ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শোকস্তব্ধ নেপাল ও প্রথম এভারেস্টজয়ের গল্প | মাহফুজ পারভেজ

বিশেষ রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৫
শোকস্তব্ধ নেপাল ও প্রথম এভারেস্টজয়ের গল্প | মাহফুজ পারভেজ

বাংলাদেশের বাইরে যে দেশটিতে সবচেয়ে বেশি গিয়েছি, সেটা নেপাল, ভূমিকম্পে যা এখন ছিন্ন-ভিন্ন, বিধ্বস্ত। টিভিতে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেপালের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিবরণ দেখতে দেখতে ভেতরটা বারবার কেঁপে উঠছিল।

নেপাল আর হিমালয়কে বারবার মনের গভীরে খুঁজে পাচ্ছিলাম।

একক কোনও বিষয়ই বিশ্বের অন্য কোথায়ও তাবৎ জাতিসত্তা বা গোটা দেশকে এমন প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করতে পারেনি, নেপাল বা নেপালিদের সর্বক্ষেত্রে যেমন সক্রিয়ভাবে কার্যকর হতে পেরেছে মহাপর্বত হিমালয়। চোখ যেদিকেই ফেরানো যাক, আকারে-ইঙ্গিতে-বক্তব্যে-অভিব্যক্তিতে-পরিচিতিতে হিমালয়ের একটি প্রভাব থাকছেই। দেশ ও জাতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যেন হিমালয়। অবশ্য এমন  হওয়াই সঙ্গত। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখর চূড়াটি যাদের নিজস্ব সম্পত্তি, তারা এমন আত্মপ্রচার কিংবা আত্মপ্রসাদ, যাই বলি না কেন—করতেই পারে।

হোটেল, রেস্তোরাঁ, পানশালা, ব্যাংক, বীমা, যানবাহন, সওদাগরী অফিস, মুদি দোকান, স্কুল, কলেজ, খাদ্য-দ্রব্যসহ সব কিছুই যেন হিমালয়ের নামে বা প্রতীকে প্রকাশ করতে গর্ববোধ করে নেপালি জনগণ। যে কারণে ব্যাংকের নাম হিমালয়, হোটেল বা শৈলনিবাসের নাম ক্লাব হিমালয়া (নাগরকোট)। এমন কি খাবার পানির ক্ষেত্রেও বিপণন ও বিক্রয়ের সুবিধার্থে নাম বেছে নেওয়া হয়েছে ‘Himalayan Natural Spring Water’। শুধু তাই নয়, বোতলের শরীরে লিখে দেওয়া হয়েছে স্তুতিমূলক স্লোগান: ‘Add some “Spring” to your life from the top of the world’ গুণকীর্তন করতে গিয়ে ‘Spring’ নামক পানীয় জলের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘Spring natural water originates at the langtang Mountain Range 24,000 ft. above sea level. “Spring” is naturally filtered through the Himalayan bedrock and bottling quality controls consistently exceed WHO standards. Tests by FDA have confirmed that the quality of “Spring” is so high that comparisons with current market standards are meaningless’। অর্থাৎ, প্রকৃতির বিশুদ্ধতা দিয়ে বাস্তবের অশুচিকে পরাজিত করা। আর এক্ষেত্রে মহান হিমালয় তার অপার ও অপাপবিদ্ধ প্রাকৃতিক শক্তিতে সাহায্য করলে তো আর কথাই নেই। নেপাল ও নেপালিদের আর্থ-সামাজিক-দৈনন্দিন জীবনে এভাবেই হিমালয় শক্তি যোগায়; মিশে থাকে নামের দ্যোতনায় রেখাচিত্রের ও অবয়বের স্বকীয়তায়।

সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক সীমারেখা ও বৈশিষ্ট্য কেবলমাত্র নেপালকেই নয়, আসমুদ্রহিমাচলব্যাপী তাবৎ দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশকেই বিশ্ব এবং এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে পৃথক করেছে উত্তরের সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালার মাধ্যমে। হিমালয়ের পশ্চিম প্রান্ত থেকে ক্রমশ দক্ষিণমুখী কারাকোরাম, হিন্দুকুশ ও ক্ষীরথর পর্বতমালা উপমহাদেশের পশ্চিম সীমান্তে সৃষ্টি করেছে এক অলঙ্ঘনীয় প্রাকৃতিক সীমারেখা, যা অঞ্চলটিকে পৃথক করেছে পশ্চিম এশিয়া থেকে। উত্তরের হিমালয় পর্বতশ্রেণী উপমহাদেশ ও চীনের মধ্যেও সৃষ্টি করেছে দুর্লঙ্ঘনীয় প্রাচীর-সদৃশ সীমান্ত, যা একই সঙ্গে বিস্তীর্ণ জনপদটিকে রক্ষা করেছে উত্তরের হিমবায়ুর হাত থেকেও। হিমালয়ের পূর্বপ্রান্তে যথাক্রমে আসাম ও লুসাই পর্বতমালা, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আরাকানের অনুচ্চ পর্বতশ্রেণী উপমহাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে মায়ানমার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকেও। এবং এভাবেই একটি সুরক্ষিত প্রাকৃতিক-সীমানার মাধ্যমে হিমালয় পর্বতমালা উপমহাদেশের সুবিশাল ভূ-ভাগময় দেশসমূহকে দিয়েছে প্রাকৃতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আর বর্ণনাতীত বৈচিত্র্য। আর হিমালয়ের কোলের নেপালকে নৈসর্গিক দিক থেকে এবং অন্যান্য বহুভাবেও করছে প্রাচুর্যপূর্ণ-সমৃদ্ধ-গৌরবদীপ্ত।

