সত্যিই!—ঘাবড়ে গিয়ে—খুব, খুব ভয়ঙ্কর রকমের বিচলিত ছিলাম আমি এবং এখনো আছি; কিন্তু তাই বলে তুমি কেন বলতে যাবে যে, আমি পাগল? রোগটা আমার বুদ্ধিকে বরং আরো চোখা করেছে—ধ্বংস করেনি—এমনকি ভোঁতাও করেনি। সবকিছুর ওপরে ছিল আমার তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তি।
এটা বলা খুব মুশকিল যে ধারণাটা প্রথমে কী করে আমার মগজে সেঁধিয়ে গিয়েছিল; কিন্তু একবার এটি আমার মনের ভেতরে বাসা বাঁধার পর থেকেই দিন-রাত আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকল। উদ্দেশ্য? না, কোনো উদ্দেশ্য-ফুদ্দেশ্য ছিল না। কোনো ভাবাবেগও কাজ করেনি এর পেছনে। বরং বুড়ো লোকটিকে আমি ভালোবাসতাম। তিনি আমার ওপর কক্ষণো কোনো অন্যায় করেননি। অপমানও করেননি কখনো আমাকে। তার সোনা-দানার ওপর আমার কোনো লোভ ছিল না। আমি মনে করি এর পেছনে ছিল তার চোখ! হ্যাঁ, ঠিক তাই! তার চোখ ছিল শকুনের চোখ—ফিকে নীল চোখ, যার ওপরে একটি পর্দা পড়ে গিয়েছিল। যখনই আমার ওপর এই চোখের দৃষ্টি পড়ত, আমার রক্তে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যেত; এবং এভাবে চলতে চলতে পর্যায়ক্রমে—খুব ধীরে ধীরে—আমি মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, এই বুড়ো লোকটির প্রাণ কেড়ে নেব, এবং তা হলেই কেবল চিরদিনের জন্য আমি এই চোখের কুৎসিত দৃষ্টি থেকে রেহাই পেয়ে যাব।
গাঢ় অন্ধকারের কারণে তার কামরাটা ছিল পিচের মতো কালো, (ডাকাতের ভয়ে শাটারগুলো খুব এঁটে বন্ধ করা ছিল) আর তাই আমি জানতাম তিনি দরজাটা খোলা দেখতে পাবেন না, এবং আমি খুব ধীরস্থিরভাবে এটি ঠেলতে থাকলাম, খুব ধীরে ধীরে। আমি আমার মাথাটা ভেতরে গলিয়ে ফেলেছি, এবং হারিকেনটা সবে খুলতে যাব, ঠিক তখন হঠাৎ আমার হাতের বুড়ো আঙুল হারিকেনটাকে ঢেকে রাখা টিনের ওপর পিছলে পড়ল, এবং বুড়ো লোকটি তার বিছানায় ধড়মড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বলে উঠলেন—‘কে ওখানে?
