ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বধ্যভূমি | তুষার আবদুল্লাহ

মুক্তিযুদ্ধের গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
বধ্যভূমি | তুষার আবদুল্লাহ

নিজের বসতবাড়িটাকে বর্ষায় নক্ষত্রের জলে ভাসা পদ্মের মতো মনে হয়। হেমন্তে সোনালি শরীরে দ্যুতি ছড়ানো প্রবাল।

আর এই শীতে আগুনরঙা জমিনে সবুজ দ্বীপ। পেরাকান্দি গ্রামের ধোপাবাড়ির উঠান ও ওর বসতবাড়ি দেখা যায়। নক্ষত্র যখনই গ্রামে আসে, তখন ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে গ্রামটাকে দেখে। গ্রামে ঢোকার প্রথম বাড়িটাই ওদের। গ্রাম দেখা মানে নিজের বসতবাড়ি দেখা। গ্রামের ভেতর থেকে এমন করে দেখা হয় না। বাইরের দিকের আলাদা ঝলকানি আছে। আছে শীতলতাও। অন্দরের ভেতরে থেকে হয়ত সেটা অনুভব করা যায় না। অনেক সত্য ভেতরবাড়িতে ভেসে বেড়ায়। এক সত্যের সঙ্গে অন্য সত্যের সংঘর্ষে হয় অগ্নুৎপাত। যে অগ্নুৎপাতে ঝলসে যেতে হয়। নক্ষত্র নিজেই কতবার ঝলসে গেছে। ঝলসানো মন নিয়ে আবার সত্যের মুখোমুখি হয়েছে, ফিরে পেতে চেয়েছে হারানো লাবণ্য।



দাদুর কাছ থেকেই জানা, বড়খালু  মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এ বাড়িতে কাটিয়ে গেছে। যেন অবকাশে এসেছিলেন। খালা ও বড় মেয়েকে নিয়ে ভালোই আনন্দ ফুর্তিতে ছিলেন। দিনভর গ্রামের যুবকদের সঙ্গে তাস পিটিয়েছেন, রাতে মুরগী বা ছাগল জবাই করে খেয়েছেন। নাটক, যাত্রা-পালার আয়োজনও ছিল। ওদের গ্রাম থানাশহর থেকে অনেক দূরে। খাল-নদী পেরিয়ে এদিকটায় পাক হানাদার বাহিনী নয় মাসে এসে পৌঁছতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ গ্রামে খুব একটা  লাগেওনি। ঢাকা বা অন্য শহর থেকে যারা এসেছিল গ্রামে, তারা ফুর্তিতেই ছিলেন



দাদা ওকে প্রায়ই বলতেন—সব লাবণ্যেই কালোদাগ থাকে। সেই কালোদাগ ঢেকে রাখে দ্যুতির আলো। ক্ষণস্থায়ী দ্যুতিটাকেই মানুষ চিরন্তন ধরে নেয়। এখানেই নাকি মানুষের পরাজয়। নক্ষত্র গুড়ের বাতাসা খাচ্ছে ক্যান্ডির মতো করে চুষে। ঢাকা ছেড়ে আসার সময় আজ কুয়াশা ঢেকে ছিল। এখানে কুয়াশা নেই। গোধূলি বেলাতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নক্ষত্রদের বাড়িটা। এক সময় কুয়াশার সঙ্গে পুরো গ্রাম থেকেই ধোঁয়ার রেখা বেরিয়ে আসত। তখন কোনটা কুয়াশা আর কোনটা চুলোর ধোঁয়া বুঝে ওঠা কষ্টকর হতো। আজও দুই একটা রেখা দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার। গ্রাম বুঝি সন্ধ্যা-সাঁঝে রাঁধতে বসার অভ্যাসটাও ভুলতে বসেছে। নক্ষত্র নিজেকে নিয়ে ভাবে। কত কিছুই তো ভুলে যেতে চেয়েছিল নিজে থেকে। কিন্তু ভুলতে পারেনি। আবার যা মনে রাখতে চেয়েছে চিরন্তন করে, সেগুলো এখন স্মৃতিপটে নেই। কোন ইরেজার দিয়ে যে কে মুছে দিল! নক্ষত্র একবার ভাবে গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করবে, তারপর ইচ্ছে করে রাতে জমির আইল ধরে হেঁটে যেতে। কতদিন এমন করে যাওয়া হয় না। আকাশে চাঁদ নেই তাতে কী, তারাদের সমাবেশ তো আছে।