বিপদের কথাও রয়েছে, বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, দ্রুত গলছে হিমালয়ের হিমবাহগুলো আর এর ফলে হুমকির মুখে দক্ষিণ এশিয়ার ১৩০ কোটি মানুষ। ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনটিগ্রেটেড মাউনটেইন ডেভেলপমেন্ট’ কর্তৃক সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে আয়োজিত ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াটার উইক কনফারেন্স’-এ জানানো হয় এই বিপদজনক তথ্য। বলা হয়, বিশ্বের অন্য সব হিমবাহের তুলনায় হিমালয় পর্বতমালার হিমবাহগুলো সবচেয়ে বেশি গতিতে গলছে। সেখানে অত্যাধিক উচ্চতা, দুর্গমতা ও আশেপাশের দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে বিপদটি বৃদ্ধি পাচ্ছে অত্যন্ত সন্তর্পণে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, বিরূপ প্রাকৃতিক আবহাওয়া ও উষ্ণতাজনিত প্রতিক্রিয়ায় হিমালয়ে প্রতিবছর ৭০ মিটার বা ২৩০ ফুট করে হিমবাহ গলে যাচ্ছে। ‘চাইনা সেন্টার ফর মাউনটেইন ইকোসিস্টেম স্টাডিজ’ বলছে, তিব্বত মালভূমির তাপমাত্রা প্রতি দশকে তিন দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বাড়ছে, যা বিশ্বের অন্য সব মালভূমির উষ্ণায়নের গড় হারের দ্বিগুণ। ইন্টারনেট ভরে গেছে হিমালয়-সংক্রান্ত সম্ভাব্য বিপদের নানা তথ্যে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, হিমালয় পর্বতমালা থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীগুলোর অববাহিকায় রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল কয়েকটি দেশ। এসব দেশে পানি প্রবাহের প্রধান উৎস হচ্ছে হিমালয়। হিমালয়ের পানি সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও মানুষের পানাহারের অন্যতম সূত্র। হিমালয়ের বরফ গলার ফলে প্রাথমিকভাবে নদীগুলোর পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। কিন্তু নিরবচ্ছিন্নভাবে গলতে থাকায় পানির উৎস কমে যাবে এবং এর দীর্ঘস্থায়ী পরিণাম হবে পানির প্রবাহ ক্রমশ কমে যাওয়া। পাশাপাশি হিমবাহ গলে যাওয়ায় হিমালয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের হারেও তারতম্য দেখা দিয়েছে। ‘পাকিস্তান ওয়াটার রিসোর্স রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ মনে করে, হিমবাহ গলার ফলে বন্যার অস্বাভাবিকত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষকে একই মৌসুমে একাধিক বন্যার আক্রমণ সহ্য করতে হবে। এর ফলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় জীব-বৈচিত্র্য, জন-বসতি, ভূমির গুণসহ মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।

তথাপি হিমালয় দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশকে উত্তরের হিমপ্রবাহ থেকে রক্ষা করেছে বলেই দক্ষিণের সমুদ্রগামী ভূখণ্ড আবাসোপযোগী হয়েছে। হিমালয়ের উপকার শুধু প্রত্যক্ষভাবে নেপালই নয়, পরোক্ষভাবে পেয়েছে উপমহাদেশের সকল দেশ, দেশের মানুষেরা। এই জনপদের প্রাণ-প্রবাহরূপী নদীগুলোর অধিকাংশেরই উৎপত্তিস্থলও হিমালয়। বস্তুতপক্ষে, হিমালয় থেকে সৃষ্ট প্রধান প্রধান নদীপ্রবাহের অঢেল জলরাশিকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে উপমহাদেশের জনবসতি এবং প্রধানতম অর্থনৈতিক অবলম্বন কৃষি। আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরগামী মৌসুমী বায়ু হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়েই উপমহাদেশকে দান করেছে অবিরাম বৃষ্টিপাত, সম্ভব করেছে সবুজের অবারিত উত্থান। আঞ্চলিক ভূখণ্ডে মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণে হিমালয়ের নিরঙ্কুশ প্রভাবকে স্বীকার করেই প্রাচীন ভারতের জনমন এ মহান পর্বতকে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। যে বিশ্বাস এখনও কারও কারও মননে অটুট। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের প্রাচীন বিশ্বাস ও চর্চার সঙ্গে মিলে-মিশে একাকার হিমালয় আজও প্রাসঙ্গিক ভারত ও নেপালের সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের জীবনের সকল পর্যায়ে। হিমালয়-রাজ্য নেপালে এসে হিমালয়ের সর্বব্যাপ্ত-অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা, উপস্থিতি, আবশ্যিকতা ও দাপট দেখে অবাক-বিস্মিত হওয়ার বদলে অভিভূতই হতে হয়েছে বারবার।

পুরাকথা আর মিথকে বাদ দিলে বাস্তবের উপস্থিতিতে প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে জনবিশ্বাস আর শ্রদ্ধার মুকুট পড়ে হিমালয়ের শীর্ষে যাকে সগৌরবে উচ্চ-শিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, তার নাম এভারেস্ট—সারা বিশ্বের এক বিরাট বড় বিস্ময়।

পৃথিবীর বুকে সুদৃঢ় পা রেখে সুউচ্চ আপন গর্বিত মস্তক তুলে মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় হয়ে দণ্ডায়মাণ এই এভারেস্ট শৃঙ্গ। সাগর পৃষ্ঠ থেকে ৮,৮৪৮ মিটার (২৯,০২৮) উঁচু যার সর্বোচ্চ চূড়া। ১৮৫২ সালে তরুণ বাঙালি সার্ভেয়ার রাধানাথ শিকদার সর্বপ্রথম এই উচ্চতাটুকু অঙ্ক কষে নির্ণয় করেন। পরে তৎকালীন উপনিবেশিক-ভারতের ইংরেজ সার্ভেয়ার জেনারেল স্যার জর্জ এভারেস্ট (Sir George Everest) হিমালয় ও এভারেস্ট সমীক্ষার চূড়ান্ত কাজটি সম্পন্ন করায় তাঁরই নামানুসারে এর সর্ব্বোচ শৃঙ্গের নাম রাখা হয় এভারেস্ট। ইংরেজ সরকার কর্তৃক নামাকরণের আগেও এভারেস্ট শৃঙ্গের একটি স্থানীয় নাম ছিল। তিব্বতীয়রা এই এভারেস্ট শৃঙ্গকে ডাকতো ‘চুমুলুঙ্গমা’ (Chomolungma) বলে।