এখন এই হচ্ছে ব্যাপার। তুমি আমাকে পাগল ঠাউরাও! আরে, পাগল লোকেরা তো কিছুই জানে না! আমাকে তোমার দেখে থাকা উচিৎ। তোমার দেখে থাকা উচিৎ কী অবলীলায়, কত বুদ্ধির সাথে আমি এগিয়ে গেছি—কত সতর্কতার সঙ্গে—কত দূরদর্শিতার সঙ্গে—কতটা ভণিতার আশ্রয় নিয়ে আমি এ কাজে গিয়েছি! খুন করার আগে গোটা সপ্তাহ ধরে আমি এই বুড়ো লোকটির ওপর যতটা দয়াবান ছিলাম আগে কখনোই ততটা ছিলাম না। এবং প্রতিরাতেই, মাঝরাতের দিকে, আমি তার দরজার হুড়কো ঘুরিয়েছি এবং দরজাটি খুলে ফেলেছি—ওহ্ কত আলতো করেই না! এবং তার পর, যখন আমার মাথাটা গলানোর মতো যথেষ্ট পরিমাণে এটিকে ফাঁক করতে পেরেছি, তখন ঢাকনা দিয়ে ঘিরে অন্ধকার করে রাখা একটি হারিকেন ঢুকিয়ে দিয়েছি, সবদিক বন্ধ, এমনভাবেই বন্ধ যেন কোনো আলো বাইরে বেরুতে না পারে, এবং তখনই কেবল আমি আমার মাথাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছি। ওহ্, কতটা চতুরতার সঙ্গে আমি যে ভেতরে মাথা গলিয়েছি দেখলে তুমি হয়ত হেসেই কুটিকুটি হতে! আমি মাথাটা ধীরে ধীরে গলিয়েছি—খুব, খুব ধীরে, যাতে করে আমি আবার না বুড়ো লোকটার ঘুমে ব্যাঘাত করে ফেলি। তিনি যে তার বিছানায় শুয়ে আছেন তা দেখার জন্য ওই ফাঁকটাতে আমি আমার পুরো মাথা ঢোকাতে এক ঘণ্টা সময় নিয়েছি। হাহ্, কোনো পাগল মানুষ কি এই রকম বিচক্ষণ হতে পারবে? এবং তখন, মাথাটা যখন ভেতরে ভালোমতো গলিয়ে ফেলতে পেরেছি, তখন সাবধানে—ওহ্, এতটাই সাবধানে—সতর্কভাবে (কারণ কব্জাটা ক্যাচমেচিয়ে শব্দ করে উঠতে পারে)—আমি হারিকেনকে ঢেকে রাখা ঢাকনা সামান্য ফাঁক করলাম যাতে খুব চিকন এক ফালি আলো ঐ শকুন-চোখটার ওপর পড়তে পারে। এবং দীর্ঘ সাতটি রাত ধরে আমি এমনটিই করলাম—প্রতিরাতে ঠিক মাঝরাতে—কিন্তু প্রতিবারই আমি চোখটাকে বোঁজা অবস্থায় পেয়েছি; আর তাই কাজটি সেরে ফেলা ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার; কারণ বুড়ো লোকটি তো আমাকে জ্বালিয়ে মারতেন না, জ্বালিয়ে মারত তার ওই নচ্ছার চোখ। এবং প্রতিদিন সকালে, যখন দিনের আলো ফুটত, আমি খুব দাপটের সঙ্গে কামরাটিতে যেতাম এবং খুব সাহস নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতাম, সহৃদয় কোমল স্বরে তার নাম ধরে ডাকতাম, এবং জানতে চাইতাম রাতটা তিনি কেমন কাটিয়েছেন। সুতরাং দেখতেই পাচ্ছো বুড়ো লোকটা নির্ঘাত খুব পাকা বুদ্ধির, অর্থাৎ গভীর জলের মাছ ছিলেন; অবশ্যই, যেহেতু প্রতিটি রাতে ঠিক বারোটায় তিনি যখন ঘুমিয়ে থাকতেন আমি ভেতরে গিয়ে তার দিকে তাকাতাম বলে তার সন্দেহ হয়েছিল।
