ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ছাড়িয়ে যাওয়া আর ছড়িয়ে দেওয়ার মন্ত্র | নওশাদ জামিল

পাঠ / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৫
ছাড়িয়ে যাওয়া আর ছড়িয়ে দেওয়ার মন্ত্র | নওশাদ জামিল স্কেচ: শিশির ভট্টাচার্য

প্রথম পর্যায়ে অগোছালো এবং অনিয়ন্ত্রিত কবিতা দিয়ে আবির্ভাব হলেও, কবি ফরিদ কবির নিজের জাত চেনাতে সময় নেননি বেশি; মাত্র ৩ বছর ব্যবধানেই খুঁজে পান নিজের প্রকৃত জমিন। প্রথম বই প্রকাশের পর, সেটা ১৯৮৫ সালের কথা, তখনই কবি টের পেয়ে যান, কবিতাগুলো ঠিক যেন তার নয়।

নিজেকে, নিজের কবিতাকে নির্মোহভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার উপলব্ধি হয়, প্রথম কাব্যগ্রন্থে যে আবেগের তারল্য, মাত্রাতিরিক্ত ক্ষরণ, রক্তপাত, শ্লোগানময় ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে, প্রকৃতিগতভাবে তিনি তেমন নন। দোষ অবশ্য তার নয়, তৎকালীন সময়ের। উত্তাল আশির দশকের অন্যান্য কবির মত তার যাত্রাপথেও ছিল ভুল নিশানা। অপরিপক্ব দৃষ্টিতে সবুজ আভা দেখে প্রাথমিকভাবে উচ্ছ্বসিত হলেও, ফরিদ কবির বুঝতে পারেন যে, আসলে ওটা দ্বীপ নয়। কবি কোন মন্ত্রবলে ফিরে এসেছিলেন, বেঁচে উঠেছিলেন কে জানে। প্রাথমিক ধাক্কায় অতলে তলিয়ে যাননি, হারিয়েও যাননি; কবি তাঁর দ্বিতীয় যাত্রাতেই খুঁজে পান তার শক্ত ভিত্তিমূল। দ্বিতীয়যাত্রায় এসে মাত্র ৩ বছর পর, সেটা ১৯৮৮ সালের কথা, কবি ফরিদ কবির ‘ওড়ে ঘুম, ওড়ে গাঙচিল’ কাব্যগ্রন্থে খুঁজে পান কবিতার স্বর্ণদ্বীপ। কবির যাত্রাপথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে, আমরা সন্ধান করব তার গতিপথ, বুঝতে চেষ্টা করব ব্যর্থতা উড়িয়ে কিভাবে তিনি সাফল্যের দেখা পেলেন; অনুধাবন করব কোথায় ফরিদ কবিরের ভুল হয়েছিল, কিভাবে শুধরে নিয়েছিলেন নিজেকে, নিজের কবিতাকেও। তো, এবার চোখ ফেরানো যাক তার কবিতায়।

কবি ফরিদ কবিরের কাব্যযাত্রা পর্যালোচনার জন্য তার ‘আমার কবিতা’ শীর্ষক বইটি গুরুত্বপূর্ণ। কবির সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থসহ তার সবগুলো কবিতার বই নিয়ে অনবদ্য সংগ্রহ ‘আমার কবিতা’। বইটিতে পত্রস্থ হয়েছে তার প্রকাশিত পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। আলোচনার সুবিধার্থে এই কথা বলে রাখা উচিত যে, একমলাটে ছাপা হলেও তার পাঁচটি বই পাঁচ ধরনের। এক বইয়ের কবিতার সঙ্গে অন্য বইয়ের কবিতার রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব, রয়েছে বিস্তর ফারাক। একবই থেকে অন্যবই কতটুকু দূরত্ব, গজ-ফিতা দিয়ে যদিও তা নির্ণয় করব না, তারপরও বলি, দূরত্বের প্রবণতাগুলো ঠিকই খুঁজে খুঁজে বের করব। সূচনাপর্বে বলেছিলাম যে, অগোছালো এবং অনিয়ন্ত্রিত কবিতা দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হৃদপিণ্ডে রক্তপাত’ বইটিতেই তা প্রতীয়মান। বাঙালি কবিদের মধ্যে অনেকের কথাই বলা যায়, যাদের প্রথম বইটি দুর্বল কবিতায় ভরা, তালিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে উল্লেখ করা যায় খ্যাতিমান অনেক কবিরই নাম; পরবর্তীতে তাদের অনেকেই কাব্যযাত্রায় আবিষ্কার করেছেন নিজস্বতা, মেলে ধরেছেন কালজয়ী অসংখ্য কবিতা। তাদের কাতারে, কিভাবে যেন মিল পাওয়া যায় কবি ফরিদেরও। তার সূচনা পর্বের অধিকাংশ কবিতাতেই উচ্চারণ ছিল দ্বিধান্বিত ও জুবুথুবু। ভাষা ছিল ম্যাড়ম্যাড়ে, শব্দচয়ন ছিল নড়বড়ে। কোথাও কোথাও ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, শামসুর রাহমানসহ কয়েকজন কবির যৌথ প্রভাব কিংবা অনুপ্রেরণা। প্রাথমিকভাবে একটি কবিতার কয়েক পংক্তির প্রমাণ দেয়া যাক।

