাই বলিয়াই আমাদের বিশ্বাস। মানুষ হইয়া মানুষের প্রতি এরূপ নির্দ্দয় ব্যবহার কখনও সম্ভবপর কি না তাহা আমরা স্থির করিয়া উঠিতে পারি না। কল্পনায় সে চিত্র আঁকিতে গেলে আপনিওই ভীত ও চকিত হইয়া উঠে। মানুষ কখনও সে চিত্র দেখাইতে পারে না, দেখাইতে হইলে অমানুষী ক্ষমতার প্রয়োজন। কঠোরতায় হৃদয় না বাঁধিলে তাহার পূর্ণ চিত্র প্রদান করা দুঃসাধ্য। মহামতি বার্ক ইংলণ্ডের মহাসমিতির নিকট সেই অত্যাচারকাহিনী বর্ণণা করিতে করিতে এরূপ অস্থির হইয়া উঠিয়াছিলেন যে, আর অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারেন নাই। তথাপি তাঁহার সেই অবিনাশিনী বর্ণণা হইতে আজ আমরা দেবী সিংহের পৈশাচিক চরিত্রের যে চিত্র দেখিতে পাই, তাহাতেই স্তম্ভিত হইতে হইয়। তাই বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন, “পৃথিবীর ওপারে ওয়েষ্টমিনিষ্টার হলে দাঁড়াইয়া এদ্মন্দ বর্ক দেবীসিংহকে অমর করিয়া গিয়াছেন। পর্ব্বতোদগীর্ণ অগ্নিশিখাবৎ জ্বালাময় বাক্যাস্রোতে বর্ক দেবীসিংহের দুর্ব্বিসহ অত্যাচার অনন্তকালসমীপে পাঠাইয়াছেন। তাহার নিজ মুখে সে দৈববাণীতুল্য বাক্যপরম্পরা শুনিয়া শকে অনেক স্ত্রীলোক মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়াছিলেন- আজি শত বৎসর পরে সেই বক্তৃতা পড়িতে গেলে, শরীর রোমাঞ্চিত ও হৃদয় উন্মক্ত হয়। “

দেবী সিংহের নৃশংস অত্যাচারে সমগ্র উত্তরবঙ্গ  হাহাকারময় এক জনপদে পরিণত হয়। এ যেনো এক মহাশ্মশান। চারিদিকে শুধু মৃত্যুর গন্ধ, চারিপাশে  শুধু ধ্বংসস্তুপ, আর অরাজকতায় ছাওয়া অন্ধকার।

নদীর জলে আগুন ছিলো
অত্যাচার যখন চরমে পৌঁছায় তখন নিরীহ, দুর্বল এবং নির্বিষ সাপও ফণা তুলে ঘুরে দাঁড়ায়, ছোবল দিতে এগিয়ে আসে। রংপুর ও দিনাজপুরের মানুষও দেবি সিংহের এই নির্মম অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করলো না। এমনিতেই তারা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলো বনে-জঙ্গলে। এবার সংগঠিত হলো তারা। আর মার খাওয়া নয়, বিনা প্রতিবাদে মরে যাওয়া নয়, এবার রুখে দাঁড়াতে হবে। এই দৃপ্ত চেতনা নিয়ে দলবদ্ধ হলো তারা। বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দিলো সমবেতভাবে চারিদিকে। নিখিলনাথ রায় ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’-তে লিখেছেনঃ

“যখন চাষীদের উপর এই কর বৃদ্ধি ও তাহাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার উপর পাশবিক অত্যাচার অবাধে চলিতে লাগিল, যখন তাহারা বন্য পশুর মত দলে দলে বনে বনে ভ্রমণ করিয়াও অত্যাচারের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইল না, চক্ষুর সম্মুখে নিজেদের কুটীর ও যথাসর্বস্ব অগ্নিমুখে ভস্মীভুত হইতে লাগিল, তখন আর তাহারা স্থির থাকিতে পারিল না। কাজেই এই সমস্ত ভীষণ অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া উত্তর-বঙ্গের প্রজাগণ দলবদ্ধ হইয়া ব্যাপক বিদ্রোহ আরম্ভ করিল। ”