অষ্টম দিনে এসে দরজা খোলার ক্ষেত্রে আমি রোজ যেমনটি করি তার চেয়ে আরো বেশি সতর্ক ছিলাম। আমার সরা-নড়া এতটাই ধীর গতির ছিল যে ঘড়ির মিনিটের কাঁটার গতিও ছিল তার চেয়ে দ্রুত। আমার ক্ষমতার দৌড় যে কতটা—আমি যে কতখানি সূক্ষ্মদর্শী তা সেই রাতের আগে কখনোই আমি বুঝতে পারিনি। কালেভদ্রেই কেবল আমি আমার বিজয়ান্দকে সংযত করে রাখতে পারতাম। ভেবেছিলাম আমি যে সেখানে আছি, একটু একটু করে যেভাবে দরজা খুলছি তাতে এমনকি তিনি আমার গোপন ইচ্ছে এবং ভাবনাচিন্তা কী তা স্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না। আমি আমার সেই ধারণার ওপর বেশ ভালোভাবেই আছন্ন থেকে মুখ টিপে টিপে হাসতে থাকলাম; এবং সম্ভবত তিনি আমার সেই হাসি শুনতে পেয়েছিলেন; কারণ হঠাৎ করেই তিনি বিছানার ওপর নড়াচড়া করে উঠলেন, যেন ভয়ে চমকে উঠেছেন! এখন তুমি হয়ত ভাবতে পারো আমি পিছু হটে এসেছিলাম—কিন্তু না। গাঢ় অন্ধকারের কারণে তার কামরাটা ছিল পিচের মতো কালো, (ডাকাতের ভয়ে শাটারগুলো খুব এঁটে বন্ধ করা ছিল) আর তাই আমি জানতাম তিনি দরজাটা খোলা দেখতে পাবেন না, এবং আমি খুব ধীরস্থিরভাবে এটি ঠেলতে থাকলাম, খুব ধীরে ধীরে।
আমি আমার মাথাটা ভেতরে গলিয়ে ফেলেছি, এবং হারিকেনটা সবে খুলতে যাব, ঠিক তখন হঠাৎ আমার হাতের বুড়ো আঙুল হারিকেনটাকে ঢেকে রাখা টিনের ওপর পিছলে পড়ল, এবং বুড়ো লোকটি তার বিছানায় ধড়মড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বলে উঠলেন—‘কে ওখানে?’
আমি একদম স্থির হয়ে থাকলাম এবং কোনো কথা বললাম না। পুরো একটি ঘণ্টা ধরে আমি আমার কোনো পেশিই নড়তে দিলাম না, এবং এই সময়ের ভেতর আমি তার শুয়ে পড়ার শব্দও শুনতে পেলাম না। তিনি তখনও বিছানায় বসে কিছু শোনার জন্য কান খাড়া করে রেখেছেন—ঠিক যেমনটি আমি করে করে আসছি, রাতের পর রাত, দেয়ালে কোনো কাচপোকার শব্দও যাতে শুনতে পারি সেজন্য কান পেতে থেকেছি।
খুব শিগগিরই আমি হালকা এক গোঙানির শব্দ শুনতে পেলাম, এবং আমি জানতাম এটি হচ্ছে মৃত্যু-আতঙ্কের গোঙানি। এটা কোনো ব্যথা বা কোনো শোকের গভীর থেকে উঠে আসা গোঙানি নয়—ওহ্, না, কিছুতেই তা নয়! এটা হচ্ছে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ার শব্দ, যা কোনো আত্মার একদম তলা থেকে উঠে আসে, যখন সে আত্মা চরম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমি এই শব্দটাকে খুব ভালো করেই চিনি। অনেক রাতেই, ঠিক মাঝরাতে, যখন সারাটা দুনিয়া ঘুমিয়ে থাকে, এটি আমার নিজের বুকের ভেতর থেকে উঠে আসে, গভীর হয়; এর ভয়ঙ্কর প্রতিধ্বনি যে ত্রাস সৃষ্টি করে তা আমাকে হতবিহ্বল করে তোলে। হ্যাঁ, আমি জোর দিয়ে বলছি আমি এটিকে বেশ ভালো করেই জানি। আমি জানতাম বুড়ো লোকটার অনুভূতি কেমন ছিল, এবং তার ওপর এজন্য আমার খুব মায়া হলো, যদিও আমি মনে মনে মুখ টিপে হাসলাম। আমি জানি সেই প্রথম হালকা শব্দের পর থেকেই তিনি বিছানায় জেগে শুয়ে আছেন, যখন তিনি বিছানায় নড়ে উঠেছিলেন ঠিক তখন থেকেই। তখন থেকেই তার ভয়টা মনের ভেতরে বেড়ে