এই যে বিশাল বিস্ময়কর হিমালয় পর্বতমালা; গগনবিস্তারী এভরেস্টসহ বিশ্বখ্যাত একাধিক শৃঙ্গ; এই যে ভয়ঙ্কর সুন্দর আর বিশালতা, তাকে কিন্তু মানুষ ভয় করেনি। শুধু ভয় না করাই নয়; একদিন মানুষ একেও জয় করেছে। হিমালয়ের গর্বিত মস্তক এভারেস্টে মানুষই একদিন প্রচণ্ড সাফল্যে পৌঁছে গেছে; এঁকে দিয়েছে নিজের পদচিহ্ন; হিমালয় নতমস্তক হয়েছে মানুষেরই কাছে।

বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং  দুঃসাহসিক অভিযান সম্ভবত পর্বতারোহণ। এতে রয়েছে পদে পদে বিপদ; পদে পদে রয়েছে অঙ্কের মতো হিসেব কষার দায়। সমঝে পা না ফেললে তৎক্ষণাৎ অনিবার্য মৃত্যুর আহ্বান! ঝড়, বৃষ্টি ও কুয়াশা-কুহকের জন্যেও প্রস্তুত থাকতে হয় প্রতিনিয়ত। তুষারপাতে চোখ যেতে পারে ঢেকে। তার ওপরে রয়েছে তুষার-ধসের শঙ্কা! পর্বতের গায়ে জমে থাকে চাকা চাকা বিশাল বিশাল শিলাস্তরের মতো শক্ত আর কঠিন বরফের পিণ্ড; মাঝে মাঝে সেই বিশাল বরফখণ্ড ধসে পড়ে। যখন তা খসে গিয়ে নিচে নেমে আসতে থাকে তখন সামনে যা পায় তার সবকিছু দলে-মুচড়ে একাকার করে দিয়ে যায়। এর সামনে পড়লে আর রেহাই নেই! বিরাণ পাহাড়ে একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা আর হাজারো রকমের রোগ-ব্যাধি ও বিপদ তো রয়েছেই। পর্বতারোহণ করতে গেলেই অনেকের মাথা ঘোরে, উচ্চতা হেতু অসুস্থতা ও শ্বাসকষ্টের প্রকোপ দেখা দেয়, শরীর দুর্বল হয়, গা বমি বমি করতে থাকে। ফলে অনেকেই মারাও যায়। এজন্যে অভিযাত্রীকে হতে হয় প্রচণ্ড দৈহিক ও মানসিক শক্তির অধিকারী। সঙ্গে চাই অসীম ধৈর্য্য আর কষ্টসহিষ্ণুতা।

ভয়ঙ্কর, দুরূহ ও দুঃসাহসিক বলে মানুষ তো দমে থাকেনি! অজেয়কে জয় করাই তো মানুষের রোমাঞ্চকর নেশা। আর সেখানেই তো তার কৃতিত্ব ও বীরত্ব! রোমাঞ্চকর নেশায় হিমালয় পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করার অভিযাত্রার সূচনা হয় বিংশ শতকের গোড়ার দিকে; প্রথম মহাযুদ্ধের পর পরেই। প্রথম প্রচেষ্টাটি চালায় যৌথভাবে লন্ডনের আলপাইন ক্লাব (Alpain Club) এবং রয়্যাল জিওগ্র্যাফিক্যাল সোসাইটি (Royyal Geographical Society) ১৯২০ সালে। উল্লেখ করা দরকার যে, এভারেস্ট অভিযান চালানোর কতগুলো বিধিবদ্ধ নিয়মনীতি রয়েছে। বিশেষ করে অনুমতির প্রশ্নটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এভারেস্ট চূড়াটির যেখানে অবস্থান সেখানকার একপাশের মালিকানা নেপালের আর অন্যপাশের মালিক তিব্বত। বর্তমানে নেপালের প্রান্ত দিয়েই এভারেস্ট বা হিমালয়ে পর্বতারোহণ অনেক সুবিধাজনক হলেও প্রথম অভিযাত্রাকালে তেমন সুবিধা পাওয়া যায় নি বলেই উভয় দেশের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে নেপালের রাজা এবং তিব্বতের দালাইলামার কাছে ট্রেকিংয়ের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করতে হলো; প্রতিজ্ঞা করতে হলো স্থানীয় সংস্কৃতি ও লোকাচারকে ক্ষুণ্ন না করারও। শেষ পর্যন্ত মিলল উভয় দেশেরই অনুমতি।

হিমালয় অভিযানের অনুমোদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কর্নেল সি. কে. হাওয়ার্ড বেরির (Colonel C.K. Howard Bury) নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ-পর্যবেক্ষণ দল এলেন নেপালে। সবকিছু জেনে-শুনে তারা ১৯২১ সালের ১৮ মে তারিখে দার্জিলিং থেকে ৫৬০ কিলোমিটার বা ৩৫০ মাইল দূরে এভারেস্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। বেরি সাহেব ছাড়াও এ দলে আরও চারজন ইংরেজ পর্বতারোহী ছিলেন। এছাড়া ছিলেন পথঘাট জরিপ করার জন্য দুজন লোক, একজন ভূতত্ত্ববিদ, একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানী। আর ছিল মালামাল বয়ে নেয়ার জন্য এক শ’ ঘোড়া এবং পথ দেখানো আর পর্বত অভিযানের সময় মালামাল বহন করার জন্য ২২ জন তিব্বতি ও নেপালি পথ-প্রদর্শক, কুলি ও মুটে। বিরাট অভিযাত্রী দলটি বন-জঙ্গল-চড়াই-উৎরাই-নদী-হ্রদ-খানা-খন্দ-ঝর্ণার মধ্য দিয়ে বহু দুর্গম পথ পার হয়ে হিমালয়ের পাদদেশে এসে পৌঁছুতেই রোগ-ব্যাধি-বিপদে জর্জরিত হয়ে গেল; অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ল; আর একজন তো ধকল সইতে না পেরে অকস্মাৎ  হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারাই গেল!