কৃষকদের মধ্যে যে ক্রোধ দিন দিন ধরে জমা হচ্ছিলো তা ১৭৮২ সালের শেষ দিকে তা পুঞ্জীভূত আকার ধারন করলো। উত্তর বঙ্গের কৃষককূল নিজেদের অনিবার্য ধ্বংস থেকে আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসাবে ইংরেজ বণিকরাজের শাসন ও নিষ্ঠুর শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উড়ালো। সমস্ত উত্তর বঙ্গ জুড়ে শুরু হলো এক মহা বিদ্রোহের সূচনা। রাজশক্তির বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে সর্বহারা কৃষকদের সুসংঘটিত এক বিদ্রোহের আলোড়নে আলোড়িত হয়ে উঠলো সমগ্র এলাকা।

প্রতিটা আন্দোলন, সংগ্রাম, বিদ্রোহ কিংবা বিপ্লবেই দেখা যায় যে, কোনো না কোনো মহান নেতার আবির্ভাব ঘটে গেছে। এই বিদ্রোহেও তাই হলো। অন্ধকার খনিগর্ভ থেকে বেরিয়ে এলো একখণ্ড হীরের টুকরো। নুরলদীন শক্র হাতে এই কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব হাতে নিলেন। ইতিহাসে নুরুলদীনের কোনো প্রকৃত পরিচয় নেই। জানা যায় না, কে ছিলেন তিনি? কোথায় জন্মেছেন, কোন গ্রামে ছিলো তাঁর নিবাস। শুধু এইটুকু জানা যায়, তিনিই প্রথম রংপুরের কৃষকদের  সংঘবদ্ধ করেছিলেন।

শুরুতে তিনি অবশ্য সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাতে চান নি। চেয়েছিলেন ইংরেজ সরকার দেবী সিংহের অত্যাচার থেকে তাদের রক্ষা করুক। রংপুরের কালেক্টরের কাছে তাদের দাবি সম্বন্ধে একখানা আবেদনপত্র পেশ করে এই দাবি পূরণের জন্য সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো।   আবেদনপত্রের সাথে বহু লোকের সই সংগ্রহ করে সংযোজন করে দেওয়া হলো। আবেদনপত্রে তাদের দূরাবস্থার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছিলো আর সেখানে ছিলো কতকগুলো অনুরোধ আর  উপরোধ।

দেবী সিংহ ঘোড়েল লোক। তাঁর লুণ্ঠিত অর্থের একটা অংশ তিনি কালেক্টরকেও দিতেন। তাই, আবেদনপত্রের ফলশ্রুতিতেও কোনো তদন্ত হলো না। কালেক্টর দাবি পূরণের জন্য কোনো চেষ্টাই করলেন না। নূরলদীন এবং কৃষকেরা বুঝে গেলেন যে, অনুরোধে কোনো কাজ হবে না। জোর করেই হটাতে হবে দেবী সিংহকে এবং দেবী সিংহের সমর্থক রংপুরের ইংরেজ কালেক্টরকে। বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা সমবেতভাবে নূরলদীনকে অধিনায়ক নির্বাচন করে তাঁকে ‘নবাব’ হিসাবে ঘোষণা করে দিলো।