উঠছে। তিনি সেগুলোকে অলীক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না। নিজের মনে তিনি বলছিলেন, ‘এটা চিমনির ভেতরে বাতাস খেলে যাওয়ার শব্দ ছাড়া কিছুই নয়—বা শুধু একটি ইঁদুর দৌড়ে মেঝে পার হলো—এই যা,’ অথবা ‘এটি নিছকই একটি ঝিঁঝিঁ পোকা, একবার কিচকিচ করেই থেমে গেছে। ’ হ্যাঁ, তিনি এইসব ভেবে নিয়েই নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করছেন : কিন্তু এই সবকিছুই তার কাছে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াস বলে মনে হলো আমার কাছে। সবকিছুই বৃথা গেল; কারণ মৃত্যু তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে তার কালো ছায়ার সাথে মিলেছে, এবং সে তার শিকারকে ঘিরে ধরেছে। আর এটা হচ্ছে সেই অবোধ্য ছায়ারই শোকাতুর প্রভাব, যা তাকে অনুভব করতে বাধ্য করছে তার কামরার ভেতরে আমার মাথার উপস্থিতি—যদিও সে তা দেখেওনি, শোনেওনি।
খুব ধৈর্যের সঙ্গে অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেও যখন তার শুয়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম না, তখন আমি হারিকেনকে ঢেকে অন্ধকার করে রাখা ঢাকনাটা একটু ফাঁক করার সিদ্ধান্ত নিলাম—খুব সামান্য—খুবই সামান্য এক চিলতে ফাঁক করব বলে ঠিক করলাম। সুতরাং আমি এটি একটু ফাঁক করলাম—তুমি ভাবতেও পারবে না কতটা ধীরে ধীরে—যতক্ষণ না মাকড়সার জালের সুতোর মতো স্রেফ একটি ক্ষীণ রশ্মি হারিকেনের সেই ফাটল গলে পুরোপুরিভাবে শকুন চোখটার ওপরে গিয়ে পড়ল।
চোখটি ছিল খোলা—পুরোপুরি, হাঁ করে খোলা—এবং সেদিকে নজর যেতেই আমি হিংস্র হয়ে উঠলাম। যথার্থ স্পষ্টভাবেই আমি এটিকে দেখলাম—পুরোপুরি নিষ্প্রভ নীল, এর ওপরে যে বীভৎস পর্দাটা ছিল তা হাড়ের মজ্জাকেও শীতল করে দেয়; কিন্তু আমি বুড়ো লোকটির মুখ বা দেহের অন্য কোনো অংশ দেখতে পাচ্ছিলাম না : যেহেতু আমি ইচ্ছে করেই আলোকরশ্মিটা শুধু তার ওই নচ্ছার চোখের ওপরেই ফেলেছিলাম।
আর আমি কি তোমাকে বলিনি যে, আমার চোখা-অনুভূতিকে, অতিসূক্ষ্মদর্শিতাকে পাগলামি ভেবে তুমি কী ভুল করছো?—এখন শোনো তা হলে আমি কী বলি—আমার কানে খুব নিচু, ক্ষীণ, দ্রুত শব্দ ভেসে এলো, অনেকটা কোনো ঘড়িকে তুলো দিয়ে ঢেকে রাখলে যেমন শব্দ হয়। আমি এই শব্দটাকেও খুব ভালো করেই জানতাম। এটি ছিল বুড়ো লোকটির হৃদস্পন্দনের শব্দ। এই শব্দ আমার ক্রোধ আরো বাড়িয়ে দিল, ঠিক যেমনটি রণ-দামামা সৈন্যদের উত্তেজিত করে তোলে।
