ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সাবস্ক্রাইবার অব সালমন দ্যব্রাউনফিশ | মেহেদী উল্লাহ

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৫
সাবস্ক্রাইবার অব সালমন দ্যব্রাউনফিশ | মেহেদী উল্লাহ

সর্বশেষ আমি তাঁকে একটা গায়ে-হলুদে নাচতে দেখেছিলাম। গ্রামের প্রতিবেশি মহিলারা সে সময় গীত গাইছিল, ‘রুমা সুন্দরী কালিতারা, ঘুরাই ঘুরাই রং লাগাই...।

’ রুমা নামের মেয়েটিকে সামনে বসিয়ে তাঁর অঙ্গভঙ্গিমার সঙ্গে মিলিয়ে সুর তুলে চলেছেন পাঁচ-ছয় মহিলা। এসব বুঝবার উপযুক্ত বয়স না হলেও খটকায় আমি ভেবেছিলাম, সুরের সঙ্গে নাচ যেখানে রেওয়াজ, সেখানে বৃদ্ধার নাচের সঙ্গেই বরং সুর উঠছে। তাঁর পরনে শার্ট-প্যান্ট, মাথায় হ্যাট, বোঝাই যায় যোগাড় করেছেন। তিনি আলাদা করে নজর আদায় করে ছাড়লেন। আমার আম্মা আমাকে খুঁজবে তাই রাত দশটার আগেই আমি গায়ে-হলুদের সীমানা ছেড়ে ঘরে ফিরি।

আমার স্কুলের প্রথম দিনের স্মৃতি প্রায়ই মনে পড়ে। এমনকি নিজের প্রতিটি সন্তানের প্রথম স্কুল-গমনের দিনে এই স্মৃতি মনে পড়বেই। বেঁচে থাকলে নাতি-নাতনিদের বেলায়ও মনে আসবে। জীবনের প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনটির আগের দিন আমার পরিবারের কোনো পরিকল্পনা ছিল না যে, পরদিন আমি স্কুলে যাব। এমনকি আমার আম্মা কিংবা আব্বা আমার হাজিরা খাতার নামটাও এখনও ঠিক করার সময় পাচ্ছিলেন না। তেমনই এক মুহূর্তে আমি প্রতিবেশি মোতালেব চাচার সঙ্গে স্কুলের পথ ধরেছিলাম। মোতালেব চাচা ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়/আগে থেকে আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে আরো চার-পাঁচটা বাড়ি হয়ে সংক্ষিপ্ত পথে প্রাইমারিতে যেতেন। সে দিন সকালে আমি উঠানের নিম গাছে বাবুই পাখির বাসা বানানো দেখছিলাম, সিজনটা স্কুলের ভর্তির সময়ও ছিল না। মোতালেব চাচা যাওয়ার পথে আমাকে দেখে জানতে চাইলেন, ‘বাইল্যার বাসা দেখ মনি?’ আমি লাজে মরি। এবার তিনিই উস্কে দিলেন, ‘বইল্যায় বাসা বানলে নতুন কিছু অয়। চলো ইশকুলে চলো। এর আগে তো যাও নাই কুনো দিন। ’



বাড়িটার ওপর দিয়ে স্কুলের পথটা সংক্ষিপ্ত। যাওয়ার পথে সেই নাচনেওয়ালি বৃদ্ধাকে আমি দ্বিতীয়বারের মতো দেখলাম। তাঁর বাম কাঁধে একটা কাক, সে হাতেই তিনি একটা ছাতা মেলতে মেলতে ঘরের দরজা দিয়ে বাইরে পা, বাম পা রাখছেন। শার্ট-প্যান্ট ছাড়া চিনতে কষ্ট হলেও আজ পরনে সাদা শাড়ি, খোঁপা চুল। আমি ভেবেছিলাম তিনি যাদু দেখাতে বের হচ্ছেন। আসলে না।



