ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মেরুদণ্ডের রোগবালাই | শাহ ইয়াছিন বাহাদুর

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৫
মেরুদণ্ডের রোগবালাই | শাহ ইয়াছিন বাহাদুর

হাজিরা খাতায় সই করতে করতে ইকরাম দেখে, দপ্তরী হারিছ মিয়া ধীর পায়ে একটি খাম হাতে এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। ‘কী খবর?’ বলে হারিছের কাছ থেকে খামটা হাতে নিতেই হারিছ কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে যেতে যেতে দরজা পেরিয়ে নিজেকে আড়াল করে।

খামটা এপিঠ ওপিঠ ঘুরিয়ে, প্রাপকের ঠিকানার হস্তাক্ষর দেখে ইকরাম চিনতে পারে, লেখাটা তাদেরই কেরানির হাতের আর যেহেতু ডাকটিকেটের সংযুক্তি নেই সেহেতু এটি প্রধান শিক্ষকের দপ্তর থেকেই এসেছে। সে তখন ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকায় আর খেয়াল করে, চোখে চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সহকর্মীরা ভয়ার্ত গুইসাপের মতো চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। একমাত্র হরিতোষ বাবু ঠোঁট নামিয়ে একটু বিদ্রূপের হাসি দেয়ার চেষ্টা করলেন। গেল সপ্তাহে নাইনের গণিত ক্লাসটা হরিতোষ বাবুর রুটিন থেকে কেটে ইকরামকে দেয়ায় তিনি আড়ালে আবডালে প্রধান শিক্ষক ও ইকরামের মুণ্ডুপাতের বা তাঁদের দেখে নেয়ার যে সব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তারই কোনো আনন্দদায়ক উপলক্ষ হয়ত তিনি হাতেনাতে পেয়ে গেছেন। হরিতোষ বাবুর হাসির জবাবে ইকরামও একটু অর্থহীন হাসি দেয়ার চেষ্টা করে।

দপ্তরী হারিছ মিয়ার কাছ থেকে নেয়া খামটা খুলতেই যে জিনিস তার সামনে ভেসে উঠল তা এই স্কুলের শিক্ষকদের কাছে এক কথায় বলতে গেলে ‘বিরাট কিছু’। বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে, প্রধান শিক্ষক বা সভাপতিবান্ধব কেউ অন্য কোনো শিক্ষককে যেকোন কারণে এ ধরনের একটি কাগজ ধরিয়ে দিতে পারলেই হয়, তখন থেকেই তিনি স্টুডেন্টদের কাছে শেষ! বছরের পর বছর তিনি বা তার সার্কেলের অন্য শিক্ষকরা টিফিন পিরিয়ডে চুপসে যাওয়া ঝালমুড়ি চিবুতে চিবুতে বা শব্দ করে চা টানতে টানতে নতুন শিক্ষকদের কাছে সে চিঠির গল্প, তাঁদের নিজস্ব ভাষায়, প্রতিহিংসায় ফণা তোলা অসংখ্য সাপের বিষ মিশিয়ে তুলে ধরবেন। এ প্রচেষ্টার একটা দূরগামী উদ্দেশ্য আছে, তা হলো, সামনের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে চিঠিপ্রাপ্ত সেই অকেজো, ষড়যন্ত্রী শিক্ষককে কিছুতেই ভোট দেয়া যাবে না, এই বার্তাটুকু পৌঁছে দেয়া।



হেড এক্সামিনার সাহেব বলেন, ‘আপনি এইটা কী করলেন ইকরাম সাহেব?’
‘কী হয়েছে স্যার?’
‘আপনি তো গণহারে ফেল করায়া দিছেন!
‘স্যার, আমি ফেল করাব কেন?’
‘চারশ’ খাতায় আড়াইশ’ই ফেল! আবার বলেন, ফেল করাব কেন? খাতা দেখছেন না কসাইগিরি করছেন?’
‘স্যার, আমি তো খাতা দেখায় কোনো ত্রুটি করিনি। খুব কষ্ট করে লাইনবাইলাইন পড়ে সারা রাত জেগে খাতা দেখেছি। ’
‘লাইনবাইলাইন পড়তে কে বলছে আপনাকে?’