কিন্তু এমনকি তখনও আমি নিজেকে সংযত করে রাখলাম এবং স্থির হয়ে থাকলাম। হারিকেনটাকে স্থির করে ধরে রাখলাম। চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম চোখটার ওপর আলোকরশ্মি কত স্থিরভাবে ধরে রাখতে পারি। এর ভেতরে বুড়ো লোকটির হৃৎপিণ্ডের নারকীয় ধপধপ শব্দ আরো বেড়ে গেল। প্রতিটি মুহূর্তেই দ্রুত থেকে তা আরো দ্রুত, আরো জোরালো হয়ে উঠছিল। বুড়ো লোকটির আতঙ্ক এরই ভেতরে নিশ্চয়ই চরমে উঠে গিয়েছিল! আমি তো বলেছিই, এই শব্দ আরো জোরালো হচ্ছিল, প্রতিমুহূর্তেই ক্রমাগতভাবে তা আরো বেড়ে যাচ্ছিল! তুমি কি আমি যা বলেছিলাম তা খুব ভালো করে খেয়ালে রেখেছো যে আমি ছিলাম খুবই বিচলিত? হ্যাঁ, সত্যিই আমি খুব বিচলিত ছিলাম। এবং এখন এই গভীর রাতে, পুরনো বাড়িটার ভয়ানক নীরবতার মাঝে এই অদ্ভুত শব্দ আমার উত্তেজনাকে বাড়িয়ে আমাকে অসহনীয় আতঙ্কের ভেতরে ফেলে দিল। তার পরেও, আরো কয়েক মিনিট আমি সংযত এবং স্থির থাকলাম, কিন্তু এই হৃদস্পন্দনের শব্দ আরো বাড়তেই থাকল! আমার তখন মনে হচ্ছিল এটি নির্ঘাত ফেটেই যাবে। আর এখন এক নতুন দুশ্চিন্তা আমাকে পেয়ে বসল—এই শব্দ হয়ত প্রতিবেশীরা শুনে ফেলবে! বুড়ো লোকটির সময় এসে গেছে! আমি এক তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে হারিকেনটাকে খুলে ফেললাম এবং কামরার ভেতরে ঢুকলাম। তিনি একবার কেঁপে উঠলেন—একবারই মাত্র। নিমেষেই আমি তাকে মেঝেতে টেনে নামালাম, এবং ভারী বিছানাটা তার ওপরে এনে ফেলে তাকে চাপা দিলাম। কাজটি করা হয়ে গেছে বুঝতে পেরে আমি মহা উল্লাসে হেসে উঠলাম। কিন্তু বেশ কয়েক মিনিট ধরে চাপা শব্দে হৃদস্পন্দন চলছিলই। সে যাই হোক, তাতে আমি বিরক্ত হলাম না; দেয়ালের ওপাশ থেকে এ শব্দ শোনা যাবে না। এক সময় তা থেমে গেল। বুড়ো লোকটা মারা গেলেন। আমি তার ওপর থেকে বিছানাটা সরালাম এবং লাশটা পরীক্ষা করলাম। হ্যাঁ, তিনি শক্ত পাথর হয়ে গেছেন, মরা পাথর। আমি তার বুকে হৃৎপিণ্ডের ওপর আমার হাত রাখলাম এবং বেশ কয়েক মিনিট ধরে হাতটি সেখানে ধরে থাকলাম। কোনো ধুকধুকানি নেই। তিনি মরে পাথর হয়ে গেছেন। তার চোখ আর আমাকে কোনো সমস্যায় ফেলতে পারবে না।
তুমি এখনো যদি আমাকে পাগল ঠাউরে থাকো, তবে আমি দেহটিকে লুকিয়ে রাখতে যে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম তা যখন বর্ণনা করব তখন আর তেমনটি ভাবতে পারবে না। রাত ফুরিয়ে আসছিল, এবং আমি খুব তাড়াহুড়া করে কাজ করতে থাকলাম, কিন্তু নীরবে। প্রথমেই আমি লাশটাকে খণ্ড খণ্ড করে কাটলাম। মাথাটা কেটে আলাদা করলাম, হাত কাটলাম এবং পা দুটোও।
এরপর আমি কাঠের মেঝে থেকে তিনটি তক্তা খুলে ফেললাম এবং সেই ফাঁকের ভেতর লাশের সব টুকরো ভরে দিলাম। এরপর আমি এতটাই চতুরতার সঙ্গে, এতটাই ধূর্ততার সঙ্গে তক্তাগুলো সেখানে আবার রাখলাম যাতে কোনো মানুষের চোখ—এমনকি তার চোখও কোনো খুঁত ধরতে না পারে। কিছুই ধুয়ে পরিষ্কার করার দরকার ছিল না—কোনো ধরনের দাগ বা সেই ধরনের কিছু—রক্তের কোনো চিহ্নই ছিল না, যেজন্য আমি মহা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একটি বালতিতেই সবকিছু ধরে গিয়েছিল—হা! হা! হা!