এতে মোটেও আগ্রহী হই নি। এবার চাচা আমার বাম হাতটা ধরে তার ইকোনো ডিএক্স কলম শার্টের জেব থেকে বের করে মোক্কা ঠোঁটের মধ্যে চেপে তিন-চার টানে একটা ঘড়ি আঁকলেন। দেখতেই পাচ্ছি, ঘড়ি! এবার আমার ডান হাতে তিনি তাঁর নাম লিখলেন। ঘড়িটা মেনেছি, কিন্তু তাঁর নামটা মুছতে যাব ওমনি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেন, ‘চলো ইশকুলে চলো। ’ ডান হাতে তার দস্তখত দেখে আমি এই গ্রহের একটি ভাষার প্রথম বর্ণটি লেখার কৌতূহলে যাবার তাড়না ফিল করলাম। আমরি আম্মাকে আমার কিছুই বলা লাগল না। চাচা কথা উল্টে দিছেন। তিনি আম্মাকে জানালেন, আমিই নাকি তাঁকে ইশকুলে যাওয়ার জন্য ধরেছি। আমাকে নিয়ে যেতেই হবে। আম্মা আমার প্রথমদিনের স্কুলে যাওয়ার জন্য যে গোছানো নাজেহালের দরকার পড়বে তা থেকে বাঁচতেই যেন, এক ঝটকায় বলে দিলেন, যেন কথাটা ঠোঁটের ওপর রেডি ছিল, ‘যাক না। ’ আমি গেলাম।

আসলে সেই বিয়ের পর এই বাড়িতে আর আসিনি। এখানে সে রকম উপস্থিত থাকার মতো কোনো ধরনের উৎসবও হয়নি। বাড়িটার ওপর দিয়ে স্কুলের পথটা সংক্ষিপ্ত। যাওয়ার পথে সেই নাচনেওয়ালি বৃদ্ধাকে আমি দ্বিতীয়বারের মতো দেখলাম। তাঁর বাম কাঁধে একটা কাক, সে হাতেই তিনি একটা ছাতা মেলতে মেলতে ঘরের দরজা দিয়ে বাইরে পা, বাম পা রাখছেন। শার্ট-প্যান্ট ছাড়া চিনতে কষ্ট হলেও আজ পরনে সাদা শাড়ি, খোঁপা চুল। আমি ভেবেছিলাম তিনি যাদু দেখাতে বের হচ্ছেন। আসলে না। ঘরের দরজার বাম দিকে একটা কাঠ বাদাম গাছের তলে গিয়ে বসলেন তিনি। ততক্ষণে কাকটা তার কাঁধ ছেড়ে কাঠ বাদামের সবচেয়ে উপরের উল্টানো ছাতার মতো দেখতে আনুভূমিক ডালগুলোর একটায় গিয়ে বসেছে। বড় কালো ছাতাটা এমনভাবে বাম কাঁধে নিয়েছেন, মনে হয় ছাতাটার বাঁট অনেক দিন থেকে তার কাঁধে থাকতে থাকতে একটা নির্দিষ্ট জায়গা ও সুস্থিরতা অর্জন করেছে। মোতালেব চাচা আমাকে থামা থেকে হাঁটালেন, এমন ভাব করলেন, এইদৃশ্য এইভাবে দেখার কী আছে? তিনি রোজই দেখেন।

আরো বললেন, ‘আজ নানিটা দেরি করে ফেলছেন, প্রত্যেকদিন তো দেহি গাছটার তলে ছাতা মাথায় মুখ ঢাইকা বইসা থাকতে। ’

অবাক হই এই ভেবে, প্রথম দিনের স্কুলে গিয়ে আমি ঠিক কী কী করেছি মনে নেই, এমনকি প্রথম ক্লাসটা যার ছিল এবং তিনি আমাকে হঠাৎ নতুন হিসেবে কিভাবে নিয়েছেন আর হাজিরা খাতায় আমার নামটা তুলেছিলেন কি-না তাও আমার মনে পড়ে না। এই বৃদ্ধার সুবাদে শুধু প্রথম দিনের স্কুলে যাওয়ার স্মৃতিটুকু মনে পড়ছে!

