ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নানীর বাড়ি, রানীর বাড়ি | শাকুর মজিদ

ধারাবাহিক ভ্রমণ ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৫
নানীর বাড়ি, রানীর বাড়ি | শাকুর মজিদ

স্থপতি, লেখক ও পর্যটক শাকুর মজিদ ২২ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের লন্ডন ও আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। তাঁর এ সফরের বিবরণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হবে বাংলানিউজের সাহিত্য পাতায়।

আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

          টেক অফ টু লন্ডন |
টনা ঘটেছিল ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে, যখন আমেরিকান এম্বেসির ভিসা কর্মকর্তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম আমরা চার জন। এই প্রথম পরিবারের লোকজনকে সঙ্গে করে ভিসা অফিসারের মুখোমুখি হবার মতো কোনো ঘটনা। এর আগে একা একা কিংবা আমাদের পঞ্চপর্যটক দলের সঙ্গে দাঁড়ানো। সেখানে তেমন কোনো প্রশ্নের জবাব আমাকে দিতে হতো না। জমা দেয়ার সময় সঙ্গে থাকতাম, পিছে। কখনো কিছু কাগজপত্র দেখতে চেয়েছে, দিয়ে দিয়েছি। একবার একা দাঁড়িয়েছি ফ্রেঞ্চ এম্বেসিতে, ভিসা অফিসার তো আমার কণ্ঠস্বরই শুনতে চাইলেন না, টোকেন ধরিয়ে দিলেন।

এবার কী হবে?

ভিসা না পেলে না হয় আমেরিকা যাওয়া হবে না, তাতে আমি যে একবারে পানিতে পড়ে যাব, এমন কোনো কারণ নাই। কিন্তু পরিবারের সামনে লজ্জা পাওয়ার আশঙ্কা আমাকে বেশ নার্ভাস করে ফেলেছিল।

ভিসা কর্মকর্তা আমাদের ৪ জনের পাসপোর্ট একসঙ্গে হাতে নিয়ে জিগ্যেস করেন, “হু ইস দ্য প্রিন্সিপ্যাল এপ্লিক্যান্ট?”

আমি বললাম, ইয়েস, ইটস মি।

এরপর আমার পাসপোর্টের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় প্রশ্ন করেন, “আপনি কেন আমেরিকা যেতে চান?”



পঞ্চাশের দশক থেকে আমার নানা লন্ডনে থাকেন। সত্তরের দশক পর্যন্ত তাঁর এমন কোনো চিন্তা ছিল না যে, তাঁর পরিবারকে নিয়ে তিনি লন্ডনে থাকবেন। তিনি পরহেজগার লোক, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন, আর সপ্তাবারে তলফ পেলে পোস্টাফিসে চলে আসেন মানি অর্ডারের জন্য। লন্ডনকে তিনি খুব বিশ্বাস করতেন না, ওখানকার ব্যাংকে টাকা রাখাও নিরাপদ মনে হতো না, নিজের কাছেও না। মাসে মাসে টাকা আসতে থাকে আর কিয়ারের পর কিয়ার জমি কেনা হতে থাকে। এই কাহিনী চলতে থাকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত...



আসলে কী কারণে যেতে চাই, এটা আমার কাছেও পরিষ্কার না। এক গাঙ্গে আমি দুইবার স্নান করতে চাই না। আমেরিকা যে কী রসগোল্লা, আমার দেখা হয়েছে ২০০১ সালে। কিন্তু এটা বলে আমি আমার ঘরে শান্তি পাই না। আমাকে নানা রকমের আক্রমণাত্বক প্রশ্নবানে জর্জরিত করা হয়। যেমন, আমরা তো তোমার কেউ না, তোমার বন্ধুরাই সব। কিংবা, জগতের এত বিচিত্র কিছু একা একা দেখে কী আনন্দ পাও?—এসব।

হঠাৎ কী মনে করে তাই ভিসা সাহেবকে বললাম, (ইংরেজিতে) “আমি আমেরিকাসহ প্রায় তিরিশটি দেশে গিয়েছি, পৃথিবীর প্রায় এক চতুর্থাংশ আমার দেখা। কিন্তু পরিবারের সবাইকে নিয়ে মাত্র ৩/৪টা দেশে গিয়েছি, এজন্য ঘরে আমার অশান্তি। ওদেরকে আমেরিকা দেখাতে চাই। ”