      : হ্যালো, আমি দেবদূত, কে আপনি, হ্যালো?
      : আমি, সেই ... যার চোখ ছুঁয়ে প্রতিদিন
      তোমার স্বপ্নের নাও ভীষণ ভাসত।
      যার নীল বুকে তোমার আঙুলগুচ্ছ
      কাঁপতে কাঁপতে মিশে যেত, আমি সেই।
(পুরনো দিনের গান, হৃদপিণ্ডে রক্তপাত)

কবিতায় এই মাখামাখি আবেগ, ব্যক্তিত্বহীনতা, তেলতেলে ভাব কবি ফরিদ কবিরের স্বভাবজাত নয়। কবি তা বুঝতে পেরেছিলেন, টের পেয়েছিলেন যথাসময়েই। তাই সঠিক সময়েই নিজস্ব ভুবনে ফিরে এসেছিলেন। প্রথম বইটি নিয়ে আমার এই নির্দয় আচরণে যারা অবাক হয়েছেন, বিনয়ের সঙ্গে তাদের বলি, ফরিদ কবির নিজেও প্রথম বইটিকে স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেন। ‘হৃদপিণ্ডে রক্তপাত’ বইটির কবিতা সম্পর্কে তিনি উল্লেখ করেছেন, “সত্যি বলতে, প্রথম গ্রন্থের কবিতাগুলোকে এখন নিজের কবিতা বলে স্বীকৃতি দিতে যথেষ্ট আপত্তি আছে আমার। ” কবির মতন আপত্তি আছে আমারও, তারপরও বলতে হয়, প্রথম বইটিতেই রয়েছে বেশ কিছু উজ্জ্বল পংক্তি; রয়েছে প্রকৃত কবির কাব্যবোধ, রয়েছে ছন্দবোধও; পরের বইটিতে এসব প্রকৃত গুণাবলী তাকে দিয়েছে শক্তি, দিয়েছে স্বতঃস্ফূত গতি।

দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ওড়ে ঘুম, ওড়ে গাঙচিল’ তার কাব্যযাত্রার অমূল্য স্মারক। নিজেকে, নিজের কবিতাকে, কিভাবে কোন সাধনায় আমূল পাল্টে ফেলেছেন, তা ভেবে অবাক হতে হয়। প্রাচীন মুনি-ঋষিদের মত প্রগাঢ় সাধনায়, একাগ্রতায়, নিষ্ঠায় নতুন রূপে, নতুন সাজে আবির্ভাব ঘটে নতুনতর এক কবির। তার এই সাজ সত্যি ছিল অন্যরকম, ছিল প্রথম বইটি থেকে ভিন্নরকম। দ্বিতীয় বইটিতে এসেই পেয়ে যান নিজস্ব কাব্যের পদচিহ্ন। সাক্ষাত পান পথের, মতেরও। প্রথম দিকে যেখানে আবেগের তারল্যে ভেসে গিয়েছিলেন, উচ্চনাদে ভরিয়ে দিয়েছিলেন পংক্তি; দ্বিতীয় বইটিতে তিনি সম্পূর্ণই আলাদা। কবিতা করেছেন আবেগ ও যুক্তির মিশেলে, পরিমিত ও সুচারু উচ্চারণে। আশ্চর্য রকমের সুস্থির ও লক্ষ্যভেদী উচ্চারণে কাঁপিয়ে দিয়েছেন নতুন পৃথিবী। ‘প্রশ্ন’ কবিতাটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করব।

      মুঠোর ভেতর ছিল প্রাণ, শূন্যে উড়িয়ে দিয়েছি
      পুকুরের থিতু জলে কে ঢিল ছুঁড়েছো?