এক সময় দৃশ্যটা সয়ে গেছে। কখনো এমন হতো, দেখতে দেখতে আর তাঁকে নতুন করে চোখে পড়ানোর মতো থাকত না। হয়ত অন্য কিছু চিন্তা করতে করতে/মোতালেব চাচার হাত ধরে/ অন্য কারো সঙ্গে খেলা করতে করতে স্কুলে পৌঁছে যেতাম। গিয়ে বা বাড়ি ফিরে মনে পড়ত আজ নানিটাকে দেখলাম না? হয়ত দেখেছি/খেয়াল করিনি/চোখের ওপর দিয়ে আবছা ভেসে গেছে।

দুই
আসলে, একটা কথা না বললে, উপরিউক্ত জিনিসগুলো মিথ্যা হয়ে যাবে। আমি ছয় কিংবা সাত বছর বয়সে বৃদ্ধার নাচ/বৃদ্ধাকে কাঠ বাদাম গাছের ছায়ায় ছাতা মাথায় বসে থাকতে দেখে ঠিক এমন করে ভাবিনি। বরং বড় হতে হতে তাঁকে নিয়ে লেখা শুরু করে দিয়েই বড়বেলার বোধবুদ্ধি মিশিয়ে মূল ছবিটাকে মনে করার চেষ্টা চলছে।

আমার মনে সব সময় এমন প্রশ্ন ঘুরোঘুরি করেছে, কেন বৃদ্ধা এভাবে বসে থাকেন, অথচ আমি মোতালেব চাচা/বাড়ির কাউকে/কোনো প্রতিবেশিকে/আমার আম্মাকে কখনোই এ ব্যাপারে প্রশ্ন করিনি। হয়ত এক সময় তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ব এই নিয়তি নির্ধারিত ছিল বলেই শৈশবে তার নিষ্পত্তি ঘটায়নি। বরং আমার নিজের কাছেই অজানা/রহস্যময়। তবে বৃদ্ধার নাম শামসুন্নাহার, এটা জানি/জেনেছিলাম।

একবার আরো অবাক হয়েছি, কাকের বাসাটা দেখে। সেটা ছাতিম গাছের মাঝামাঝিতে যেখানে কয়েকটি ডাল একত্রিত হয়েছে। আমি এই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজি নি, বাসাটা মহিলা বানিয়ে দিয়েছে/কেউ বানিয়েছে/কাক নিজেই বানিয়েছে? আমি অবশ্য কখনোই কাকটিকে বাসায় বসে থাকতে দেখি নি/এমনও হতে পারে কাক বাসায় থাকা অবস্থায় সেখান দিয়ে যাইনি। যাই হোক, বাসাটা ছিল একটা পরিত্যক্ত বাঁশের ঝুড়ির মধ্যে শুকনো নারকেলের ছোবড়া আর খড়কুটা দিয়ে বানানো। ঠিক শিওর নই, শৈশবে পরিত্যক্ত বাঁশের ঝুড়ি দেখেছিলাম কিনা ওখানে। এটাও ভাসা ভাসা একটা স্মৃতিচারণা। হয়ত ভাঙা ঝুড়িই হয়ে থাকবে, একটু পুরনো, কাঁচা বাঁশের মূল রঙটা খয়ে যাওয়া, মেটে ধরনের রঙ।