নূরলদীন উত্তর বঙ্গের কৃষকদের বিদ্রোহের পরিচালনার ভার গ্রহণ করলেন। দয়াশীল নামের একজন কৃষককে তাঁর দেওয়ান নিযুক্ত করলেন। তারপর এক ঘোষণা পত্রের মাধ্যমে দেবী সিংহকে আর কর না দিতে আদেশ জারি করলেন। দেবী সিংহ এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে  বিদ্রোহের ব্যয় সংকুলানের জন্য কৃষকদের উপর ডিং খরচ নামে বিদ্রোহের চাঁদা ধাররয করলেন। ১৯১১ সালে প্রকাশিত Gazetteer of Rangpur District-এএ সম্পর্কে লেখা হয়েছে,
“The exactions of a notorious farmer Raja Deboi Singh of Dinajpur, caused an insurrection of the cultivators in 1783. The revenue officers were driven out.  A petition of grievances was submitted to the collector, who offered various concessions, which did not serve to quell the disturbance. The insurgents committed several murders, and issued a proclamation that they would pay no more revenue. They forced the cultivators of Cooch Behar to join them, and sent parties into Dinajpur to raise the people there. One of the leaders assumed the title of Nawab; and a tax called dingkharacha, or sedition tax, was levied for the expenses of the insurrection.”

নুরলদীন উত্তরবঙ্গের নানা স্থানে ঘুরে ঘুরে কৃষকদের সংগঠিত করতে লাগলেন। তাঁর কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেলো কৃষকদের কারণেই। মার খেতে খেতে মানুষ তখন এমনই মরিয়া যে সবাই উন্মত্ত হয়ে আছে প্রতিশোধ নেবার স্পৃহায়। নুরলদীনের কথায় দলে দলে  মানুষ মিলিত হতে থাকে এক পতাকার নিচে। সবাই এক লক্ষ্যে অবিচল। দেবী সিংহের বর্বরসূলভ শোষণ-উৎপীড়ন, নিপিড়নের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ এবং এই অঞ্চল থেকে ইংরেজদের শাসনের মূলোচ্ছেদ করা। বিদ্রোহীদের আহবানে কোচবিহার ও দিনাজপুরের বহু স্থানের কৃষকগণও নূরলদীনের বাহিনীতে যোগ দিলো।

এর পরই পরগনায় পরগনায় শুরু হয় বিদ্রোহীদের অভিযান। ১৭৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে সমগ্র রংপুর পরগনায় বিদ্রোহ আরম্ভ হয়। বিদ্রোহী কৃষকরা রংপুরের সমস্ত এলাকা থেকে দেবী সিংহের কর সংগ্রহকারী কর্মচারীদের বিতাড়িত করে। শুধু বিতাড়িতই নয়, বহু কর্মচারী এদের হাতে মারাও যায়। এরা যে এক তরফা আক্রমণে মারা গিয়েছে, তাও নয়। প্রায় জায়গাতেই এই কর্মচারীরা বরকন্দাজ নিয়ে বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করতে নেমেছিলো, কিন্তু তাদের সাথে পেরে ওঠে নি। দেবী সিংহের পৃষ্ঠপোষক কিছু জমিদারও ছিলো। তারা এগিয়ে এলো দেবী সিংহের সাহায্যে। বিদ্রোহ দমনের জন্য শক্তি প্রয়োগের ব্যবস্থা নিলো তারা। বিদ্রোহীরা ছাড়লো না। পালটা আক্রমণে ভস্মীভুত হলো এদের বাড়ি-ঘর। তাদের নায়েব নোমস্তাদেরও ধরে ধরে হত্যা করা শুরু হলো। কোচবিহারের ইতিহাস গ্রন্থের খাঁন চৌধুরী আমানতুল্লা আহমেদ লিখেছেন,

“ইহার পর কাকিনা, ফতেপুর, ডিমলা, কাজিরহাট এবং টেপা পরগনায় বিদ্রোহীরা দলবদ্ধ হইয়া কর-সংগ্রাহক নায়েব এবং গোমস্তা প্রভৃতিকে যত্র তত্র তত্র বধ করিতে আরম্ভ করে। ডিমলার জমিদার গৌরমোহন চৌধুরী বিদ্রোহীগণকে বাধা দিতে অগ্রসর হইলে তাঁহারও জীবনান্ত ঘটে। “