      গোল ঢেউ ছড়াতে ছড়াতে
      অবশেষে উঠে এলো হাতের তালুতে
      মুঠো করতেই দেখি, ছটফট করে চন্দ্র-মাছ
      মাছরাঙা পাখিটাকে কি নিয়ে গেল কিছু?
(প্রশ্ন, ওড়ে ঘুম, ওড়ে গাঙচিল)
 
কবিতায় এই ভঙিমা একদমই নতুন, অভিনবও বটে। পরিপূর্ণ যৌবনে কবির মনে জন্ম নেয় প্রশ্নরাশি, জন্ম নেয় জীবন ও জগত সম্পর্কে নানা কৌতূহল; ফরিদ তা খুঁজতে খুঁজতেই পেয়ে যান তার নিজস্ব তপোবন। ‘ওড়ে ঘুম, ওড়ে গাঙচিল’ কাব্যগ্রন্থে কবি ফরিদ কবিরের প্রধানতম গুণ এই যে, কবিতাগুলোয় অলংকারের বাহুল্য নেই; আছে বুদ্ধিপ্রবল উপস্থিতি। কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়, কবিতাগুলো যেন চর্চিত কবিতার খোলস ভেঙে বেরিরে আসার বাসনায় কাতর। বিষয় ও ভাষার ভেতরেও নেই অতিকথন। পরিমিত ও পরিশীলত কথনে সঠিক শব্দচয়নের মধ্য দিয়ে নির্বিকারভাবে তিনি খোলাসা করেছেন ভাব ও বিষয়। আশির দশকের অন্যান্য কবিরা যেখানে উদ্ভট চমক প্রদর্শনে ব্যস্ত, ফরিদ কবির সেখানেই উপস্থিত হয়েছেন সত্যিকারের চমক নিয়ে। তার এই চমক উদ্ভট শব্দচয়নে নয়, কবিতার ভাব ও ভাষা দিয়ে। একটি বা দুটি শব্দ দিয়ে নয়, তার গোটা কবিতা পাঠশেষে পাঠক টের পান আশ্চর্যময় এক অনুভূতি। দ্বিতীয় বইটিতে এই রকম কবিতাই বেশি লক্ষণীয়।

কবি ফরিদ কবিরের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অনন্ত দরজাগুচ্ছ’ যেন এক নতুন পৃথিবীর প্রবেশপথ। আশি পেরিয়ে নব্বইয়ের গোড়াতেই সজোরে করাঘাত করেছেন দরজায়, জানিয়ে দিয়েছেন যে, কবিতায় তার বাস পৃথক ভূমিতেই। বইটির প্রথম কবিতাটির কথা বলা যাক, শিরোনাম ‘জন্মবৃত্তান্ত’, কবি জানান দেন তার জন্মই হয়েছে পৃথক কিছুর জন্য।

      বাতাস-জড়ায়ু ছিঁড়ে তবে আমি পৃথক হয়েছি
      রক্তকা— দিকে দিকে, আমি একা বাতাস-সন্তান
      অগ্নি-জলে ক্রীড়া শেষে আছি ধোঁয়া-দেহন্তরে।
(জন্মবৃত্তান্ত, অনন্ত দরজাগুচ্ছ)