তিন
আমার নাম বলতে চাই না। তবে আমি কেমন—বোঝানোর স্বার্থে এটুকু উল্লেখ করতেই পারি, ইউটিউবের ‘সালমন দ্যব্রাউনফিশ’র সঙ্গে আছি। আছি বলতে ওদের টিমের একজন আমি। স্রেফ মজা দেওয়ার জন্য আমরা ইউটিউবে নিজেদের অভিনীত ফানি ভিডিও আপ করি। সালমনের খুব কাছের বন্ধু আমি। আমাদের ভিডিওগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখে। আমরা ইউটিউবের বাইরেও এখন ছোটপর্দায় যাত্রা শুরু করেছি। কমেডি নাটকে আমাদের অনেককেই নেওয়া হয়েছে। তারা সফলও বলতে গেলে। দর্শক খাচ্ছে। আমিও যাব যাব করছি ছোটপর্দায়। এতক্ষণে আপনারা বোদ্ধারা বুঝে গেছেন, আমি কেমন মাল? আসলে, আপনাদের এমন ধারণার পেছনে হাজারটা যুক্তি আপনারা দেখান। এই জেনারেশন নিয়া আপনাদের মেলা আপত্তি। আমাদের প্রজন্মের হাজার হাজার তরুণ আপনাদের ইগোর ওপর ঝাড়ি দিয়ে তুড়ি মেরে স্যাটায়ার করে বলে, ‘আমাদের হয় না, আপনাদের হয়। ’ আপনারা প্রায়ই অপবাদ দেন, আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে, দেশের প্রতি প্রেম নাই, দেশ জিনিসটাই আমরা বুঝি না। দেশের কালচার বুঝি না মামা, ট্রেডিশান ইগনোর করার ব্লেম খাই আমরা। এমনকি আমরা সিরিয়াস কোনো গল্পও পড়ি না, আমাদের দৌড় হুমায়ূন আহমেদ পর্যন্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। যাই হোক বলতে চাই না আর। হাজির হয়েছি অন্য একটা কারণে। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটা গল্প পড়তেছিলাম। মেহেদীর লেখা গল্প। গল্পটার একটা অংশ পর্যন্ত আমি এতক্ষণ মনে করার/আপনাদের জানানো চেষ্টা করেছিলাম। অথবা ধরে নেন এক ও দুই অংশটা, গল্পের যা আমি কপি করে রেখেছি তিন-এ উপস্থিত হওয়ার আগে। আমার কিছু কথা আছে। সেটা আপনাদের জানাতে চাই/নিজে নিজে ভাবতে চাই। বলা শেষে আমি আবার আপনাদের মেহেদীর গল্পে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। বলতে পারেন, স্টুডিও থেকে সোজা খেলার মাঠে। ধরে নেন আপাতত বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ।

নিজের জীবন সম্পর্কে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আর আপনাদের অতি পরিচিত মুখ সালমন মোক্তাদির অনেক কিছুই জানে। আমি চিরসুখী, এইটাই আমার একমাত্র প্রবলেম। আমার বাবার অনেক টাকা। তিনি শিল্পপতি। আমার ব্যাপারে একটা অতি প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া প্রয়োজন, ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত এই বাইশ-তেইশ বছরের জীবনে আমি একদিনও কাঁদি নাই। ও আচ্ছা, আপনারা তো আবার ভুল ধরবেন। অভিযোগ তুলবেন, এই হবে না, শিশুরা এমনিতেই কাঁদে, জন্মেই কাঁদে, এরপর থেকে অনবরত একটা সময় পর্যন্ত গাল ফুলিয়ে কারণে, বেশি অকারণে কাঁদে। মানলাম, সে রকম কান্না আমারও আছে। মনে নাই। বড় হলে আম্মু-আব্বুও এসব কথা তোলে না, সন্তান লজ্জা পাবে তো। তাছাড়া আলাদা করে বলার কী আছে! বাচ্চারাই তো কাঁদবে জগতের নিয়মে। নাকি, বাবা-মা কাঁদবে আর বাচ্চা শুয়ে থেকে পা নাচাতে নাচাতে দেখবে।



একদিন আব্বুকে বললাম, ‘আব্বু, শোনো আমি যাকে লাভ করি সেই ছেলেটাকে বাসায় ডেকে আনি, তুমি ইচ্ছে মতো বকা দিয়ে দাও, বলো, এত বড় সাহস! তুই বামুন হয়ে চাঁদে হাত দিছোস, বলো তোর কথা টাকা লাগবে, চেক লিখে দিচ্ছি নিয়ে যা। ’ আব্বু বললেন, ‘সেকি আম্মু! তুমি যাকে ভালোবাসবে তাকেই আমরা মেনে নিব, আলাদা করে ছেলেটাকে কেন বলতে যাব, আমি দেখব, আমার মেয়ে কী করছে। ’ বলেন, এরপর আর কান্না আসে?