দেখতে দেখতেবিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত অঞ্চলে।   হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই এসে যোগ দিতে লাগলো নুরলদীনের দলে। ক্রমশ বিশাল হয়ে  উঠলো দল। এদের শক্তির সাথে না পেরে পালিয়ে গেলো দেবো সিংহ। পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলো রংপুরের কালেক্টর গুডল্যান্ড সাহেবের কাছে। দেবী সিংহের লুটের টাকার ভাগ গুডল্যান্ড সাহেবও পেতেন বলে তাঁদের মধ্যে প্রগাঢ়  বন্ধুত্ব ছিলো। এ ছাড়া বিদ্রোহীদের প্রতি তিনি আদৌ সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারপরেও  বিদ্রোহীরা তখন পর্যন্ত ইংরেজদের কোনো ক্ষতি করে নি বলে আগ বাড়িয়ে তাদের সাথে ঝামেলা করার কোনো ইচ্ছা তার ছিলো না। টাকা কামাতে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এই দেশে এসেছেন। যতখানি ঝামেলামুক্তভাবে টাকা কামানো যায়, ততখানিই মঙ্গল। দেবী সিংহের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব কোনো হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ না যে, তাঁর বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। দেবী সিংহও এটা জানেন। কাজেই, রংপুরে এসেই তিনি গুডল্যান্ড সাহেবকে প্রচুর অর্থ উপঢৌকন হিসাবে দিলেন। এবার গুডল্যান্ড সাহেব নড়ে চড়ে বসলেন। কর্তৃপক্ষের কাছে জানালেন যে, নূরলদীন নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে সমগ্র রংপুর ও দিনাজপুরে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটেছে। বিদ্রোহীরা ইংরেজদেরও প্রভূত ক্ষতি করছে এবং জমিদারদেরও অব্যাহতি দিচ্ছে না। অবিলম্বে এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করা হোক।

কালেক্টরের নিজের অধীনেও ছিলো একদল সৈন্য। লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ডের অধীনে এলো আরো একটি দল। সাথে কিছু সংখ্যক কামান। ম্যাকডোন্যাল্ড তার বিরাট বাহিনী নিয়ে রংপুরে প্রবেশ করেই সেটাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দিলো। এরা বিদ্রোহীদের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করার আগে পোড়ামাটি নীতি নিয়ে অগ্রসর হলো। সৈন্যরা যে পথ দিয়ে গেলো, সেই পথে যাকে দেখতে পেলো, তাকেই হত্যা করলো। শিশু হত্যা এবং নারী নির্যাতন করতেও কোনো দ্বিধা তারা করলো না। জ্বালিয়ে দিতে লাগলো গ্রামের পর গ্রাম।

ম্যাকডোনাল্ডের সৈন্যদের এই নিষ্ঠুর অত্যাচার বিদ্রোহীরা নীরবে সহ্য করলো না। যারা মারা যাচ্ছে, তারা তাদেরই কারো বাবা, ভাই বা আত্মীয়স্বজন। কাজেই, প্রতিশোধ নেবার আক্রোশে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো বৃটিশ সৈন্যের উপর। নানান জায়গায় শুরু হয়ে গেলো খণ্ডযুদ্ধ। সেই সব যুদ্ধের কোনোটাতে জয়ী হলো বিদ্রোহীরা, কোনোটাতে বিজয়ী হলো ইংরেজ সেনাবাহিনী। অবশেষে, বিদ্রোহীরা সিদ্ধান্ত নিলো ইংরেজ শাসনের প্রধান ঘাঁটি মোগলহাট বন্দরের ইংরেজ কুঠির উপর আক্রমণ করার। এই কুঠিটি ছিলো রংপুরের ইংরেজ শক্তির মুল কেন্দ্রগুলির অন্যতম। এই আক্রমণে নেতৃত্ব দিলেন নূরলদীন।