অভিযাত্রী দল হিমালয়ের পায়ের কাছে এসে দেখলেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য—সভ্য জগৎ যা কল্পনাও করতে পারে না। তারা প্রত্যক্ষ করলেন এক বিশাল মূর্তি। আকাশ ছোঁয়া সে বিশাল মূর্তির পাদদেশে তারা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পার্শ্বদেশ প্রচণ্ড খাড়া। আর গোটা পর্বতগাত্র ও শৃঙ্গটাই বরফে আবৃত। চারপাশের প্রকৃতি পেজা তুলোর মতো গুঁড়ো তুষারে ঢাকা। চলতে গেলে বারবার পদক্ষেপ থেমে যাচ্ছে; পা বসে যাচ্ছে তুষারস্তূপে। আরও রয়েছে পা ফসকে হাজার ফুট নিচে পিছলে মৃত্যুকুপে পৌঁছে যাওয়ার শঙ্কা। এখানে আপাতত অপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে করলেন অভিযাত্রীরা।

বেরি সাহেবের নেতৃত্বে এ অভিযাত্রী দলটি পরিচালিত হলেও দলের প্রাণপুরুষ ম্যালোরি (Malory) সাহেব। তিনি দমে যাওয়ার পাত্র নন। দমে যাওয়ার জন্যে তিনি সুদূর বিলাত থেকে এখানে আসেন নি। বলে রাখা ভালো যে, ম্যালোরি সাহেবের নাম এভারেস্ট অভিযানের সঙ্গে একান্ত হয়ে জড়িয়ে রয়েছে তার দুঃসাহসিকতার জন্যে। এভারেস্ট অভিযানের ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তিদের একজন তিনি। তো এহেন ম্যালোরি সাহেব যে বেগতিক অবস্থা দেখে বসে থাকবেন না, তা বলাই বাহুল্য। পুরো অভিযাত্রী দলকে অপেক্ষায় থাকতে বলে তিনি মাত্র একজন সঙ্গী নিয়ে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে; উদ্দেশ্য কোনদিক দিয়ে এ পর্বতে আরোহণ করা যাবে তা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে মূল দলকে বেপথে চলা থেকে রক্ষা করা এবং সহজসাধ্য পথ বেয়ে কাঙ্ক্ষিত এভারেস্ট বিজয় সম্ভব করা। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরেই ম্যালোরি সাহেবের চোখে পড়ল তিব্বতীয় বৌদ্ধদের একটি মঠ। ইতিহাসে যে ধর্মস্থান বিখ্যাত ‘রংবাক বৌদ্ধ মঠ’ নামে পরিচিত। একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধস্থানের সঙ্গে আধুনিক দুনিয়ার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কৃতিত্বও ম্যালোরি সাহেবেরই। ম্যালোরি সাহেব বৌদ্ধ সাধুদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে গেলেন আর নিবিড়ভাবে কথা বললেন দূর-দূরান্ত থেকে আগত ভক্ত-অনুসারী পূজারিদের সঙ্গেও। জানতে চেষ্টা করলেন দুর্গম পর্বতে চলা-ফেরার নানা অন্ধি-সন্ধি সম্পর্কেও। বহু অনুসন্ধান ও খোঁজ-খবর করে তিনি দেখতে পেলেন একটি সরু পথ উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে। চোখের বিভ্রমে মনে হয় এ কোনও আলাদা পথ নয়—পর্বতগাত্রেরই একটি অংশ মাত্র! কিন্তু দেখা-না-দেখার মতো রহস্যময় এ পথ ধরেই মানুষ অনাদীকাল ধরে তিব্বত থেকে নেপালে আসছে; আবার নেপাল থেকেও মানুষ যাচ্ছে তিব্বতে। তিনি অনুমান করলেন, জনচলাচলের কারণে পথটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য। অতএব এই সরু পথ  ধরেই  আরও উপরে ওঠা যাবে; এই পথই তাকে সঠিক পথ দেখাবে পর্বতের দিকচিহ্নহীন বুকে এবং অবশেষে পৌঁছে দেবে এর সর্বোচ্চ শিখরে।

ম্যালোরি সাহেব পথটার একটা জুৎসই নামও দিয়ে দিলেন—নর্থকোল বা উত্তরের পথ। এই পথটি ছিল ৭১০৪ মিটার উচুঁতে। কিন্তু পথ আবিষ্কারের পরই তাকে বাধ্য হয়ে ফিরতে হলো বিরূপ আবহাওয়ার কারণে। শুধু তিনি একাই নন, অপেক্ষমাণ পুরো দলটিকেও প্রত্যাবর্তন করতে হলো সমতলভূমিতে। ভীষণ খারাপ আবহাওয়ায় পর্বতারোহণ তো দূরের কথা হিমালয়ের ত্রি-সীমানার মধ্যে টিকে থাকাও সম্ভব হচ্ছিল না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হিমালয় জয়ের প্রথম অভিযাত্রাটি অসমাপ্ত থেকে যায়।