শৈশবের যে ক্ষণ থেকে এখন পর্যন্ত আমার সব মনে পড়ে, এই সময়ের মধ্যে আমি একদিনও কাঁদি নাই। আসলে, আমার কাঁদার কোনো জায়গা নাই। আর হাসতে হাসতে মজার তথ্য হচ্ছে, এটাই আমার এই মুহূর্তে কান্নার একমাত্র কারণ। বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখেছি, আমার জীবনে কান্নার কোনো উপলক্ষই কোনোদিন তৈরি হয় নাই। খুব ছোটবেলায় কোনো ভুল করলে বাবা-মা বকে এমনকি গায়ে হাত তোলে এমন হয়নি কখনো আমার সাথে। বড় হলে বন্ধুরা খুনসুটি করে, এটাও হয়ত কারো জন্য কান্না আনে, আমার হয় নি এমন। আরো বড় হলে প্রেমিক অথবা প্রেমিকা ছেড়ে চলে যায় কষ্ট দিয়ে আমার প্রেমিক আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে না, আমি তাকে অনেকবার বলেছি, গেট আউট ফ্রম মাই লাইফ, তবুও সে যায় না কষ্ট দিয়ে। ফলে ব্যথাহীন, কষ্টহীন, অভিমানহীন, অভাবহীন, অভিযোগহীন জীবনে স্বভাবতই কান্না কখনো আসে না। আম্মুকে একবার বললাম, আমার চুল ধরে টান মারো তো। উদ্দেশ্য, ব্যথা লাগলে কাঁদব। আম্মু হাসতে হাসতে বলল, ‘মা মনি, এখন তোমার স্কুলে যাওয়ার সময়, তাছাড়া আই উইল গো টু অফিস। ’ বলেন, আর কান্নার সুযোগ হয়?

একদিন আব্বুকে বললাম, ‘আব্বু, শোনো আমি যাকে লাভ করি সেই ছেলেটাকে বাসায় ডেকে আনি, তুমি ইচ্ছে মতো বকা দিয়ে দাও, বলো, এত বড় সাহস! তুই বামুন হয়ে চাঁদে হাত দিছোস, বলো তোর কথা টাকা লাগবে, চেক লিখে দিচ্ছি নিয়ে যা। ’ আব্বু বললেন, ‘সেকি আম্মু! তুমি যাকে ভালোবাসবে তাকেই আমরা মেনে নিব, আলাদা করে ছেলেটাকে কেন বলতে যাব, আমি দেখব, আমার মেয়ে কী করছে। ’ বলেন, এরপর আর কান্না আসে?

এভাবে জীবনটা কান্নাহীন। কান্নাহীন জীবনই আমার কান্নার একমাত্র কারণ এখন। সালমন পরামর্শ দিল, বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়া। দেখবি হাত নাই, পা নাই ভিক্ষুকরা আসবে, ছোট ছোট বাচ্চারা ফুল বেচতে আসবে, তাদের কষ্ট-দুঃখ দেখলে কান্না আসবে এমনিতেই। করেও ফল পাই নি। আমি কেন কাঁদব বলতে পারেন? আমি তাদের দেখার পর প্রথমেই মনে হয়েছে, এদের সাহায্য করা দরকার, যাতে তারা ভালো উপার্জনের উপায় খুঁজে পায়। আমি তাদের অনেকগুলো টাকা দিয়ে বিদায় করলাম, যা তাদের একবছরের ইনকাম হয়ত। কাঁদব কী? উল্টো নিজেকে পবিত্র অনুভব করলাম। অনেক সওয়াব কামাইছি, এমন মনে হলো। কান্না কি করে আসবে বলুন?