তো ইকরাম ওরকম একটা চিঠি পেয়েছে। ইংরেজিতে এর একটা কমন নাম আছে, ‘শোকজ লেটার’। অল্প কথার চিঠি তবু এটি পড়তে পড়তে সাতাশের তরুণ ইকরাম ভাবনায় পড়ে। এই বিদ্যালয়ে তার চার বছরের পা। অল্পদিনেই স্টুডেন্টদের কাছে তার নাম ‘আর্মিস্যার’। শৃঙ্খলা আর সততায় এই তরুণ শিক্ষক হরিতোষ সাহেবদের চক্ষুশূল হলেও স্টুডেন্টদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন কেননা তিনি ঘোষণা করেছেন, তার সাবজেক্টগুলোতে কারো প্রাইভেট পড়তে হবে না। ক্লাসরুমই হবে রিডিংরুম। সেভাবেই চলছিল। এরই মধ্যে আচমকা হাতে আসা এই পত্রপাঠে সে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। বিভ্রান্তি এই কারণে, যে দায়িত্ব তিনি সুষ্ঠুমতে পালন করে এসেছেন সে দায়িত্বই ‘কেন সুষ্ঠুমতে পালন করা হলো না’ তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে! আর এ কারণেই অ্যাসেম্বলির সুন্দর সময়টা, এমনকি জাতীয় সঙ্গীত গাইবার আবেগঘন মুহূর্তটাও চিঠির কথা ভাবতে ভাবতে বা অস্বাভাবিক অন্যমনস্কতায় মাঠের ঘাস আর ছেলেমেয়েদের স্কুলড্রেসের ফাঁক গলে পাশ কেটে গেল।

ইকরাম অষ্টম শ্রেণির শ্রেণিশিক্ষক। প্রথম ঘণ্টাটা শেষ করে অন্য কারো পরামর্শের দড়ি না ধরে সরাসরি হেড স্যারের শরণাপন্ন হয়। হেড স্যারের পাশেই তখন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সাহেব হাতের মুষ্ঠিতে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছেন। ইকরাম তার হাতের খামটা হেড স্যারের দিকে আস্তে করে ঠেলে দেয়। হেড স্যার কোথাও ফোনে ব্যস্ত ছিলেন। কান থেকে রিসিভার নামিয়ে কথা বললেন, ‘ইকরাম সাহেব, ভালো আছেন?’

ইকরাম স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে, ‘জ্বি স্যার, ভালো আছি। ’

হেড স্যার একবার সভাপতির মুখের দিকে তাকালেন এরপর বললেন, ‘ইকরাম সাহেব, আপনার বয়স তো অল্প। এ কারণেই হয়ত বুঝতে পারছেন না। শিক্ষকতার জন্য আরেকটু ম্যাচিউরিটির প্রয়োজন আছে। আপনার মেধা নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে আসতে হয়। ’

ইকরাম ভ্রু কুঁচকায়, ‘ব্যক্তিস্বার্থের বিষয়টা বুঝলাম না স্যার। ’

হেড স্যার সাথে সাথে কথাটা ধরেন, ‘এজন্যই ম্যাচিউরিটির কথাটা বলেছি। ’

‘এক্সকিউজ মি স্যার, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ’

হেড স্যার মূল কথায় আসেন, ‘গতকাল পরীক্ষার হলে আপনি কী করেছেন?’
‘স্যার, ডিউটি করতে পাঠিয়েছেন, ডিউটি করেছি। ’
‘আপনাকে একজন সিনিয়র টিচার বারবার বাইরে যেতে বললেও আপনি যান নি। ’
‘স্যার, অকারণে আমি কেন বাইরে যাব!’
‘আপনি বাইরে যান নি বলেই আমাদের ছাত্রদের পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। এমনকি সভাপতি সাহেবের মেয়েও ঠিকমত পরীক্ষা দিতে পারে নি। কাজটা আপনি ঠিক করেন নি। ’
‘স্যার, আমার হলে তো আমাদের কোনো স্টুডেন্টই ছিল না! আমার জন্য কিভাবে তাদের পরীক্ষা খারাপ হবে?’
‘আপনি আপনার হলে কড়া ডিউটি করেছেন। ছাত্রদের ঘাড় ঘুরাতে দেন নি। ওরা জেলা স্কুলের ছাত্র ছিল না?’
‘জ্বি স্যার। ’
‘আমাদের ছাত্রদের কেন্দ্রে ছিল জেলা স্কুলের টিচার। আপনার টাইট ডিউটির কথা শুনে ওরাও আমাদের ছেলেদের আচ্ছা করে ডলা দিয়েছে। ’

এতক্ষণ সভাপতি সাহেব চুপ ছিলেন। হেড স্যারের এই কথার পর তিনি লুঙ্গিটা টেনে নিম্নদেশে দলা করে দ্রুত একটি সিগারেট ধরিয়ে শব্দ করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, ‘আপনার জন্য আমার মেয়েটা এ-প্লাস পাইব না, জানেন?’
‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, এতে আমার দোষ কী?’