নক্ষত্র অপলক তাকিয়ে থাকে ওদের বসতবাড়ির দিকে। রহস্যঘেরা এই বাড়িটি। মানুষগুলোও। একেকজন একেক চরিত্র নিয়ে, লাবণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নক্ষত্র এখন সবার মুখচ্ছবির মাঝে ছড়িয়ে থাকা কালোদাগগুলো স্পষ্ট দেখতে পায়। ওর দাদা ওকে ধরে ধরে সেই দাগগুলো চিনতে শিখিয়েছে। বড়খালুর সারা মুখ জুড়েই তো কালসিটে দাগ। ফোঁটা ফোঁটা নয়, একেবারে পুরো মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে সেই দাগ। দাগগুলো নক্ষত্রই দেখতে পায়। অন্যরা বড়খালুর লাবণ্যচ্ছটায় মুগ্ধ। দাদুর কাছ থেকেই জানা, বড়খালু  মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এ বাড়িতে কাটিয়ে গেছে। যেন অবকাশে এসেছিলেন। খালা ও বড় মেয়েকে নিয়ে ভালোই আনন্দ ফুর্তিতে ছিলেন।

দিনভর গ্রামের যুবকদের সঙ্গে তাস পিটিয়েছেন, রাতে মুরগী বা ছাগল জবাই করে খেয়েছেন। নাটক, যাত্রা-পালার আয়োজনও ছিল। ওদের গ্রাম থানাশহর থেকে অনেক দূরে। খাল-নদী পেরিয়ে এদিকটায় পাক হানাদার বাহিনী নয় মাসে এসে পৌঁছতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ গ্রামে খুব একটা লাগেওনি। ঢাকা বা অন্য শহর থেকে যারা এসেছিল গ্রামে, তারা ফুর্তিতেই ছিলেন। অনেকে ছেলে-মেয়ের কাজটাও সেরে নিয়েছিলেন এই সময়টায়। তাই মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নক্ষত্রদের গ্রাম উৎসবের গ্রামে রূপ নিয়েছিল। ওর বাবা-মায়ের বিয়েও নাকি ওই সময়েই হয়। ভেবে নিজে লজ্জিত হয় নক্ষত্র। ঘৃণার চোখে তাকায় বাবার দিকে। বাবার বয়সী তরুণ-যুবারা যখন রণক্ষেত্রে জীবনবাজি রাখছে, বাবা তখন বিয়ের আনন্দে মাতোয়ারা। নিজের জন্মটাকেই অভিশপ্ত মনে হয় ওর। বড়খালু ছিলেন সেই বিয়ের আয়োজক। আনন্দের বাজিতে ঘি ঢেলে দিতেই বুঝি তিনি এই ফন্দি আঁটেন। ফন্দি ফিকিরে তিনি একজন ওস্তাদই ছিলেন বটে।