পরিশ্রমের এই কাজটুকু শেষ করতে করতে ভোর চারটা বেজে গেল—তখনও মাঝরাতের মতো অন্ধকার। যখন চারটা বাজার ঘণ্টা বেজে উঠল, রাস্তার দিককার দরজায় হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ হলো। খুব ফুরফুরে মেজাজে দরজা খোলার জন্য আমি নিচে নেমে গেলাম—এখন আর কী ভয় আমার? তিনজন লোক ঢুকল, যারা যথাযথ মোলায়েম কণ্ঠে নিজেদের পুলিশ অফিসার হিসেবে বর্ণনা দিলেন। রাতে একজন প্রতিবেশী তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনেছে; সন্দেহ উঠেছে কোনো অঘটন ঘটার; পুলিশ অফিসে তথ্যটি জানানো হয়েছে, এবং তারা (অফিসারেরা) এই বাড়ি এবং আশপাশ তল্লাশির জন্য এসেছেন।
আমি হাসলাম,—কারণ আমার ভয় পাওয়ার কী আছে? আমি ভদ্রলোকদের স্বাগত জানালাম। তাদের বললাম, আমিই আমার স্বপ্নের ভেতরে ওভাবে চিৎকার করে উঠেছিলাম। বুড়ো লোকটির ব্যাপারে বললাম, তিনি দেশে অনুপস্থিত। আমি আমার এই অতিথিদের বাড়ির সব জায়গায় নিয়ে গেলাম। তাদের বললাম, খুঁজুন, ভালো করে তল্লাশি করুন। একেবারে শেষে তাদের আমি বুড়ো লোকটির কামরায় নিয়ে গেলাম। তাদের দেখালাম তার সব সম্পদ সহি-হেফাজতেই আছে, সেখানে কেউ হাত দেয়নি। আত্মবিশ্বাসের আতিশয্যে আমি কামরার ভেতর চেয়ার নিয়ে এলাম এবং এখানেই বসে তাদের ক্লান্তি দূর করতে অনুরোধ করলাম, আর আমি বিজয়ের বুনো আনন্দে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে আমার নিজের চেয়ারটা বসালাম সেইখানটায়, যেখানটার ঠিক নিচে বুড়ো লোকটার লাশ লুকিয়ে রেখেছি।
উৎফুল্লের সঙ্গে আমি তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে থাকলাম, তারা খুব জানাশোনো সাধারণ ব্যাপার নিয়ে খোশগল্প করতে থাকলেন। কিন্তু খানিক পরেই আমি আমার নিজের ভেতরে অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করলাম এবং কামনা করতে থাকলাম তারা এবার ঝটপট বিদায় নিক। আমার মাথাব্যথা শুরু হলো, এবং আমার কানের ভেতরে ভোঁ ভোঁ করতে থাকল : কিন্তু তবুও তারা বসে রইল এবং তখনও খোশগল্প করতে লাগল। কানের ভেতর ভোঁ ভোঁ শব্দ আরো স্পষ্ট হলো : এটি চলতেই থাকল এবং তা আরো বেশি স্পষ্ট হলো : এই অস্বস্তি থেকে রেহাই পেতে আমি আরো খোলামেলাভাবে কথা বলতে শুরু করলাম : কিন্তু এই ভোঁ ভোঁ গুনগুন শব্দ চলতেই থাকল এবং তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকল ততক্ষণ, যতক্ষণ না আমি বুঝতে পারলাম যে শব্দটা আসলে আমার কানের ভেতরে হচ্ছে না।