সভাপতি সাহেব গলা উঁচু করেন, ‘এই মিয়া, আমি আপনার কাছে হরিতোষ বাবুরে পাঠাই নাই? হে আপনেরে গিয়া কই নাই কিছু?’
‘উনি আমাকে বারবার বাইরে যেতে বলেছেন কিন্তু বাইরে যাবার আমার প্রয়োজন ছিল না। ’
‘এই একটা পরীক্ষার জন্য আমার স্কুলের পাশের পার্সেন্টেজ কত কমবে, জানেন আপনি? উপজেলায় আমার ইজ্জত থাকবে?’
‘তাই বলে পরীক্ষার হলে আমি অন্যায় করব?’

সভাপতি তখন হেড স্যারের দিকে সিগারেট ধরা হাতটা নাড়তে নাড়তে রাগ ঝাড়েন, ‘বুঝান মিয়া, আপনার এই চেংড়া মাস্টাররে। আর কোনোদিন তারে পরীক্ষার হলে পাঠাইবেন না। ’ এরপর ইকরামের দিকে চোখ লাল করে, নাক ফুলিয়ে বলেন, ‘চোখ-কান খোলা রাইখে চইলেন। যান এইবার। ’

ইকরাম বেরিয়ে আসে। দিনের বাকি ক্লাসগুলো ঠিকমত আর নিতে পারে না। সারা ক্লাস পায়চারি করেছে আর ছেলেরা ভয় ও বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ইকরামের মুখে এমন মেঘ আর দেখা যায় নি। শেষ ক্লাসটা নিতে নিতে হারিছ মিয়াকে আবার দেখা গেল। ওদিকে তাকাতেই হারিছ জানায়, ‘ছুটির পরে হেড স্যার তাকে থাকতে বলেছেন। ’

ছুটির পর হেড স্যারকে বেশ আন্তরিক মনে হলো। ইকরাম এসে তাঁর রুমে বসতেই হারিছ চা-বিস্কুট নিয়ে আসে। হেড স্যার ইকরামকে চা নিতে ইশারা করেন আর নিজেও নিতে নিতে বলেন, ‘ইকরাম সাহেব, আপনি আমার খুবই প্রিয় একজন সহকর্মী। আপনার রেজাল্ট খুব ভালো। এই স্কুল আপনাকে পেয়ে গর্বিত। কিন্তু কী জানেন, আমাদের সিস্টেমটাই এত বাজে হয়ে গেছে যে, কী বলে আপনাকে আমি সান্ত্বনা দেব, বুঝতে পারছি না। ’

ইকরাম চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুনতে থাকে, ‘আমি শোকজ লেটার কিছুতেই দিতাম না। বাধ্য হয়েছি। যা হোক, এইটার একটা মীমাংসা আমি করব, মনে কষ্ট নেবেন না। মাস্টারিতে থাকলে এমন কষ্ট জীবনে আরো পেতে হবে। এইটা একটা প্রাথমিক নমুনা। ’
‘কিন্তু স্যার, একজন শিক্ষককে তাই বলে এভাবে ধমক শুনতে হবে?’
‘আপনি বলেই শুধু ধমকে পার পেয়ে গেছেন। অন্য কেউ হলে কঠিন শাস্তি পেতে হতো।
‘কেমন অদ্ভুত অবিচার স্যার?’
‘অদ্ভুত তো বটেই। পুরো সিস্টেমটাই যে অদ্ভুত। এই যে, লুঙ্গি পরে, একটা ফাইভ পাশ লোক আমার পাশে বসে আমাকে কমান্ড করে, শুনতে কি আমার ভালো লাগে? লাগে না। তবু শুনছি। তাঁর বিরুদ্ধে গেলেই বিপদ। এজন্যই বলি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ব্যাপারটা ভুলে যান। আপনাকে মেট্রিকের ডিউটিতে আর যেতে হবে না। ’
‘আমার খুব খারাপ লাগছে স্যার। ’
‘আপনার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। ভুলে যান। মূর্খের শাসনে অনেক কিছু ভুলে যেতে হয়। যান বাসায় যান। গিয়ে রেস্ট নেন। ’