প্রথমবারের অভিজ্ঞতার আলোকে পরের বছর আবার হিমালয় অভিযান শুরু করা হয়। দ্বিতীয় অভিযানের নেতা হলেন জেনারেল ব্রুস (General Bruce)। এছাড়াও দলটিতে অন্তর্ভুক্ত হন তেরোজন ইংরেজ ও ষাটজন স্থানীয় পর্বতারোহণ বিশেষজ্ঞ বা শেরপা। তেরজন ইংরেজের মধ্যে চারজন ছিলেন প্রধান পর্বতারোহী। এরা হলেন যথাক্রমে প্রথম অভিযানের অভিজ্ঞতালব্ধ ম্যালোরি (Malory), নর্টন (Nartin),সমারভেল (Somarvile), ফিঞ্চ (Finch)। প্রথম অভিযানের মতো এবারও দলের মধ্যে প্রধান ব্যাক্তি ছিলেন ম্যালোরি সাহেবই। ১৯২২ সালের ২ মে তারিখে দলটি সমুদ্র সমতল থেকে ১৮ হাজার ফুট উপরে হিমালয়ের বুকে স্থাপন করলেন প্রথম তাঁবু; গড়ে তুললেন নিজেদের ঘাঁটি (Base Camp)। স্থির করা হলো, এ তাঁবুকে ক্যাম্প ধরে এখান থেকেই চালানো হবে মূল অভিযান। দিন পাঁচেক তারা অবস্থান করলেন তাঁবুতে; পর্যবেক্ষণ করলেন পরিবেশ ও প্রকৃতি। ৭ মে তারিখে আরও প্রায় ১২০০ ফুট উপরে অর্থাৎ ১৯,৩৬০ ফুট উপরে স্থাপন করা হলো দ্বিতীয় তাঁবু। পরের দিন, অর্থাৎ ৮ মে তারিখে ২১ হাজার ফুট উঁচুতে স্থাপন করা হলো তিন নম্বর তাঁবু। এই তিন নম্বর তাঁবুতেই কেটে গেল আরও প্রায় দশ-এগারো দিন। তারপর ১৭ মে ২৩ হাজার ফুট উপরে স্থাপন করা হলো চতুর্থ তাঁবু। দলের অনেকেরই এত উপরে ওঠার কোনও পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে উচ্চতাজনিত সমস্যায় কারও কারও অসুবিধা হতে লাগল। অনেকেরই শুরু হলো শ্বাসকষ্ট। সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন না থাকায় দলের বেশ কিছু সদস্যকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তাঁরা নেমে এলেন নিচের তাঁবুতে। বাকি যারা টিকে রইলেন, তারা অব্যাহত রাখলেন অভিযান। তারা আরও উপরে উঠতে লাগলেন। ২৩ মে তারিখে তারা ২৫ হাজার ফুট উপরে স্থাপন করলেন পঞ্চম তাঁবু। কিন্তু এর পরেই মারাত্মক খারাপ হয়ে উঠতে লাগল আবহাওয়া। শুরু হলো পার্বত্য-বৃষ্টি; সঙ্গে তীব্র হিম-বাতাস, ঝড়ো পরিবেশ আর তুষারপাত। ২৫ হাজার ফুট উপরের পঞ্চম তাঁবুতে কোনও রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে অপেক্ষায় রইলেন অভিযাত্রীরা। সারাদিনের অপেক্ষার পরে দেখা গেল প্রকৃতি শান্ত হওয়ার বদলে আরও ক্ষেপে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত হলো দল আরও ছোট করা হবে; সবাইকে বিপদের মধ্যে ফেলা যাবে না। অবশিষ্টদের নিচের নিরাপদ তাঁবুর দিকে পাঠিয়ে দিয়ে চার প্রধান অভিযাত্রী—ম্যালোরি, ব্রুস, সমারভেল আর ফিঞ্চ—রয়ে গেলেন সেখানেই। বিরূপ প্রকৃতির কারণে অপেক্ষা করার তর সইছিল না রোমাঞ্চের আহ্বানে পাগল অভিযাত্রীদের। কখন আবহাওয়া অনুকূল হবে সে অপেক্ষা না করেই তাঁরা আরও উপরের দিকে এগিয়ে চললেন। কিন্তু কিছুদূর ওঠার পর দলনায়ক জেনারেল ব্রুস এবং ফিঞ্চ ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আর এগুনো সম্ভব হলো না তাদের পক্ষে। অতপর ফিরে আসতে বাধ্য হলেন এ দুই অভিযাত্রী। কিন্তু ম্যালোরির ছিল দুর্দান্ত মনোবল, শক্তি আর সাহস। তিনি এত সহজে হার মানতে রাজি হলেন না। এত উপরে উঠেও সাফল্য পাবেন না—তা কি হয়! ম্যালোরি পিছু হটতে রাজি হলেন না। বরং অপর সঙ্গী সমারভেলকে সাথে নিয়ে বিরূপ প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে আরও উপরে ওঠতে লাগলেন। এমনই দুঃসাহসে ভর করে তারা দুজন প্রায় ২৭ হাজার ফুট পর্যন্ত উঠেছিলেন। কিন্তু তারপরই ঘটল দুর্ঘটনা। তাদের সাহায্যকারী ৭ জন শেরপা অকস্মাৎ তুষারের তাণ্ডবে দলছুট হয়ে গেল; কেউ কেউ পা পিছলে পড়ে গেল তুষারস্রোতের মধ্যে। অগ্রাভিযান বন্ধ রেখে ম্যালোরি আর সমারভেল ঝাঁপিয়ে পড়লেন উদ্ধারকার্যে। প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে তুষার স্তূপের ভিতর থেকে তিনজনকে বাঁচাতে সক্ষম হলেন তাঁরা। কিন্তু বাকি চারজনের আর কোনও সন্ধানই পাওয়া গেল না। হিমালয়ের বুকের গভীরে এই তুষার সাগরে কোথায় যে শেরপারা হারিয়ে গেলেন তার কোনও হদিসই আর জানতে পারবে না পৃথিবীর মানুষ! এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও মানবিক বিপর্যয়ের পর আর অভিযান চালানো সম্ভব হলো না। সুতরাং একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে আসতে হলো ম্যালোরি আর সমারভেলকে; ২৭ হাজার ফুটেরও উপর থেকে নিচের সমতল ভূখণ্ডে।