আমার জীবন কান্নাহীন এটা টের পেলাম, মেহেদী উল্লাহ’র এই গল্পটা পড়ার পর। তাঁর বৃদ্ধা চরিত্রটি আমার কান্নাকে উস্কে দিচ্ছে। অথচ আমার জীবনে কান্নার উপলক্ষই কখনো তৈরি হয় নি। কান্নার জন্য একান্ত একটা আশ্রয় দরকার জীবনে, এই গল্পটা না পড়লে বুঝতেই পারতাম না। আমি কবে কাঁদতে পারব জানি না। আমার কাঁদতে চাওয়ার ইচ্ছেটা হয়ত একটা লস প্রজেক্ট হবে শেষ পর্যন্ত। তবুও আমি কাঁদতে চাই। জানি না পারব কিনা। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন। জীবনে একটামাত্র কান্নার উপলক্ষ যাতে সৃষ্টি হয় সেজন্য আমি ফেসবুকেও নিয়মিত স্ট্যাটাস দিয়ে দোয়া চেয়ে যাচ্ছি বন্ধুদের। কান্নার একটা চান্স চাই মাত্র।
চলুন আপাদের মাঠে ফিরিয়ে নিয়ে যাই।

চার
বড় হয়ে সেই বৃদ্ধাকে মনে পড়ে, হঠাৎ হঠাৎ। কেন তিনি কাঠ বাদাম গাছের ছায়ায় ছাতা মাথায় বসতেন? চরম কৌতূহল আমাকে গ্রামের বাড়িতে দৌড়াতে দৌড়াতে নিয়ে গেল। যেখানে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনেও আমি গত দশ-পনের বছর ধরে যাই নি। শুনলাম, বৃদ্ধা আর নেই। অতি উৎসাহী কেউ কেউ বললেন, তিনি গত হয়েছে তিন বছর হলো, চলেন আপনাকে তাঁর কবর দেখিয়ে নিয়ে আসি।

এখন তাঁর ঘরের মানুষরাই একমাত্র উপায়। ঘরে তাঁর ছেলে-সন্তান কাউকেই পাওয়া গেল না। এক মহিলাকে পেলাম। তিনি নিজের পরিচয় দিলেন, আগে বৃদ্ধার দেখাশোনা করতেন, তিনি চলে যাওয়ার পর এই ঘরের দেখাশোনা করাই তার কাজ। বৃদ্ধার ছেলেরা এই মর্মে একমত হয়েছেন, তাকেই ঘরের দেখাশোনা করতে হবে।



বৃদ্ধা বাড়িতে একা। তার দেখা শোনার জন্য সাতজন লোক রেখেছেন তারা। এর মধ্যে সাহারাও একজন ছিলেন। ছেলেরা জানেন, বৃদ্ধা ফাঁক পেলেই কাঁদেন। এমনও দিন যায় সারা দিন কাঁদেন। তার কোনো অভাব নাই তবুও কাঁদেন। কেন কাঁদেন মা? সন্তানরা কারণ খুঁজে পায় না। বৃদ্ধার দেখা-শোনার জন্য যে সাতজন লোক রাখা হয়েছে ছেলেরা তাদের প্রত্যেককে আদেশ দিয়ে গেছে, তাদের মা যেন কখনোই কাঁদতে না পারেন তারা যেন সে ব্যাপারে সতর্ক থাকে। তারা বাড়ি এসে যদি শোনেন, মা কেঁদেছে, তবে চাকরি নট।



মহিলার কাছে জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা, খালাম্মা, আপনার কি মনে পড়ে, তিনি বেঁচে থাকতে এই কাঠ বাদাম গাছের ছায়ায় ছাতা মাথায় বসে থাকতেন? তার একটা কাকও ছিল। ’
মহিলা জবাব দিলেন, ‘হুম, ছিল তো, সে তো অনেক কথা। কেন, কী দরকার?’
আমি মহিলাকে নিজের পরিচয় দিতেই তিনি আমাকে জানালেন, আমাকে তার মনে পড়েছে, আমাকে তিনি ছোট দেখছেন, এখন নাকি চেহারা বদলে গেছে।
বসতে দিয়ে তারপর মহিলা/সাহারা খালাম্মা জানালেন ঘটনাটা।
বৃদ্ধার বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে। নয় কি দশ থাকতে। বৃদ্ধার স্বামী ছিলেন বোবা। যাই হোক, বোবা স্বামীকে নিয়ে সুখে দিন যাচ্ছিল। একে একে সাত সন্তানের মা হলেন তিনি। হঠাৎ স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেলেন। এরপর বৃদ্ধা অনেক পরিশ্রম করে সাত সন্তানকে বড় করেছেন। পড়াশোনা করিয়েছেন তারা যাতে ভালো চাকরি পায়। বৃদ্ধার স্বামী অবশ্য পৈতৃকসূত্রে অনেক জমি-জমা রেখে গেছেন, তাই দিন চলে গেছে।