নক্ষত্র বড় হতে হতে দেখতে পায় নিজ এলাকায় গিয়ে বড়খালু আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতা বনে যান। মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার পরিচয় ইতিহাসের সত্যপাঠ হয়ে পড়ে। চমক ছিল তার সংসদ সদস্য হওয়াতে। নক্ষত্র ওর কাঠের ঘোড়া নিয়ে খেলতে খেলতেই দেখেছে বড় খালুর কাছে লোকজন এসে ভিড় করত মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটের জন্য। তখনও নক্ষত্র জানে না বড়খালুর একাত্তর বিলাসের কথা। বড়খালুকে ওর ক্ষমতাধর মানুষ মনে হতো। কখনো কখনো আলাদীনের চেরাগের দৈত্যের মতো তার কাছে অসম্ভব কিছু চাইতে ইচ্ছে করত নক্ষত্রের। ওদের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা লোকমান দুই হাত হারিয়েছে যুদ্ধে গিয়ে। কোনো কাজ করতে পারে না। পেরাকান্দি বাজারে নিতাইয়ের সেলুনের দোকানের সামনে বসে ভিক্ষে করে। একবার খাবার টেবিলে বসে নক্ষত্র ওই আবদারটি ঠিকই করে বসে। বড় খালু তখন কাতল মাছের মুড়িঘণ্ট খাচ্ছিলেন। বিরক্তি নিয়ে তাকান নক্ষত্রের দিকে। তারপর বলেন—তোমাদের গ্রামে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই। কেউ মুক্তিযুদ্ধে যায়নি।

বড়খালুর ডান গালে বুঝি কালসেটে দাগটা সেদিনই পড়ল। দাদার কাছ থেকে জানা, লোকমান মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। আখাউড়া, নবীনগরে যুদ্ধ করে লোকমানের নাম হয়েছিল। শিবপুরের যুদ্ধে প্রায় একাই নাকি লড়েছিলেন পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে। নভেম্বরে এসে পাকহানাদারদের ছোঁড়া গ্রেনেডে রসুল্লাবাদের যুদ্ধে লোকমানের দুই হাতের কবজি উড়ে যায়। দাদা বলেছেন, ওর চাচা জব্বার গ্রামের আরো আট তরুণকে নিয়ে শ্রাবণ মাসের আট তারিখ রওনা হয়েছিল আখাউড়ার দিকে। ওইদিন সারাদিন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল গ্রামে। রাতের বরষাও ছিল ঘন। জব্বার তার দল নিয়ে ওই সুযোগেই গ্রাম ছেড়েছিলেন। রাতে কেউ টের পায়নি। সকালে জানাজানি হয়ে গেলে গ্রামের মানুষদের বলেছিলেন—যুদ্ধে গ্রামের একটা শরিক থাকা দরকার। সবাই যুদ্ধে নামছে সুন্দরপুরের মানুষ বাদ থাকবে কেন। গেছে তো ভালোই হয়েছে। গ্রামের কেউ তাদের ফিরিয়ে আনতে যায়নি। গেছিলেন বড়খালু। তিনি নৌকা নিয়ে ছোটেন জব্বার চাচাদের পেছনে। ফতেহপুর গিয়ে পথ আটকান। সবাইকে ফিরিয়ে আনতে চাইলেও পারেননি। শুধু জব্বার চাচাকে নিয়ে ফিরেছিলেন। মাঝপথে আবার জব্বার চাচা পালিয়ে চলে যান। খালি হাতে ফিরতে হয় বড়খালুকে। ওই সময় থেকেই নাকি তার কালো রঙ বিন্দু থেকে বড় আঁচড়ের মতো দীর্ঘ হতে থাকে মুখে।

