ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (খণ্ড ৩ কিস্তি ১০) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৫
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (খণ্ড ৩ কিস্তি ১০) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

George_Orwell_inner১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।

২০০৪ সালে ‘দি গার্ডিয়ান’র জরিপে উপন্যাসটি বিশ্বের চিরায়ত গ্রন্থের তালিকায় উঠে আসে সবার উপরে। ইংরেজি ভাষার এই উপন্যাসটি কালজয়ী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। যাতে ফুটে উঠেছে সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি, যুদ্ধ, শান্তির প্রেক্ষাপট। বাংলানিউজের জন্য বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন মাহমুদ মেনন। উল্লেখ্য, জর্জ অরওয়েলের মূল নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার। ১৯০৩ সালের ১৫ জুন ব্রিটিশ ভারতের বিহার রাজ্যের মথিহারিতে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন লন্ডনে ১৯৫০ এর ২১ জানুয়ারি। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘দি রোড টু উইগ্যান পাইয়ার’, ‘হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া’, ‘এনিম্যাল ফার্ম’।

___________________________________

শুরু থেকে পড়তে ক্লিক করুন

তৃতীয় খণ্ডের ৯ম কিস্তি
___________________________________


দ্বিতীয় অধ্যায় |
পিঠ বলছে যার ওপর শুয়ে আছে সেটি ক্যাম্প খাট গোছের কিছু হবে, মেঝে থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে, আর শরীরটাকে এমনভাবে আটকে রাখা হয়েছে যাতে সে নড়তেও না পারে। সাধারণের চেয়েও একটি শক্তিশালী আলো তার মুখমণ্ডলের ওপর। পাশে ও’ব্রায়েন দাঁড়িয়ে, গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। অন্যপাশে সাদা কোট পরা একজন দাঁড়িয়ে, হাতে একটি ইনজেকশন সিরিঞ্জ।

চোখ খোলা থাকলেও আশেপাশের অবস্থাটা বুঝে উঠতে সময় লাগল। মনে হচ্ছিল কোনো এক ভিন্ন জগৎ থেকে সাঁতরে এই কক্ষে এসেছে সে, পানির তলদেশেরও অনেক গভীরের কোনো জগৎ থেকে। ওই গভীরতায় কতটা সময় তলিয়ে ছিল তার জানা নেই। গ্রেপ্তার হওয়ার পর এপর্যন্ত কোনো আঁধার সে দেখেনি, দেখেনি দিনের আলোও। তার স্মৃতিও সবকিছু ধারাবাহিক ধরে রাখতে পারছে না। কখনো কখনো চেতনা, ঘুমের মাঝেও যে চেতনাটুকু জাগরূক থাকে, মৃত্যুসম লোপ পেয়ে যায়, আবার জেগে ওঠে শূন্যতা ভরা বিরতিতে। তবে সেই বিরতি কয়েক দিনের, কয়েক সপ্তাহের নাকি কয়েকটি ক্ষণের তা বোঝার পথ নেই।



অপরাধের অন্ত নাই—ষড়যন্ত্র, নাশকতা আর এমন আরো অনেক—যা প্রত্যেককেই এক পর্যায়ে স্বীকার করে নিতে হবে। এই স্বীকারোক্তি স্রেফ এক আনুষ্ঠানিকতা, তবে নির্যাতন অবশ্যই এক বাস্তবতা। কতবার তাকে প্রহার করা হয়েছে, কতক্ষণ ধরে চলেছে সে প্রহার, সে মনে করতে পারে না। প্রতিবারই পাঁচ/ছয় জন কালো ষণ্ডামার্কা উর্দিধারী তাকে ঘিরে সক্রিয় হয়েছে। কখনো খালি হাতে কিল-ঘুষি, কখনো লাঠি কিংবা ইস্পাতের রড দিয়ে বেদম প্রহার, কখনো শক্ত বুটে কষে লাথি।