দ্বিতীয় বইটি থেকে এই উচ্চারণ ভিন্নরকম, কিভাবে পৃথক হলেন তিনি? ফরিদ কবির পৃথকসত্তার জন্য, বলা যায়, নতুন এক পথ উদ্ভাবন করেন। কবির এই পথ সোজাসাপ্টা কথা দিয়ে নয়, পৃথক হয়েছেন নান্দনিক চিত্রকল্প ও রূপকল্প ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বইটিতে স্থির ও সোজা কথা বললেও, তৃতীয় বইটিতে আশ্রয় নিয়েছে শৈল্পিক শব্দ-রূপকল্পের। কবি তা প্রকাশের জন্য প্রশয় দিয়েছেন কাব্যের ধ্রুপদি ছন্দকে। লক্ষ্য করার বিষয, দ্বিতীয় বইটিতে ছিল প্রচলিত অলংকার বর্জন, তৃতীয় বইটিতে তিনি নিবাস খুঁজেছেন ওই অলংকারেই। অলংকার সাজাবার জন্য বেছে নিয়েছেন ছন্দকেও। ফরিদের ছন্দচর্চাও ভিন্ন। ছন্দকে কবিতার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে দেননি, শব্দকেও বাড়তি গুরুত্ব দেননি, আশির দশকের অন্য অনেক কবির চেয়ে তার কবিতা ছন্দভঙ্গিমায় খুব পারফেক্ট, কিন্তু ছন্দের দোলায় কবিতা টালমাটাল নয়। তার কবিতায় ছন্দ রয়ে গেছে আড়ালেই। শব্দও পাঠকের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি, কবিতার প্রকৌশল ও রসদ নয়, বড় হয়ে ধরা দিয়েছে ওই  কবিতাই।

কবিতায় ছন্দের যথাযথ ব্যবহারে তার দখল সমীহজাগানো। অক্ষরবৃত্তেই লিখেছেন বেশি, পাশাপাশি মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তেও লিখেছেন প্রচুর। ছন্দের অনুশাসন তিনি মানলেও, ছন্দ নিয়ে তার রয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কবিতায় তার ছন্দের চলনভঙ্গিমা একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, তথাকথিত মাত্রা গুণে নয়, ছন্দ ব্যবহার করেছেন সুর ও ধ্বনির সমবায়ে। হয়ত এ জন্যই বিষয় ও ভাবগত দিক থেকে যেমন, কাঠামোগত দিকে থেকেও তেমনই তার কবিতাগুলি পেয়েছে ভিন্নমাত্রা।

‘অনন্ত দরজাগুচ্ছ’ প্রকাশের পর দীর্ঘ বিরতি, ভিতরে ভিতরে দীর্ঘ প্রস্তুতি। কবিতার জন্য কবির দীর্ঘ সাধনা ও নিবিড় পরিচর্যার ফল তার কাব্যগ্রন্থ ‘মন্ত্র’। তৃতীয় বই প্রকাশের ঠিক ৮ বছর পর, ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। জীবনকে ঘষে ঘষে স্ফূলিঙ্গ জ্বালিয়ে আলো-অন্ধকার বোঝার প্রয়াসে কবি নতুন সাধনায় লিপ্ত হন। তার কণ্ঠে ধরা দেয় মৌনতা, নির্জনতা। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের মত, সুর ও সংগীতের ঐক্যতানে যেন মন্ত্রপাঠ করেছেন, কবির ওই পাঠ শুনতে হয় মন্ত্রমুগ্ধ হয়েই। অমোঘ বাণীর মত যদিও মনে হয়, কিন্তু তা কবিতাই। শেষপর্যন্ত, কবিতা তো স্রষ্টার অমোঘ বাণী। মুখে মুখে, ঘুরে ঘুরে তা ছড়িয়ে পড়ে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে, প্রান্ত থেকে অসীম শূন্যলোকে।

      মানুষের কী আছে নিজস্ব
                     নিজ প্রতিবিম্বটুকু ছাড়া?