মোগলহাটের যুদ্ধের সময় বিদ্রোহীদের প্রধান বাহিনীটি অবস্থান নেয় পাটগ্রামে। ইংরেজ সেনাপতি লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোন্যাল্ড তাঁর বিশাল  বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহীদের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু, পথের মধ্যেই বিদ্রোহী বাহিনীর সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা পেয়ে ভীত হয়ে পড়েন তিনি। ফলে, সম্মুখ যুদ্ধের পরিবর্তে কূটকৌশলের আশ্রয় নেন তিনি। তাঁর সৈন্যরা যুদ্ধের সাজপোশাকের উপর সাধারণ কাপড় পরে সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশ ধারণ করে। তারপর রাতের আঁধারে নিঃশব্দে পাটগ্রামের কাছে এসে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ঘিরে ফেলে। ১৭৮৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারির অতি ভোরে ম্যাকডোন্যাল্ড বাহিনী বিদ্রোহীদের উপর গুলি চালনা শুরু করে। অতর্কিত এই আক্রমণে হকচকিয়ে যায় বিদ্রোহীরা। ইংরেজদের মতো আধুনিক সমরাস্ত্র তাদের ছিলো না, ছিলো না যুদ্ধের সুশিক্ষিত প্রশিক্ষণ পদ্ধতি। এই আক্রমণে দিশেহারা হয়ে  যায় তারা। ফলে, দলে দলে নিহত হয় তারা, আহত হয় অসংখ্য  আর বাকিরা প্রাণভয়ে পলায়ন করে। নূরলদীনের সহকারী দয়াশীল মারা যান। গোলার আঘাতে আহত গুরুতরভাবে আহত হন নূরলদীন। ইংরেজরা তাঁকে আহত অবস্থায় বন্দি করে। আঘাত এতোই গুরুতর ছিলো যে, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। গুডল্যান্ড তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেন

“In an attempt to burn Mughalhat, the self-styled Nawab’s forces were defeated, and the Nawab himself wounded and taken prisoner. A party of sepoys under Lieutenant Macdonald marched to the north against the principal body of insurgents and a decisive engagement was fought near Patgram on the 22nd February 1783. The sepoys disguised themselves by wearing white clothes over their uniform and by that means got close to the rebels,  who were utterly defeated; sixty were left dead on the field, and many others were wounded and taken prisoners.”

শেষ বিকেলের বহ্নিশিখা
নূরলদীন মারা গেলেন। কিন্তু যে বিদ্রোহের আগুন তিনি জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তা তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে নির্বাপিত হলো না। বরং তাঁর মৃত্যুতে বিদ্রোহীরা আরও ক্ষিপ্ত হলো, প্রতিশোধের আগুন তাদের রক্তে মজ্জায় ঢুকে গেলো। নূরলদীন নিজেও জানতেন যে, বিদ্রোহের যে আগুন তিনি জ্বালাচ্ছেন, সেই আগুনে একদিন তাকেও পুড়ে মরতে হবে। তাঁর মৃত্যুতে যাতে সব শেষ না হয়ে যায়, তাই তিনি আগেই বলে গিয়েছিলেন এই কথাগুলোঃ

“আমার মৃত্যুতে যেন বিদ্রোহের অবসান না হয়। প্রাণ থাকতেও ক্ষমা করো না অত্যাচারীদের। আর রাজকোষে জমা দিও না এক কপর্দকও। “

বিদ্রোহীরা তাদের নেতার আদেশ পালন করেছিলো অক্ষরে অক্ষরে। সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হবার জন্য যে সামর্থ তাদের থাকার কথা ছিলো, তা নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিলো মোগলহাটের যুদ্ধে, কাজেই চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যেতে থাকে তারা। সেই সাথে শত অত্যাচার সত্ত্বেও রাজস্ব দিতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। শুধুমাত্র রংপুরেই খাজনা বাকি পড়ে যায় চার লক্ষটাকার মতো।

টাকা বাকি পড়াতে টনক নড়ে কোম্পানির। ঘটনা কী তা জানার জন্য আর রাজস্ব আদায়ের জন্য পিটারসন নামের একজন ইংরেজ কর্মচারীকে পাঠানো হলো কমিশনার নিযুক্ত করে।