সেই যে, কনুইয়ে প্রথম আঘাত পড়ল তখন থেকেই দুঃস্বপ্নের শুরু। পরে সে অবশ্য বুঝতে পারে এই যা কিছু ঘটছে তা স্রেফ শুরু মাত্র, সব কয়েদীর ক্ষেত্রেই জিজ্ঞাসাবাদের এ এক সাধারণ প্রাথমিক প্রক্রিয়া। অপরাধের অন্ত নাই—ষড়যন্ত্র, নাশকতা আর এমন আরো অনেক—যা প্রত্যেককেই এক পর্যায়ে স্বীকার করে নিতে হবে। এই স্বীকারোক্তি স্রেফ এক আনুষ্ঠানিকতা, তবে নির্যাতন অবশ্যই এক বাস্তবতা। কতবার তাকে প্রহার করা হয়েছে, কতক্ষণ ধরে চলেছে সে প্রহার, সে মনে করতে পারে না। প্রতিবারই পাঁচ/ছয় জন কালো ষণ্ডামার্কা উর্দিধারী তাকে ঘিরে সক্রিয় হয়েছে। কখনো খালি হাতে কিল-ঘুষি, কখনো লাঠি কিংবা ইস্পাতের রড দিয়ে বেদম প্রহার, কখনো শক্ত বুটে কষে লাথি। মাঝে মাঝে সে কুঁকড়ে মেঝেতে পড়ে থেকেছে, পশুর মতো গড়াগড়ি খেয়েছে, আর শরীরকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে একেকটি লাথি আর লাঠিপেটা থেকে নিজেকে রক্ষা করার অবিরাম, নিষ্ফল চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আর তার ফল হিসেবে পেয়েছে আরো লাথি, পেট, পাঁজর, কনুই, জঙ্ঘা, কুঁচকি, অণ্ডকোষ, মেরুদণ্ডের মূল হাড়—কোনোটিই বাদ যায়নি। কখনো কখনো যখন এমনটা চলতে থাকত তখন তার কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, বাজে আর অক্ষমার্য বলে মনে হতো একটি বিষয়কে, তা হচ্ছে—রক্ষীরা তাকে পেটাচ্ছে কিন্তু এরপরেও সে অচেতন হয়ে যাচ্ছে না, কিংবা নিজেকে অচেতন করে ফেলতেও পারছে না। কখনো কখনো মস্তিষ্কানুভূতি তাকে এতটাই ছেড়ে চলে যেত যে সে ক্ষমার জন্য চিৎকার করতে থাকত। এমনকি মারধর শুরুর আগেই চিৎকার জুড়ে দিত। একেকটি ঘুষির জন্য হাত পাকানো দেখেই তার মন বাস্তব আর কল্পিত সকল অপরাধের জন্য স্বীকারোক্তি দিতে প্রস্তুত হয়ে যেত। আবার অন্যকোনো সময় সে সাব্যস্ত করে ফেলত—কিছুই স্বীকার করবে না। কষ্ট আর বেদনার্ততার মাঝ থেকেও একটি শক্তি বেরিয়ে আসত। আবার অন্যসময়, যখন কিছুটা দুর্বলচিত্ত হয়ে পড়ত, তখন নিজেই নিজেকে বলত, ‘স্বীকারোক্তি দেব, তবে এখনই নয়। এই যন্ত্রণা যতক্ষণ না পুরোপুরি অসহনীয় হয়ে পড়ে ততক্ষণ আমাকে শক্তি ধরে রাখতে হবে। আরো তিনটি লাথি, আরো দুটি লাথি বসবে, তারপর আমি সেই কথা বলব যা ওরা শুনতে চায়। ’

কখনো কখনো ওরা পেটাতে পেটাতে তার চলৎশক্তিটুকুও কেড়ে নিত, আর আলুর বস্তার মতো তাকে কোনো একটি কয়েদখানার মেঝেতে ছুড়ে ফেলে যেত, যাতে অবসাদ কাটিয়ে উঠতে পারে এরপর আবারও বের করে এনে আর আবারও পূর্ণোদ্যমে প্রহার শুরু করতে পারে। মাঝে মাঝে সময়টা একটু বেশিই পাওয়া যেত। তবে সেসময়ের কথা অতি অল্পই মনে পড়ে কারণ সে সময়টুকু ঘুমে কিংবা সংজ্ঞাহীনতায় কেটেছে তার। একটি কয়েদখানার কথা মনে পড়ে সেখানে ছিল তক্তার বিছানা, দেয়ালে ঝুলে থাকা তাকিয়া, টিনের বেসিন। খাবার হিসেবে পেত গরম স্যুপ, রুটি, কখনো কখনো কফিও মিলত। তার মনে আছে খিটমিটে মেজাজের এক নাপিত আসত দাঁড়ি কামিয়ে দিতে আর চুল কাটতে, আর কারবারিদের মতো দেখতে, অসহমর্মী সাদা কোটধারী লোকগুলো আসত কখনো নাড়ি দেখতে, তার ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়াগুলো যাচাই করতে, চোখের পাতা উল্টে, কর্কশ আঙুলগুলো দিয়ে ভাঙা হাড়গুলোর ওপর নির্মমভাবে ঘষাঘষি করে তারা দেখত আর পেশিতে সুঁই ফুটিতে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখত।

তৃতীয় খণ্ডের ১১তম কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।