মনিপুরীগণ হিন্দু বৈষ্ণব। ধারণা করা হয় বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের বহুপূর্ব থেকেই এরা হিন্দুধর্মে এসেছে।
রাসলীলা মনিপুরীদের কাছে পরমতম ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠান। তাই এটি তাদের প্রধানতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। রস শব্দ থেকে রাসের উৎপত্তি। যার দ্বারা রস জন্মায় তাই রাস। বৈষ্ণব সাহিত্যে ১২ প্রকার রসের কথা বলা হয়েছে। যথা—শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মাধুর্য, হাস্য, অদ্ভুত, বীর, করুণ, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীভৎস। ‘ভক্তিরসামৃত সিন্ধু’ গ্রন্থে প্রথম পাঁচটি ভক্তিরসকে মুখ্য ও শেষের সাতটিকে গৌণরস বলা হয়েছে। মনিপুরী নৃত্যের প্রথম ও প্রধান সৃষ্টি মহারাস। এজন্য একে মহা রাসলীলাও বলা হয়।
মহারাসের শুভ সূচনা হয় নটপালা কীর্তন দিয়ে। প্রথম পর্বে পূর্বরঙ্গ অর্থাৎ মঞ্চে ধূপ, দ্বীপ, পান, তাম্বুল ইত্যাদি দ্বারা পূজা করা হয়। দুজন মৃদঙ্গধারী ও পাঁচজন করতাল বাজিয়ে মৃদঙ্গের মহারাস নটপালা সংকীর্তন আরম্ভ করেন। নৃত্যশিল্পীরা ধবধবে সাদা ধূতি, কাধে-সাদা চাদর এবং মাথায় পাগড়ি পরেন। মৃদঙ্গ বাদকরা ছোট পাগড়ি পারেন। এই পাগড়িকে ‘কয়েট’ বলা হয়। কীর্তন আরম্ভ হওয়ার আগে রাসধারী সমস্ত শিল্পী ও পণ্ডিত ব্রাহ্মণকে ফুল, চন্দন, পান ও শুভ্র বস্ত্র দিয়ে বরণ করে প্রণাম করেন। এভাবে মঞ্চপতি দাঁড়িয়ে মঙ্গলসূচক বাণী উচ্চারণ করেন। এরপর সংকীর্তন আরম্ভ হয়
শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের রাসপঞ্চাধ্যায়ীর আধারে মহারাস সৃষ্টি হয়। রাস পঞ্চাধ্যায়ী মতে, শারদীয় পূর্ণিমা তিথীতে শ্রীধাম বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ গোপীদেরকে নিয়ে যমুনা পুলিন বনে সর্বাধিক রহস্যপূর্ণ লীলাটি খেলেছিলেন। শ্রীমদ্ভাগবত দুই প্রকারের রাসলীলার উল্লেখ করেছেন। ০১. রাসমণ্ডলে প্রিয়তমের সাথে গোপীগণের মিলন, এটা দৈহিক রাসলীলা, ০২. গৃহ শ্রীকৃষ্ণ ধ্যানেরত গোপীগণের প্রিয়তমের সাথে মানসে মিলন, এটা আধ্যাত্মিক মিলন।
মহারাস অনুষ্ঠানে পূর্বরঙ্গ হিসাবে সর্বপ্রথম নটপালা আবশ্যক। মনিপুরীদের সকল সমাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই ‘নটপালা’ অবশ্যকরণীয়।
মহারাসের শুভ সূচনা হয় নটপালা কীর্তন দিয়ে। প্রথম পর্বে পূর্বরঙ্গ অর্থাৎ মঞ্চে ধূপ, দ্বীপ, পান, তাম্বুল ইত্যাদি দ্বারা পূজা করা হয়। দুজন মৃদঙ্গধারী ও পাঁচজন করতাল বাজিয়ে মৃদঙ্গের মহারাস নটপালা সংকীর্তন আরম্ভ করেন। নৃত্যশিল্পীরা ধবধবে সাদা ধূতি, কাধে-সাদা চাদর এবং মাথায় পাগড়ি পরেন। মৃদঙ্গ বাদকরা ছোট পাগড়ি পারেন। এই পাগড়িকে ‘কয়েট’ বলা হয়। কীর্তন আরম্ভ হওয়ার আগে রাসধারী সমস্ত শিল্পী ও পণ্ডিত ব্রাহ্মণকে ফুল, চন্দন, পান ও শুভ্র বস্ত্র দিয়ে বরণ করে প্রণাম করেন। এভাবে মঞ্চপতি দাঁড়িয়ে মঙ্গলসূচক বাণী উচ্চারণ করেন। এরপর সংকীর্তন আরম্ভ হয়। এটি শেষ হওয়ার পর নৃত্যগুরু ও সহকারী ছোট রাগ বাজিয়ে রাসের আরম্ভ করেন। দুজন সূত্রধারী হাতে মঞ্জিলা নিয়ে তাল রক্ষা করেন। শঙ্খবাদক শঙ্খ বাজান। রাসধারী সমস্ত গুরু, সূত্রধারী, শিল্পী ও যন্ত্রবাদকদের পান, তাম্বুল ও শুভবস্ত্র দিয়ে বরণ করে ভক্তিভরে প্রণাম করেন। মঞ্চকে পবিত্র করা হয় মৃদঙ্গে ছোট রাগ বাজিয়ে।
মণিপুরীরা বিশ্বাস করেন, ‘রাসলীলায় শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে লীলা করেছিলেন। সেই লীলার কথা যে মানুষ অসীম ধৈর্য ও ভক্তির সঙ্গে শোনেন তিনি প্রাজ্ঞ ও ধীর হয়ে ওঠেন। হৃদয়ে পরমপুরুষের প্রতি ভক্তি জাগ্রত হয় এবং হৃদয়ের কাম, লালসা, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি রিপুগুলোর বিনাশ ঘটে। ’