ইংরেজ মানেই যে সবাই খারাপ, তা কিন্তু নয়। এই পিটারসন সাহেবও ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ। রংপুরে এসে সবকিছু দেখে তিনি শিউরে উঠলেন। কোনো গ্রামে লোকজন নেই। কোথাও কোনো বাজার-হাট বসে না।   কৃষকেরা জমিতে চাষাবাদ করে না। যেদিকে তাকানো যায়, শুধু ভস্মীভূত কুটির চোখে পড়ে। কোনো মনুষ্য বসবাসের জায়গা যেনো এটি নয়, এ এক বিরান শ্মশানভূমি। এই অবস্থা দেখে একেবারে হতভম্ভ হয়ে গেলেন তিনি। তীব্র ভাষায় নিম্নোক্ত বক্তব্য তিনি লিখে পাঠালেন কোলকাতায়ঃ

“আমার প্রথম দুই পত্রে প্রজাদের উপর  কঠোর অত্যাচার, এবং তাহারই জন্য যে তাহারা বিদ্রোহী হইয়াছে সেকথা সাধারণভাবে বিবৃত করিয়াছি। আমার প্রতিদিনের অনুসন্ধানে তাহা আরও দৃঢ় হইতেছে। তাহারা যদি বিদ্রোহী না হইত, তাহা হইলে আমি আশ্চর্য জ্ঞান করিতাম। প্রজাদের নিকট হইতে রাজস্ব আদায় করা নাই, তাহাদের উপর রীতিমত দস্যুতা এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগকে কঠোর শারীরিক যন্ত্রণা ও সর্বপ্রকার অপমানে জর্জ্জরিত করা হইয়াছে।   ইহা যে কেবল কতিপয় প্রজার উপর হইয়াছিল এমন নহে, সমস্ত দেশেই এইরূপ ভাবেই অত্যাচার বিস্তৃত হয়। মনুষ্য চিরকাল পরাধীন থাকিলেও যখন অত্যাচার সীমা অতিক্রম করিয়া  উঠে, তখন তাহার প্রতিবিধানের জন্য তাহাকে অগত্যা উত্থিত হইতে হয়। আপনারা এই সমস্ত প্রজাদিগের অবস্থা বিবেচনা করিয়া দেখিবেন যে, যখন অসম্ভব কর আদায়ের জন্য, তাহাদের সমস্ত সম্পত্তি লুণ্ঠন করিয়াও অর্দ্ধাংশের পরিশোধ হইল না, তাহার উপর আবার তাহাদিগকে কঠোর শারীরিক পরিশ্রম যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইল, ইহার উপর যখন তাহাদের পরিবারের উপর সতীত্বনাশ ও জাতিনাশের অত্যাচার হইতে লাগিল, এরূপ ক্ষেত্রে  তাহাদের কি করা উচিত? আপনারা বিশেষরূপে অবগত আছেন যে, এতদ্দেশীয়েরা আপনাদিগের স্ত্রী ও জাতির উপর যেরূপ অনুরক্ত, তাহাতে তাহারা এরূপ অবস্থায় কতদুর সহ্য করিতে সক্ষম হয়?“

দেবী সিংহ এবং রংপুরের কালেক্টর গুডল্যান্ড সাহেবকে এবার কোলকাতায় তলব করা হলো। রেভিনিউ কমিটি দেবী সিংহের অনাচারের প্রমাণ পেয়ে তাঁর হাত থেকে রাজস্ব আদায়ের ভার তুলে নেয়। জমিদার এবং প্রজাদের দেবী সিংহের নিকট খাজনা দিতে নিষেধ করে। নিজের কুকীর্তি ঢাকা দেবার জন ৭০ লাখ টাকা সঙ্গে নিয়ে ছুটে যান । ওই টাকা তিনি বিচারকমণ্ডলীর মধ্যে ভাগ করে  দেন।