কোনো সন্দেহ নেই যে আমি ভয়ে খুব ফ্যাকাশে হয়ে উঠলাম;—কিন্তু আমি আরো তড়বড়িয়ে এবং চড়া গলায় কথা বলতে লাগলাম। তারপরেও শব্দটা বেড়ে যেতে থাকল—আর আমি তখন কী-ই বা করতে পারতাম? এটি ছিল খুব নিচু, অস্পষ্ট, দ্রুত শব্দ—কোনো ঘড়িকে তুলো দিয়ে চেপে ঢেকে রাখলে ঠিক যেমন শব্দ হয়। আমি দম নিতে হাঁসফাঁস করতে থাকলাম—কিন্তু তবুও তারা তা শুনতে পেলেন না। আমি আরো দ্রুত, আরো আবেগতাড়িত হয়ে কথা বলতে থাকলাম; কিন্তু ধীরে ধীরে শব্দটা কেবল বাড়তেই থাকল। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং খুব জোরের সাথে মাথা নাড়িয়ে চড়া গলায় দাবি করতে থাকলাম যে এগুলো সব ফালতু ব্যাপার; কিন্তু শব্দটা ধীরে ধীরে আরো বাড়তে থাকল। তারা যাচ্ছে না কেন? আমি ভারী ভারী পা ফেলে মেঝের এ-মাথা ও-মাথা পায়চারি করতে থাকলাম, যেন এই লোকেদের পর্যবেক্ষণে আমি ভীষণ উত্তেজনায় খুব রেগে গেছি—কিন্তু শব্দটা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকল। হায় ঈশ্বর! আমি তখন আর কী করতে পারতাম? কথার তুবড়ি ছুটিয়ে আমি মুখে ফেনা তুলে ফেললাম—বুনো ক্ষ্যাপাটে হয়ে গেলাম—জোর দিয়ে নিশ্চয়তা দিতে থাকলাম আমার কথার! যে চেয়ারটিতে বসেছিলাম সেটি খুব করে দোলাতে থাকলাম এবং এটিকে চুলোর ঝাঁঝরির মতো চেপে ধরলাম তক্তাগুলোর ওপর, কিন্তু এই সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠে আসতে থাকল শব্দটি এবং ক্রমাগতভাবে তা বাড়তেই থাকল। এটির জোর কেবল বাড়তেই থাকল—জোরে—আরো জোরে হতে থাকল শব্দ! আর এই লোকেরা আনন্দের সঙ্গে খোশগল্প করতে থাকলেন, এবং হাসতে থাকলেন। এটি কি সম্ভব যে তারা কিছু শোনেনি? ঈশ্বরই ভালো জানেন!—না, না! তারা শুনেছে!—তারা সন্দেহ করেছে!—তারা জানত!—তারা আমার আতঙ্ক নিয়ে মশকরা করছিল!—আমি এমনটি ভাবছিলাম, এবং আমি এমনটিই মনে করি। কিন্তু এই নির্মম যন্ত্রণার চেয়ে অন্য যে কোনোকিছুই ভালো! এই উপহাসের চেয়ে অন্য যে কোনোকিছুই বরং সহনীয়! আমি এই কপট হাসি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম যে আমাকে অবশ্যই চিৎকার করে উঠতে হবে, নইলে মরতে হবে! এবং এখন—আবারো!—মন দিয়ে শোনো! আরো জোরে! আরো জোরে! আরো জোরে! আরো জোরে!
‘নচ্ছারেরা!’ আমি তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠলাম, ‘আর লুকোচুরি করতে হবে না! আমি আমার কৃৎকর্ম স্বীকার করে নিচ্ছি!—খুলে ফেল তক্তাগুলো! এখানে! এখানে!—এটি হচ্ছে তার ভয়ঙ্কর কুৎসিত হৃদয়ের স্পন্দন!’
[এডগার অ্যালান পো গল্পটি ১৮৪৩ সালে লিখেছিলেন]
বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