      এ কথা বলেনি কেউ, বরফের নিচে
      পদচিহ্নময় রাত জমে জমে বরফ হয়েছে।
(মন্ত্র: ১৪, মন্ত্র)

বইটিতে রয়েছে ‘মন্ত্র’ শিরোনামের দুর্দান্ত সিরিজ কবিতা। কবির মন্ত্রপাঠ শেষে মনে হয়, কবির মধ্যে ঘটে গেছে ভিন্ন রকম এক রূপান্তর। কবি তাতে নির্মাণ করেন ব্যক্তির সঙ্গে আমিত্বের সম্পর্ক, সমষ্টির সঙ্গে ব্যক্তির আন্তরিকতা; উচ্চারণ করেন সাধনারত কবির মগ্ন চেতনা। বইটিতে যেমন সামষ্টির ভিতর পাওয়া যায় ব্যক্তিক নির্জনতা; তেমনভাবে অনুভব করা যায় প্রেম ও প্রকৃতির নিরালম্ব প্রতিচিত্রও। জীবনে নানা কিছু দেখার পর, উপলব্ধির পর কবি যেন সন্ধান পান নতুন আরাধনার। ইতিহাস, ধর্ম, আচার-ব্রত, ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে কবির সাধনা দর্শনের আশ্রয়ে, প্রশয়ে নির্মাণ করে অনুপম সৌধ।

তিন দশক পেরিয়ে গেলেও, ফরিদ কবির লিখেছেন অল্প কবিতাই, কিন্তু সংখ্যা ও পরিসরে কম হলেও, কবিতাগুলো গুণেমানে গভীরতায় অনন্য। দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখলেও এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার ৫টি কাব্যগ্রন্থ। ‘মন্ত্র’ প্রকাশের একযুগ পর, প্রকাশিত হয় তার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘ওঁ প্রকৃতি ওঁ প্রেম’। মন্ত্রপাঠের শেষে, দীর্ঘ নীরবতা শেষে এবার ফরিদ কবির জেগে উঠলেন প্রকৃতি ও প্রেমের সুধা নিয়ে। কাব্যগ্রন্থের শিরোনামে বোঝা যায়, কবি এখানে বড় বেশি প্রকৃতিলগ্ন। শব্দ, উপমা ও চিত্রকল্পনায় বড় সংবেদনশীল। কবির দৃষ্টি ঘোরলাগা; কিন্তু ঝাপসা নয়, অস্পষ্ট নয়। এ সময় তিনি লেখেন প্রেম ও প্রকৃতির প্রতি তার গভীর প্রার্থনার কথা। তাতে শোক, দুঃখ ও দহন এবং বিরহও ভর করে আপন মহিমায় নিয়ে।

ওঁ প্রকৃতি ওঁ প্রেম’ বইটির দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। প্রথম দিকটির কথা বলি, বইটিতে প্রেম, প্রকৃতি ও প্রার্থনা তার মূল উপজীব্য; দ্বিতীয়টি হলো, কবির এই ভাব প্রকাশের মাধ্যম চাবি-শব্দ বা চাবি-বিষয়। আগের ৪টি বই থেকে এই কাব্যগ্রন্থে কবি শুধু পৃথকই হননি, নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন পৃথকসত্তার সঙ্গেও। ‘মন্ত্র’ প্রকাশের পর, কবি প্রকৃতির কাছে ফিরবেন, প্রেমের কাছে সমর্পণ করবেন নিজেকে, সেটাই তো সহজাত। বইটির দুটি অংশ, প্রথম অংশ ‘ওঁ প্রকৃতি’ যেন আবহমান প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য; দ্বিতীয় অংশ ‘ওঁ প্রেম’ ওই প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে গভীর বন্ধন। খানিক আগেই বলছিলাম, চাবি-বিষয় বা চাবি-শব্দের কথা। কবি এই বইয়ে এসে বিষয় ধরে এগিয়েছেন, কখনও ফুল, পাখি, বৃষ্টি, পাহাড়, নদী, সমুদ্রসহ নানা বিষয়কে নতুন দৃষ্টিতে অবলোকন করেছেন। কবি ওই বিষয়কে প্রকাশের জন্যই বেছে নিয়েছেন উপযুক্ত চাবি-শব্দ।