হিমালয় অভিযানের অভিজ্ঞতা ও নানা সমস্যা-সম্ভাবনা পর্যালোচনা করতে করতে চলে গেল আরও দু’টি বছর। ১৯২৪ সালে আবার শুরু করা হলো অভিযাত্রা। এবারেও দলে ছিলেন অভিজ্ঞতা আর সাহসের প্রতীক ম্যালোরি। দলনেতা ঠিক করা হলো নর্টনকে। এছাড়াও এ্যাড্রো আরভিল নামে আরও একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সবার সঙ্গে দলের সার্বিক দায়িত্ব পালনের জন্যে ছিলেন জেনারেল ব্রুস। অতীতের সাফল্য ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দলটি নানা বাধা-বিঘ্ন এড়িয়ে তরতর করে হিমালয়ের চূঁড়ার দিকে উঠতে লাগল। নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে তারা প্রায় ২৮,২০০ ফুট পর্যন্ত উঠে এলো। এরপর সেখানেই স্থাপন করা হলো বেস-ক্যাম্প বা মূল-তাঁবু। এবার আর দল বেঁধে নয়; শুধু ব্রুস আর ম্যালোরি বের হলেন তাঁবু থেকে আরও ঊর্ধ্বে ওঠার মানসে। কিন্তু তখনই শুরু হলো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রচণ্ড বেগে বইতে লাগল বাতাস; সঙ্গে তীব্র তুষার ঝড়। এই প্রচণ্ড দুর্যোগ ঠেলে আর তাঁরা অগ্রসর হতে পারলেন না। ম্যালোরির মতো সাহসী ব্যক্তিও পিছু হটতে বাধ্য হলেন ঝড়ের তাণ্ডবে। অতপর তারা আবার নেমে এলেন নিচের তাঁবুতে। এদিকে দুর্ঘটনা আরও হয়েছে; বিপদ আরও দেখা দিয়েছে। ঝড়ের তীব্রতা আর বিরূপ আবহাওয়ায় পতিত হয়ে নর্টন তার দৃষ্টিশক্তি এবং সমারভিল তার বাকশক্তি হারান। দলের দুই চৌকস সদস্যকে অন্ধ আর বধির হতে দেখে বাকিরা মানসিকভাবে মুষড়ে পড়ল।

কিন্তু অনড় ম্যালোরি। তীব্র দুর্যোগ আর বিপদের মধ্যেও তিনি অটল। সাময়িকভাবে অপেক্ষা করতে রাজি হলেও হাল ছাড়তে নারাজ তিনি। আসলে লোকটি ছিলেন অন্য এক কঠিন ধাতুতে গড়া; ছিলেন মৃত্যু ভয়হীন। কোনও বিপদেই তার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই! সবাই ফিরে যেতে চাইলে গোঁ ধরে বসলেন ম্যালোরি:
-না! এতোদূর এসে আমি নিচে নেমে যেতে পারব না।
সবাই জানতে চাইলেন:
-এত বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর ক্ষয়ক্ষতির পরেও কী করতে চান আপনি?
ম্যালোরির সাফ জবাব:
-অভিযান চলবে। ব্যর্থতা আমার ভালো লাগে না।
-এই দুর্যোগের মধ্যেও অভিযান চালাবেন?
-অবশ্যই! এখানে এসে সমতল ভূমির মতো সুন্দর আবহাওয়া আশা করা পাগলামো। এখানে এটাই স্বাভাবিক। তার জন্যে হাত গুটিয়ে বসে থাকার লোক আমি নই!
ম্যালোরির দুঃসাহসিক বক্তব্যের পর দলের কেউ কেউ সাহস সঞ্চয় করলেন। আরভিল বললেন:
-বেশ! তুমি যেতে পারলে আমিও যেতে পারব না কেন! আমি আছি তোমার সঙ্গে। তুমি মরলে আমিও মরব।

অতপর দীর্ঘ আলোচনার পর স্থির হলো, গোটা দল ফিরে যাবে আর ম্যালোরি ও আরভিল তাদের অভিযান অব্যাহত রাখবেন। দলে ওডেল নামে এক লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন ভূ-তত্ত্ববিদ। ম্যালোরি আর আরভিলের সংকল্পের কথা শুনে ওডেল রোমাঞ্চিত হলেন:
-বেশ! তাহলে আমিও রয়েছি তোমাদের সঙ্গে।

অতএব দলের অন্যদের গুডবাই জানিয়ে তিনজন এগিয়ে চললেন আরও উঁচুতে। ক্রমে ক্রমে তারা উঠতে লাগলেন এভারেস্টের দিকে। সমস্ত বাধা-বিঘ্ন দুহাতে ঠেলে দিয়ে তারা যেন কোনও এক অচেনা ডাকে এগিয়ে চলছিলেন অজানা পথে—অদেখা ঠিকানায়। আবারও সমস্যা এলো নিজেদের মধ্যে থেকেই। ওডেল আর বেশি উচ্চতা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। ফলে তার জন্যে সেখানেই তাঁবু খাটাতে হলো ম্যালোরি আর আরভিলকে। অভিযানের নেশায় ক্ষ্যাপা সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে ওডেল বললেন:
-তোমরা এগিয়ে যাও আমি এখানেই রইলাম।
রোমাঞ্চের প্রবল টানে ম্যালোরি আর আরভিল তখন অন্য জগতের মানুষ। বিপদগ্রস্ত সঙ্গীর কথা না ভেবে তাকে রেখেই সামনের দিকে আরও উচ্চতায় এগিয়ে গেলেন তারা। ওডেল চোখে দূরবীন লাগিয়ে দেখতে লাগলেন ওদের পর্বতারোহণ। তিনি দেখছেন দূরে, বহু দূরে, দুজন লোক, ঠিক যেন পুতুলের মতো এগিয়ে চলেছে! লোক দুটি এগিয়ে যাচ্ছে পর্বতের সাদা ধবধবে গা বেয়ে। আর মাত্র ৮০০ ফুট বাকি—তারপরই তারা পৌঁছে যাবে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়।