সন্তানরা চাকরি-বাকরি ধরার পর সবাই শহরে থাকে। বৃদ্ধা বাড়িতে একা। তার দেখা শোনার জন্য সাতজন লোক রেখেছেন তারা। এর মধ্যে সাহারাও একজন ছিলেন। ছেলেরা জানেন, বৃদ্ধা ফাঁক পেলেই কাঁদেন। এমনও দিন যায় সারা দিন কাঁদেন। তার কোনো অভাব নাই তবুও কাঁদেন। কেন কাঁদেন মা? সন্তানরা কারণ খুঁজে পায় না। বৃদ্ধার দেখা-শোনার জন্য যে সাতজন লোক রাখা হয়েছে ছেলেরা তাদের প্রত্যেককে আদেশ দিয়ে গেছে, তাদের মা যেন কখনোই কাঁদতে না পারেন তারা যেন সে ব্যাপারে সতর্ক থাকে। তারা বাড়ি এসে যদি শোনেন, মা কেঁদেছে, তবে চাকরি নট। এমন আদেশের পর বৃদ্ধা যাতে আর না কাঁদে সেজন্য তারা পাহারা দিয়ে রাখত, নানা ব্যবস্থা রাখত।

এটুকু জানা গেল, একটা সন্তান হয় বৃদ্ধা আশা করেন, এইবার বোধহয় তার স্বামী কথা বলবেন, পরেরটা হয়, ভাবেন, এইবার বোধহয় মুখ খুলবেন, এর পরেরটা হয়, ভাবেন এইবার বোধ হয় মুখ ফুটে তার নাম ধরে ডাকবেন, সাত সন্তানের পর কোনো কথা তো হলোই না তাদের, উল্টো স্বামী স্ত্রীর মুখ বন্ধের ব্যবস্থা করলেন!

শেষ সন্তান রুমার গায়ে-হলুদে বৃদ্ধা নেচেছিলেন। আনন্দ বলতে এইটুকুই তাঁকে করতে দেখেছেন তারা।

বৃদ্ধার মৃত্যুর পরও ছেলেরা বাড়ি এসে প্রথমে তাদের জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা আর কেঁদেছেন কখনো?’ সবাইকে আলাদা করে জিজ্ঞেস করা হলেও উত্তর একই পাওয়া গিয়েছিল, ‘না। ’

বেলা বাড়লে কাকটা বাসা ছাড়ত। বেলা পড়লে কাকটা ফিরে কাঠ বাদামের ডালে ঝপাৎ করে দু’পা ছড়িয়ে কা কা ডাকলে বৃদ্ধা ঘরে যেতেন। কেমন সিগনাল?

বৃদ্ধা ছাতার তলে লুকিয়ে কি খুব কাঁদতেন? হয়ত কাঁদতেন। কেউ ভয়েই দেখতে যেত না। যদি সত্যিই কেঁদে থাকেন তবে ছেলেদের কাছে কী জবাব দেবেন তারা। অনেক শোক ছিল নাকি তাঁর।

সন্তানসৃষ্ট বাধ্যতামূলক চির আনন্দের পাশে কান্নার নিমিত্তে একটা কাঠ বাদামের ছায়া থাকলেই তৃপ্তির শোক আসে মায়ের জীবনে। কাঠ বাদামের ছায়ায় ছাতা মাথায় বাঁশের বেঞ্চিতে বসে বৃদ্ধার শোক উদযাপন ভোলা যায়?

তাঁকে মনে পড়ে!



বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।