ফরাসি দেশের কবি মার্লামের কথা থেকে আমরা জানি যে, কবিতা আইডিয়া দিয়ে লেখা হয় না, হয় শব্দ দিয়ে। শুধু মার্লামে নন, তার মত অনেকেই এই কথা বিশ্বাস করেন। কবিতার নির্মাণ ও কাব্যকৌশল নিয়ে তারা বলেন, শব্দই কবিতার জিয়নকাঠি; কবিতার প্রাণশক্তি। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়, কবিতাপ্রকরণে শব্দ-ধ্বনি মিলে একটা কাঠামো তৈরি হয় বটে, কিন্তু কবিতায় শব্দই প্রধান নয়। কবিতার রসায়নে যুক্ত হয় আরও নানা মাধ্যম। দৃশ্যকল্প, চিত্রমালা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমন করে কবিতার বোধ, অন্তর্নিহিত শক্তিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কবিতায় ছন্দ এবং ছন্দবোধও দাবি করে বিশেষ অবয়ব। কবিতার ভাব, বিষয়, গঠনশৈলী ও শব্দব্যঞ্জনা নিয়ে বাংলা কবিতাতেও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দৃশ্যমান। ফরিদ কবিরের এখন পর্যন্ত শেষ কাব্যগ্রন্থের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়, শব্দপ্রশাসন খুব মানেন তিনি। উপযুক্ত ও সঠিক শব্দ নিয়ে শব্দ ব্যবহার করে চাবিশব্দের মধ্য দিয়ে এগোয় তার কবিতা। কোথাও কোথাও ভাবে-অর্থে তারতম্য হয়, তবে নতুন ব্যঞ্জনাও তৈরি করে। বিষয়কেন্দ্রিক কবিতাগুলো ছন্দে-মাত্রায় বেঁধে বিষয় বিস্তার করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কবি ‘চাবিশব্দ’ দিয়ে অবতারণা করেন বিষয়টির। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাবিশব্দটি ঘিরে বিষয় ও কবিতা আবর্তিত হয়। তার কবিতায় এবার চাবিশব্দের ব্যবহার দেখা যেতে পারে। উদাহরণ:

      নদীর বাতাস নেই, আছে দীর্ঘনিঃশ্বাসের ঢেউ
      আর, সেই ঢেউ এসে ধাক্কা খায় প্রধান সড়কে

      যে-কোনও রাস্তায় কান পাতলে তুমিও শুনতে পাবে
                                         নদীর ক্রন্দন

      মাঝে-মধ্যে এই দৃশ্য দেখতে পাই
      একদল লোক রাস্তা খুঁড়ে খুঁজছে নদীকেই।
(নদী-২, ওঁ প্রকৃতি ওঁ প্রেম)

কবিতাটির প্রধান চাবি-শব্দ ‘নদী’, বোঝা যায়, কবি ওই নদীকে কেন্দ্র করে অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে কবিতায় এনেছেন ঢেউ, রাস্তাসহ নানা অনুষঙ্গ। বইটির অন্যান্য কবিতাগুলোতেও এ প্রবণতা বিদ্যমান।   কবিতার মেইক অ্যান্ড মেকিংয়ের ক্ষেত্রে শব্দ নিয়ে এমন খেলা, শব্দ নিয়ে এমন কারিশমা তার আধুনিক মনন ও বোধের পরিচয়।

কবি ফরিদ কবিরের কবিতা শুধু তার শব্দ ব্যবহারের পরিমিতিবোধ থেকে নয়, ভাষাভঙ্গিতেও পরিশিলিতবোধ লক্ষণীয়। কবি এর ভেতর দিয়েই উন্মোচন করেন চেতন-অবচেতনের বর্ণিল অবয়ব। প্রথাগত আবেগ বর্জন করে, কবিতায় তিনি এনেছেন দৃঢ় ও ইস্পাতসম বাস্তবতা, কিন্তু তা উগ্র নয়। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে একধাপ থেকে অন্যধাপে নিজেকে প্রতিমুহূর্তে তিনি নবায়ন করেছেন নতুন নতুন শব্দ ও ভাষাবিন্যাস দিয়ে। বাংলা কবিতায়, ঠিক এইভাবেই কবি ফরিদ কবির নিজেকে ক্রমশ রূপান্তর করে ছাড়িয়ে গেছেন, ছড়িয়ে দিয়েছেন তার ভাব, দৃশ্যকল্প। নিজেকে প্রতিমুহূর্তে অতিক্রম করা, নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেট করার এই অনতিক্রম্য প্রবণতা অনেকে কবির মধ্যেই নেই, যাদের ভিতর তা পাওয়া যায়, ফরিদ কবির ওই বিরল কবিদেরই অন্যতম বার্তাবাহক।



বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।