হঠাৎই ওডেল দেখলেন এক আশ্চর্য দৃশ্য—যেখান দিয়ে ম্যালোরি আর আরভিল পর্বতের গা বেয়ে উঠছেন তারই ঠিক উপর থেকে প্রকাণ্ড একটি বরফের চাঁই প্রচণ্ড বেগে নিচের দিকে নেমে আসছে—মনে হলো যেন একটি জীবন্ত তুষার স্তূপ নেমে আসছে তাদের ওপরে।

স্মৃতিকথায় ওডেল আরও জানান:
-ওদের কাছে আসতেই দেখতে পেলাম ওরা যেন দুজনেই বরফের চাঁইটাকে পাশ কাটিয়ে সরে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তারপর বিশাল বরফ পিণ্ডের আড়ালে ওদের আর দেখতে পেলাম না। অনেক পরে বরফের চাঁই যখন আপন গতিতে নিচে নেমে এলো তখন আর তাদের কোনও নিশানাই খুঁজে পেলাম না।

তারপর আর কোনও দিনই তাঁদের সন্ধান পাওয়া যায় নি। এমনই করে দুজন দুঃসাহসিক পর্বতারোহী চিরকালের মতো হারিয়ে গেলেন হিমালয়ের তুষার স্তূপের সফেদ বুকের অন্তরালে। এবং এভাবেই আবারও ব্যর্থ হলো এভারেস্টের গর্বিত মস্তক পদানত করার অভিযান। শুধু ম্যালোরি আর আরভিলই নন, এ অভিযানে হারিয়ে যায় আরও অনেক মূল্যবান প্রাণ; রংবাক চূড়ায় আজও তাঁদের স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে।

শত ব্যর্থতা, বিপদ আর ত্যাগেও কিন্তু মানুষ পিছু হটে না। একমাত্র মানুষেরই রয়েছে অদম্য এক স্পৃহা, ব্যর্থতা যাকে আটকাতে পারে না। হিমালয় অভিযানে যতই ব্যর্থতা আসতে থাকে, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বিজয়ের জন্য মানুষের সুতীব্র জেদ আর আকাঙ্ক্ষা। মৃতুভয়কে তুচ্ছ করে বারবার দৃঢ় পদভারে এগিয়ে যেতে থাকেন সাহসিক পদাতিকরা হিমালয়ের সুউচ্চ শৃঙ্গের দিকে। ১৯৩৩ এবং ১৯৩৬ সালেও আরও দুটি অভিযাত্রার আয়োজন করা হলো। কিন্তু সেগুলোও যথারীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়; বিজয়ের বদলে সে সকল অভিযান রেখে যায় অসংখ্য মৃত্যু আর ক্ষয়-ক্ষতির চিহ্নযুক্ত অভিজ্ঞতা। অদম্য মানুষ তবু দমে যায় না। আবার নতুন করে বুক বাঁধে সাহসে। শুরু করে নবঅভিযাত্রা।

১৯৫১ সাল। আসেন এক নতুন অভিযাত্রী। নাম শিপটন। অনেক চেষ্টা আর গবেষণা করলেন তিনি। নানা পথে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণের সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাইও করলেন। অবশেষে আবিষ্কার করলেন এভারেস্টে ওঠার একটি নতুন ও নিরাপদ পথ। কিন্তু নিজে সে পথ ধরে উঠতে পারলেন না বহুকাঙ্ক্ষিত শৃঙ্গে। ১৯৫১ সালের শিপটনের অভিযানও ব্যর্থ হলো।

তারপর এলো সেই আকাঙ্ক্ষিত ১৯৫৩ সাল। এবার এভারেস্ট জয়ের জন্য হাজির একটি নতুন অভিযাত্রী দল। এই দলেই ছিলেন নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী এডমন্ড পি. হিলারি (Admund P. Hillary) এবং নেপালের অধিবাসী তেনজিং নোরকে, যিনি পেশায় পর্বতারোহী বা শেরপা।   ঐতিহাসিক এই দলটিতে আরও ছিলেন কর্নেল জন হান্ট (John Hunt) টমাস স্টোবার্ট (Thomas Stohart), জর্জ সি. বান্ট (Geroge C. Band), আলফ্রেড গ্রেগরি (Alfred Gregory), উইলফ্রেইড নোই (Wilfried Noy), চার্লস জিওফ্রে উইলি (Charle Geoffrey Wylie), টমাস বুর্দিলন (Thomas Baurdillion), আর. সি. ইভান্স (R.C. Evans), জর্জ লাওই (George Louee), এল. জি. পুগ (L.G. Pugh) প্রমুখ।

গোড়াতেই বলে রাখা ভালো যে, এডমন্ড হিলারির নেতৃত্বে এ অভিযাত্রী দলটিই শেষ পর্যন্ত এভারেস্ট বিজয়ে সক্ষম হয়। বহু কালের অজেয় হিমালয় শৃঙ্গ এভারেস্ট মানব বংশের এইসব সাহসী সন্তানদের কাছেই অবশেষে পদানত হয়।