টুপ করে সূর্যটা ডুব দিতেই গ্রামের পথে পা বাড়ায় নক্ষত্র। উপরে তার নামের মিতারা সমাবেশ ঘটিয়ে ফেলেছে এরই মধ্যে। চাঁদ নিজে হাজির হয়নি ঠিকই। কিন্তু তারাদের আলোতে সরিষার পাপড়িতে, পাতায় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলোও যেন আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে নক্ষত্রকে তার বসতবাড়িতে। সেই বসতবাড়িকে একাত্তরে বারামখানা বানাতে চেয়েছিলেন বড়খালু। ফতেহপুর থেকে ফিরেই সেই নকশা আঁকতে থাকেন। বাড়িতে অপরিচিত মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। বড় জামাইয়ের বন্ধু মনে করে তাদের আদর আপ্যায়নও হয়। এক সময় নক্ষত্রের বাড়ির মানুষেরা দেখতে পান ওই বড় জামাইর বন্ধুদের সঙ্গে মেয়ে অতিথিরাও আসতে থাকে। সেসব মেয়ে অতিথিদের মনে আতঙ্ক, ভয় খেলা করছে। তাদের নিয়ে বাড়ির আলগা ঘরে থাকত বড় খালু ও তার বন্ধুরা। সেখান থেকে মহিলা অতিথিদের চাপা চিৎকার ভেসে আসত। ভোর হবার আগেই আবার মেয়ে অতিথিরা উধাও। তাদের নৌকায় উঠিয়ে দেয়া হতো।

দাদা বলেছিলেন, গোলমাল বাঁধল আশ্বিন মাসের জোছনা রাতে। সেই রাতেও বাড়ির আলগা ঘরে মেয়ে মানুষ নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদের ফুর্তির শিৎকারে সেই রাতে ঘুমাতে পারেনি গ্রামের মানুষ। কূপি, হারিকেন নিয়ে এসে ঘিরে ফেলেছিল নক্ষত্রদের বাড়ি। আলগা ঘরে আগুন দিতে এগিয়ে যায় মধ্যপাড়ার ইকবাল। নক্ষত্রের দাদা ইকবালকে চোখের ইশারায় নির্দেশ দিয়ে সরে পড়েছিলেন। বাড়ির বড় জামাই পুড়ে ভস্ম হবে তার উপস্থিতিতে, এর জন্য পরিবারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। দাদা সরে গেছিলেন ঠিকই। কিন্তু নক্ষত্রের বাবা, চাচা, মামারা এসে আলগা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। গ্রামের মানুষের সেই একাত্তরেও সাহস জন্মেনি এই বাড়ির মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার। ইকবাল আগুন দিতে পারেনি। কেবল একদলা থুতু ছুঁড়ে দিয়েছিল বড় খালুর মুখে। সেজন্য মেজো চাচার চর হজম করতে হয়েছিল তাকে। সেই ভোরেই বড় খালু আর তার দল সুন্দরগঞ্জ ছাড়ে।

ডিসেম্বরে যুদ্ধ শেষ করে গ্রামে ফিরে এসেছিল জব্বার এবং তার দল। বাড়ি ফিরে ওই আলগা ঘরেই জব্বার দেখতে পায় পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। নক্ষত্রের মেজো চাচা পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে রেখেছিলেন। জব্বার পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। রণাঙ্গন ফেরত মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে ফেলেন। মেজো চাচা দূর থেকে সবই দেখেন কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তার বছর খানেক পর জব্বার চাচাকে নিয়ে মেজো চাচা কালগড়ার হাটে যান। নৌকায় কোনো মাঝি নেননি। দুইভাই নৌকা বাইতে বাইতে হাটে গিয়েছিলেন। পরদিন ভোরে মেজোচাচা ফিরে আসেন। জব্বার চাচা সেদিন ফেরেননি, আজও ফেরেননি। মেজো চাচাকে ফিসফিস করে পরিবারের কেউ কেউ বলেন রাজাকার। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে আজও গণ্ডগোল বলেন। নক্ষত্র বাঁশঝাড় পেরিয়ে বাড়িতে উঠে আসে। দাঁড়ায় এসে ওই আলগা ঘরটার সামনে। কেন যেন এতগুলো বছরেও এই ঘরটাকে সে বধ্যভূমি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি। এবার ঢাকা থেকে নতুন নকশার ক্যান্ডেল নিয়ে এসেছে নক্ষত্র। সেটা জ্বালিয়ে দিতেই অন্ধকারে ডুবে থাকা বধ্যভূমি চাঁদের মতো ভেসে ওঠে।



বাংলাদেশ সময়: ১৮১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।