তখন বিচারের নামে যা হলো, তা হচ্ছে প্রহসন। রায়ে বলা হলো যে, দেবী সিংহ এবং গুডল্যান্ড সাহেবের কোনো দোষ নেই। ঈর্ষাকাতর  হয়ে পিটারসন তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা রিপোর্ট করেছেন। সুপ্রকাশ রায় তাঁর ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম বইতে লিখেছেনঃ

“গভর্নর-জেনারেল হেস্টিংস ষড়যন্ত্র পাকাইয়া গুডল্যান্ডের কোন দোষ নাই বলিয়া তাহাকে  অব্যাহতি দেন। দেবো সিংহ তাঁহার সঞ্চিত বিপুল অর্থ দ্বারা বহু  উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে বশীভূত করিয়া রাখিয়াছিল। হেস্টিংস তাহাদের লইয়া দেবী সিংহের বিচারের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি বিচার করিয়া রায় দেয় যে, দেবী সিংহ সম্পুর্ণ নির্দোষ, পিটার্সনই তাঁহার নামে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়াছেন। হেস্টিংস ইংলণ্ডে যে রিপোর্ট প্রেরণ করেন তাহাতেও তিনি এই  রায় সমর্থন করেন। “

প্রহসনের রায়ে দেবী সিংহ  নির্দোষ প্রমাণিত হলেন ঠিকই, কিন্তু প্রজা বিক্ষোভ এবং অসন্তোষের কারণে তাঁর পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভবপর হলো না। প্রথমতঃ তাঁর আশ্রয়দাতা হেস্টিংস সাহেব দেশে ফিরে গেলেন। গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন লর্ড কর্নওয়ালিশ। সুতরাং হেস্টিংসের পক্ষে দেবী সিংহকে আর কোনো সরকারী কার্যে নিযুক্ত করা সম্ভব হয়  নাই। দ্বিতীয়ত টাকা খেয়ে বিচারকমণ্ডলী দেবী সিংহকে নির্দোষ প্রমাণ করলেও তাঁর প্রতি কর্তৃপক্ষের আস্থা আদৌ ছিলো না। তবুও দেবী  সিংহ  চেষ্টা করেছিলেন  লর্ড কর্নওয়ালিশকে ভজনা  করতে। সুবিধা না হওয়ায় মুর্শিদাবাদে তাঁর বিরাট জমিদারীতে ফেরত গেলেন। এতকাল ধরে লুণ্ঠনের মাধ্যমে  যে টাকা পয়সা রোজগার করেছিলেন, সেগুলো দিয়ে বিপুল পরিমাণে ভূসম্পত্তি কিনে মুর্শদাবাদের নসীপুর রাজ-পরিবার প্রতিষ্ঠা করেন।

রংপুর বিদ্রোহের অবসান ঘটলো এখানেই।   বিদ্রোহের অবসান হলেও শোষণমুক্ত তারা হতে পারে নি। দেবী সিংহের অপসারণের পর লর্ড কর্নওয়ালিশ রাজস্ব আদায়ের  জন্য ইজারা প্রথা বন্ধ করেন এবং ১৭৯০ সালে উত্তর বঙ্গ ও বিহারের  জমিদারগোষ্ঠীর  সাথে দশশালা বন্দোবস্ত করেন। এই দশশালা বন্দোবস্ত অবাধ শোষণ-উৎপীড়নের আর একটা নতুন দরজা খুলে দিলো। বীজবুনেদিলোআগামীদিনেরবিদ্রোহআরআন্দোলনের। নূরলদীনের দেখানো পথ বেয়ে বাংলার ঘরে ঘরে পরবর্তী সময়ে জেগে উঠতে থাকলো আরো হাজারো নুরলদীন।

নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়
ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।
আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে;
যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে,
তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।
নূরলদীনের কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মত নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে উঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, 'জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?'

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৫

** জাগো বাহে কোনঠে সবায় (প্রথম পর্ব)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।