শোকজ লেটার থেকে শুরু। এরপর স্টুডেন্টদের কাছে ইকরাম যতই প্রিয় হয়ে ওঠে, কিছু সহকর্মীর কাছে ততই হয়ে ওঠে বিষাক্ত। ইকরাম প্রাইভেট পড়ায় না, অন্যদের তাই প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে কথা শুনতে হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে হরিতোষ বাবুর নেতৃত্বে একটি দলও তলেতলে তৈরি হয়ে যায়। অবশ্য ইকরাম এসবে পাত্তা দেয়ার ছেলে নয়। তার কাজকারবার বই নিয়ে। তার রুমে বইয়ের বিশাল সংগ্রহ পড়ে রয়েছে। সে ওসবে মজে থাকে। ছেলেমেয়েদের পড়া বুঝিয়ে দিতে, পাঠগুলোকে আরো আকর্ষণীয় ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সে একাধিক রেফারেন্স-বই রুম থেকে সাথে করে নিয়ে যায়। অন্যদের মুখ টিপে করা তাচ্ছিল্যের কোনো বাতাসেই সে ভেসে যায় না, আমল দেয় না। সে বই নিয়েই পড়ে থাকে। ছেলেমেয়েরা যখন কিছু জানতে তাকে প্রশ্ন করে, তখন আরো বেশি তথ্য উপস্থাপন করতে তার মন উদগ্রীব হয়ে ওঠে। তার ভালো লাগে। পেশাটা সে তার মতো উপভোগ করতে চায়।

২.
দশদিনের ছুটিতে বাড়ি আসে ইকরাম। উদ্দেশ্য, দীর্ঘদিনের বান্ধবীর সাথে বিয়েটা সেরে ফেলা। আর কোনো ভাইবোন না থাকায়, ছোটকাকাকে নিয়ে বিয়ের বাজার করে ঘরে ফিরতেই পকেটের সেলফোনটি ঝনঝন করে বেজে ওঠে। তার হেড এক্সামিনারের ফোন। ইকরাম তাঁকে সালাম দেয়। উত্তরে হেড এক্সামিনার সাহেব বলেন, ‘আপনি এইটা কী করলেন ইকরাম সাহেব?’
‘কী হয়েছে স্যার?’
‘আপনি তো গণহারে ফেল করায়া দিছেন!
‘স্যার, আমি ফেল করাব কেন?’
‘চারশ’ খাতায় আড়াইশ’ই ফেল! আবার বলেন, ফেল করাব কেন? খাতা দেখছেন না কসাইগিরি করছেন?’
‘স্যার, আমি তো খাতা দেখায় কোনো ত্রুটি করিনি। খুব কষ্ট করে লাইনবাইলাইন পড়ে সারা রাত জেগে খাতা দেখেছি। ’
‘লাইনবাইলাইন পড়তে কে বলছে আপনাকে?’
‘তাহলে আমার করণীয় কী স্যার?’
‘যেখানে লেখা পান, সেখানেই নম্বর দিবেন। আজ রাতের ভেতর সব খাতা ঠিক করে দিয়ে যান। কমপক্ষে আশিভাগ পাশ দেখাবেন। ’
‘স্যার, আমি গ্রামের বাড়ি এসেছি। কাল আমার বিয়ে...’
‘এইটা কী বলেন! পরশু সব খাতা জমা দিতে হবে। আর এইভাবে হুটহাট করে কেউ বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়?’
‘স্যার, আমার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাতেই এই বিয়ে। আমি দশদিনের ছুটি নিয়েছি। ’
‘তাহলে আপনি অন্য কাউকে পাঠান। আপনার হয়ে খাতাগুলো ঠিক করে দিক। ’
‘এটা কিভাবে সম্ভব স্যার!’
‘সম্ভব-অসম্ভব আমি বুঝব। আপনি লোক দেন না হয় আপনাকেই আসতে হবে। এনি হাউ। ’
‘স্যার, আমি তো খাতা দেখতে কোনো ভুল করিনি। ’
‘ফেল করাইছেন, এটাই ভুল। আরে মিয়া, ক্যান বুঝেন না, যেভাবেই হোক, পাশের হার বাড়াতে হবে। এটা শুধু আপনার বিষয় নয়, এটা এক্সামিনার টু এক্সামিনার, কন্ট্রোলার টু কন্ট্রোলার, বোর্ড টু বোর্ড, আই মিন সারা দেশের প্রতিযোগিতা। যত বেশি সম্ভব, পাশের হার বাড়াতে হবে। ’
‘আই অ্যাম সরি স্যার, আমাকে ক্ষমা করবেন। কাজটাকে আমি অনৈতিক মনে করছি। আমি পারব না। ’
‘আপনি কি আমাকে বেকায়দায় ফেলতে ইচ্ছা করেই বিয়ের নাটকটা সাজালেন?’
‘সরি স্যার, কাল আমার বিয়ে না হলেও এই কাজ আমি করতাম না। আর যদি কাজটাতে নৈতিকতার সমর্থন থাকত তবে বিয়ের দিন হলেও আমি করতাম। ভালো থাকবেন। ’