মহারাসের সংক্ষিপ্ত কাহিনীটি মেলে ড. রণজিত সিংহের ‘বাংলাদেশের মণিপুরী সমাজ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থটিতে। কাহিনীটি:
শরৎ পূর্ণিমায় শোভামুগ্ধ শ্রীকৃষ্ণ যমুনা পুলিনের কাছে এক উপবনে মুরলী বাদনে রত হলেন। নানা কাজে মগ্ন গোপীদের কর্ণে অকস্মাৎ সেই মুরলী রবে শ্রীকৃষ্ণের আহ্বান প্রবেশ করল। তখন সে গোপকন্যারা যে যে অবস্থায় ছিলেন, সেই অবস্থাতেই জগতের সবকিছু বিস্মৃত হয়ে শ্রী কৃষ্ণের সাথে মিলনাকাঙ্ক্ষায় অভিসার করলেন। শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধা ও অন্য গোপীদের মিলন ব্যাকুলতা দর্শনে তাঁদের আপন আপন গৃহে ফিরে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলেন এবং তাঁদের বললেন যে, নারীর ধর্ম পতিপুত্র পরিজনাদির সেবা করা, তাছাড়া রাত্রিকালে পথ মধ্যে বন্যপ্রাণীর ভয় এবং লোকের অপবাদের আশংঙ্কা থাকে। সখীদের প্রতি রাধার গান ও নৃত্য—
বাঁশি বাজল বাজল সখী নির্জন বিপিনে
ঘরে রইতে নারি প্রাণ নিল আকর্ষণে
এধু তত্ত্ব দিয়া বাঁশি জাদু করিল
প্রাণ তত্ত্ব দিয়া বাঁশি ঢাকিয়া রাখিল...
কৃষ্ণের উপদেশে বিষণ্ণচিত্তা গোপীরা বললেন যে, গোবিন্দই তাদের একমাত্র আশ্রয়। তাঁর সান্নিধ্য বিনা তারা প্রাণত্যাগ করবেন। তাই এরকম নিষ্ঠুর বাক্য যেন তিনি প্রয়োগ না করেন। সংসার ও সমাজের সকল বিষয়ে তাদের নৈরাশ্য। তাঁরা কেবলমাত্র কৃষ্ণচরণাশ্রিতা হয়ে থাকতে চান। তখন ভক্তবাঞ্চা কল্পতরু শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের এই বিশেষ অনুরক্তি দর্শনে প্রীত হয়ে আলিঙ্গনাদির পর তাঁদের সাথে নৃত্যারম্ভ করলেন। গোপীরা শ্রীকৃষ্ণ সান্নিধ্যে এসে আমরাই শ্রেষ্ঠ—এই ভেবে গৌরববোধ করলেন। তখন তাঁদের অহঙ্কার দেখে দর্পহারী শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে নিয়ে অকস্মাৎ রাসমণ্ডল থেকে অন্তর্হিত হলেন। শ্রীকৃষ্ণের অদর্শনে ব্যাকুল হয়ে গোপীরা শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্ন অনুসরণ করে অনুসন্ধানে রত হলেন। পথ মধ্যে প্রতিটি বৃক্ষলতা, পশু-পাখি সকলকে তারা শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। অতিশয় তন্ময়ভাবে ফলে নিজেরাই কৃষ্ণময় হয়ে গেলেন এবং নিজেদেরই কৃষ্ণ ভেবে শ্রী কৃষ্ণের বাল্যলীলার অনুসরণ করে নৃত্য করতে লাগলেন।
অপরদিকে কৃষ্ণের সঙ্গে চলতে চলতে শ্রীরাধা নিজেকে সৌভাগ্যশালিনী ভেবে গর্বান্বিত হলেন এবং তাঁকে শ্রীকৃষ্ণ স্কন্ধে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলে রাধার গর্ব-হরণের জন্য অন্তর্হিত হলেন। সহসা কৃষ্ণহারা রাধা বিলাপ করতে করতে মূর্চ্ছিতা হলেন।
এদিকে কৃষ্ণকে খুঁজতে খুঁজতে সখীর দল পথিমধ্যে শ্রীরাধাকে মূর্চ্ছিতা হয়ে পড়ে থাকতে দেখে কৃষ্ণধ্যান ও বিলাপ করতে লাগলেন। দয়াপরবশ হরি তাঁদের হৃত গৌরবদশা দেখে দর্শন দিলেন। মায়াবলে বহুরূপ ধারণ করে প্রত্যেক গোপীর পাশে নিজেকে স্থাপন করলেন। তারপর সকলে মিলে মহানন্দে রাসনৃত্যে মগ্ন হলেন। এরপর ‘এক গোপী এক শ্যাম’ নৃত্যাংশটি পরিবেশিত হয়। নৃত্যের শেষে শ্রীকৃষ্ণের বচনানুসারে সকলে গৃহগমন করেন। মহারাস কার্তিক পূর্ণিমাতে অনুষ্ঠিত হয়। কৃষ্ণ অভিসার, গোপী অভিসার করে কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে ভঙ্গীপারেং নৃত্য হয়; এবং শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান, গোপীদের কৃষ্ণকে খোঁজা, রাধার নৃত্য, চন্দ্রাবলির নৃত্য ও রাধারমণের ভজন করে, যুগলমূর্তি বন্দনা, প্রার্থনা ও ফুল প্রদান করে, যুগল আরতি করে, গৃহে গমন করে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।
** কারাম উৎসবের অন্তরালগদ্য
** তুরি পাড়ার ধাঁধার আসরে
** ওয়ানগালার মিথ
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৫