এই বলে আমার স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলাম।

গম্ভীর মুখে তাকালেন ভদ্রলোক।

আমার স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন, আপনার প্রিয় লেখক কে? বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করা হলো স্কুলের নাম, কে কোন ক্লাসে পড়ে, এই।

আমি প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম, একটা কিছুও দেখানোর সুযোগ হলো না। ভদ্রলোক অভিনন্দন জানিয়ে পরদিন পাসপোর্ট ফেরত নেয়ার টোকেন ধরিয়ে দিলেন।

পরদিন পাসপোর্ট দেখে আমার কনিষ্ঠ পুত্র নাচানাচি শুরু করে দিল। পাঁচ বছরের মাল্টিপল ভিসা। বাবা, আমরা কবে যাব আমেরিকা?

আমি খালি পিছলাই। বলি, সামনে পরীক্ষা তোমার। আরেকবার বলি, এখন খুব শীত। প্রায় দেড় বছর পার করলাম এই নিয়ে। এবার রোজার ঈদের সময় বলে, সামনের কোরবানি ঈদে আমরা কিন্তু যাচ্ছি তুমি ব্যবস্থা করো।

আমেরিকায় আছে আমার ছোট বোন। সে সমানে তাল দিতে লাগল। তালাতালির খবর চলে গেল লন্ডন, আমার নানী বাড়িও। বলা হতে থাকল যে, লন্ডনের ভিসা লাগাও, আমেরিকা যাবার পথে লন্ডন থেকে যেতে হবে। ঈদ হবে লন্ডনের নানা বাড়ি।

পঞ্চাশের দশক থেকে আমার নানা লন্ডনে থাকেন। সত্তরের দশক পর্যন্ত তাঁর এমন কোনো চিন্তা ছিল না যে, তাঁর পরিবারকে নিয়ে তিনি লন্ডনে থাকবেন। তিনি পরহেজগার লোক, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন, আর সপ্তাবারে তলফ পেলে পোস্টাফিসে চলে আসেন মানি অর্ডারের জন্য। লন্ডনকে তিনি খুব বিশ্বাস করতেন না, ওখানকার ব্যাংকে টাকা রাখাও নিরাপদ মনে হতো না, নিজের কাছেও না। মাসে মাসে টাকা আসতে থাকে আর কিয়ারের পর কিয়ার জমি কেনা হতে থাকে। এই কাহিনী চলতে থাকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত, যখন তাঁর বিবাহিত তিন মেয়ে ছাড়া অবিবাহিত আরো তিন কন্যা ও দুই কিশোরপুত্রকে নিয়ে তিনি লন্ডন যান।

সেই পরিবারটি এখন অনেক বড় হয়েছে। নানা-নানী মারা গেছেন। সেই কিশোরপুত্র, আমার বড় মামা এখন ষাটের কাছাকাছি। তিনিও এখন নানা ও দাদা। এক সময় পূর্ব লন্ডনের ৪৬ নর্টন হাউজে সবাই মিলে ছিলেন, এখন সবাই আলাদা, যে যার মতো থাকে। নানা-নানী তাঁদের যে তিন বিবাহিতা কন্যাকে শ্বশুরবাড়ি রেখে গিয়েছিলেন, তাঁদের পুত্ররাও নানাভাবে পাড়ি দিয়ে বসত করেছে রানীর দেশে। এখন লন্ডনের রানীর বাড়ি হয়ে গেছে আমাদের নানীর বাড়ি। কুড়িটির মতো পরিবার। আমি একা একা ওখানে গিয়েছি নয়বার, এবার সন্তানদের দেখাব বলে আজ সকালে উড়াল দেব। এবার অন্যরকমের একটা ঈদ পালন হবে, এটা মনে করে আমি রোমাঞ্চিত বোধ করি।

২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫। ঢাকা



বাংলাদেশ সময়: ১৪৩১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।