১৯৫৩ সালের ২৮ মে দলটি অভিযানের এক পর্যায়ে হিমালয়ের ২৭,৮০০ ফুট উচুঁতে ৮ নম্বর তাঁবু ফেলল। কিন্তু আবহাওয়া এরই মধ্যে ভয়ানক খারাপ হয়ে উঠল। শুরু হলো প্রচণ্ড বাতাস আর সেই সঙ্গে অসহ্য শীত এবং তুষারপাত। গোটা এলাকা নিমেষেই বরফের কুচিতে ভর্তি হয়ে গেল। পা ফেললেই হাঁটু ডুবে যাচ্ছে বরফ কুচির ভেতর। প্রচণ্ড শীত, বাতাস আর তুষারপাতে অতীষ্ট অভিযাত্রীদল ঘুমাতে পর্যন্ত পারে নি। নির্ঘুম অপেক্ষা করলেন তারা তবু অভিযান বন্ধ করলেন না। অবশেষে এই প্রতিকূল আবহাওয়ার ভেতরেই অভিযাত্রীরা পরস্পরের কোমরে দড়ি বেঁধে খুব সাবধানে ও ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগুতে লাগলেন। সামনের পথ ভয়ঙ্কর বিপদসঙ্কুল আর বিরূপ প্রকৃতিতে রুষ্ট। সামান্য পা পিছলে গেলেই আর রক্ষা নেই! অবধারিত মৃত্যু; গড়িয়ে পড়তে হবে শত শত ফুট নিচে! কিংবা বিশাল বরফের স্তূপের আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে হিমালয়ের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে হবে চিরদিনের মতো! কিন্তু অদম্য সাহসিক অভিযাত্রীরা ভয় পেলেন না; থেমে গেলেন না। কৌশল ও ধৈর্যের কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও উঁচুতে পৌঁছে ফেললেন ৯ নম্বর তাঁবু বা ক্যাম্প। পরিকল্পনা অনুযায়ী এটাই হবে অভিযানের শেষ ঘাঁটি। এখান থেকে এভারেস্ট শৃঙ্গের দূরত্ব মাত্র ৮৮০ ফুট। এই পথটুকু এগুতে পারলেই অর্জিত হবে চূড়ান্ত বিজয়।

৯ নম্বর ক্যাম্প থেকে এবার শুরু হলো এভারেস্ট বিজয়ের শেষ ও চূড়ান্ত অভিযান। এই চূড়ান্ত অভিযানের যাত্রী হলেন মাত্র দুজন—এডমন্ড হিলারি আর শেরপা তেনজিং নোরকে। অন্যরা পেছন থেকে সাহায্য করার জন্য অপেক্ষা করলেন তাঁবুতে। দুজনেরই পিঠে বাঁধা হলো অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং মুখে গ্যাস মুখোশ। কারণ, তত উঁচুতে বাতাস এতই হালকা যে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করাও অসম্ভব। এদিকে আবহাওয়ার বিপদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক ভয়। বিরূপ আবহাওয়ায় অপেক্ষা করে করে ধীরে ধীরে পথচলায় ফুরিয়ে এসেছে অক্সিজেনের মজুদ। অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলে আর এক মুহূর্তও পাহাড়-শীর্ষে থাকা যাবে না; দম আটকে মরতে হবে। অতএব অভিযাত্রীদল মুখোমুখি হলেন এক চরম অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের আর তা হলো অক্সিজেন থাকতে থাকতেই অভিযান শেষ করে উচ্চস্থান থেকে নিরাপদে নিচে নেমে আসার চ্যালেজ্ঞ। ফলে অক্সিজেন শেষ হওয়ার আগে শুধু অভিযানই শেষ করতে হবে না; বরং নিরাপদে ফিরেও আসতে হবে।

এমনই সঙ্কুল অবস্থার মুখোমুখি হয়ে দুজন বীর অভিযাত্রী হার-না-মানা পণে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। খুবই সাবধানে আর দৃঢ়তার সঙ্গে পা ফেলে তারা ক্রমাগত উঠতে লাগলেন চূড়ার দিকে। বুকে তাদের দুরন্ত সাহস, মনে অনমণীয় প্রত্যয়: ‘যেমন করেই হোক, অজেয় শৃঙ্গকে পদানত করতেই হবে। ’

মানুষের অদম্য বাসনার বিজয় অবশেষে হলো। সত্যি সত্যিই বাস্তবে পরিণত হলো সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত পরম মুহূর্ত। ২৯ মে তারিখ বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ মানুষ প্রথমবারের মতো তার পদচিহ্ন এঁকে দিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায়। আর যিনি এই ঐতিহাসিক বিজয় অর্জনের প্রথম গৌরব লাভ করলেন, তিনি হলেন শেরপা তেনজিং নোরকে।

আসলে এই বিজয় অর্জনের ঘটনাটিও বেশ নাটকীয়। দুজনের দলটি যখন হিমালয়ের সর্বশীর্ষ প্রান্ত এভারেস্টের একেবারে কাছে গিয়ে পৌঁছায়, তখন দেখা দেয় বিপত্তি। এভারেস্ট আর মাত্র কয়েক ফুট দূরে, যেখান থেকে খাড়া উঁচুতে অবস্থিত চূড়া একদম হাতের নাগালের মধ্যে। কিন্তু হিলারি থমকে গেলেন। আবেগ আর উত্তেজনায় এতটুকু এসে তিনি টের পেলেন যে তার বয়স হয়েছে, শরীরও ভারী। তিনি আর পারছেন না। বিশেষ করে, তার পক্ষে খাড়া বেয়ে চূড়ায় পৌঁছা শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, অসম্ভবও বটে। অন্যদিকে, তেনজিং হালকা-পাতলা গড়নের শক্তি-সামর্থ্যে পরিপূর্ণ টগবগে পাহাড়ি যুবক, যার রয়েছে নেপালি রক্ত-ঐতিহ্য আর পাহাড়ি পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার পরীক্ষিত ক্ষমতা। বাস্তবতা মেনে নিয়ে হিলারি তেনজিংকে আদেশ দিলেন আগে শীর্ষে উঠে যেতে এবং সেখানে খুঁটি পুঁততে। তারপর হিলারি আদেশ দিলেন শীর্ষ থেকে রশি ফেলবার জন্যে। হিলারির আদেশ মতোই তরতর করে এভারেস্ট শীর্ষে উঠে গেলেন তেনজিং;  সোনার হরফে নিজের নাম লিপিবদ্ধ করলেন ইতিহাসের পাতায়। নিজেই বিজয় করলেন এভারেস্ট এবং টেনে তুলে হিলারিকেও সাহায্য করলেন এভারেস্ট বিজয়ে। এই জন্যেই এভারেস্ট বিজয়ের ইতিহাসে আগে লেখা হয় শেরপা তেনজিং নোরকে’র নাম এবং পরে স্যার এডমন্ড হিলারির নাম।



বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।