৩.
ইকরাম, তার বান্ধবী ফৌজিয়া, যার সাথে কাল তার বিয়ে হতে যাচ্ছে, ইউনিভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই যার সাথে পরিচয়, তাকে ব্যাপারটা বলবে বলে ঠিক করে। ইকরামের সাথে ফৌজিয়ার চিন্তা-চেতনায় ব্যাপক মিল। এদের টেলিপ্যাথির বহু ঘটনা ক্যাম্পাসে তুমুল বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। ইকরাম অথবা ফৌজিয়া, দুজনের কেউ কাউকে হয়ত কিছু একটা বলল, দেখা গেছে, যার কাছে বলল সে খুবই বিস্ময় নিয়ে কথাটা এগিয়ে নেয়ায় মনোযোগী হয়ে উঠবে যেন ইকরামের আগে ফৌজিয়া বা ফৌজিয়ার আগে ইকরামই তা ভেবে রেখেছে।

আজ হেড এক্সামিনারের সাথে তৈরি হওয়া সংকটের ব্যাপারে বহুদিন পর তাদের টেলিপ্যাথির একটা পরীক্ষা নিতে চাইল ইকরাম। ফৌজিয়াকে ফোন করতে যেতেই উল্টো ফৌজিয়ার কল চলে আসে। এমনই হয়! ইকরাম ফোন রিসিভ করে, ‘বাঁচবে বহুদিন!’
‘মানে?’
‘মানে এখনই তোমাকে ফোন দিচ্ছিলাম। ’
‘কী করে বুঝলে, আমি তোমাকে মনে করছি?’
‘তুমি তো আমার ভেতরেই থাকো!’
‘বাব্বা, তা আমার ভেতরটা একবার পড়ে দেখুন তো মাস্টারমশাই..’
‘তোমাকে খুব খুশিখুশি লাগছে। তুমি না বললে, কাল রাতের আগে ফোনে আর কথা বলবে না!’
‘হ্যাঁ, বলেছি। যেহেতু কাল রাত থেকে আমরা নতুন করে সব কিছু শুরু করতে যাচ্ছি সেহেতু এর আগে এক দিনের ইচ্ছা-বিরতি। কিন্তু, হঠাৎ করেই এমন একটা সংবাদ পেলাম যে তোমাকে না জানালেই নয়। ’
‘বলো বলো, তাড়াতাড়ি বলো। ’
‘শোন, হানিমুনে আমরা বান্দরবান যাব ঠিক করেছিলাম না?’
‘হু। ’
‘এটা ক্যানসেল। ’
‘কেন?’
‘আমাদের হানিমুন হবে জার্মানিতে। ’
‘মানে!’
‘মানে হে মেধাবী, আমাদের দুজনেরই স্কলারশিপ হয়ে গেছে। ’
‘জার্মানি!’
‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ। এইমাত্র ওরা কনফারমেশন মেইল করেছে। ’

৪.
বিমানে ওঠার আগের দিন শেষবারের মতো পড়ন্ত সন্ধ্যার আকাশ দেখে ইকরাম। ছেলেবেলায় সন্ধ্যার এমন আলো খসা আকাশে ভাসতে থাকা মাগরিবের আজান তাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসত গোল্লাছুটের মাঠ থেকে। পুকুরপাড়ের গাছ আর ঘরবাড়ির ফাঁকফোকরে তাঁবু গাড়া অন্ধকার ঠেলতে ঠেলতে সে যখন ঘরে ঢুকত তখন মা হারিকেনের সলতেটা একটু বাড়িয়ে তার ঘরে রেখে আসত। ঘরে আলো জ্বলতো। কী চমৎকার হলদেটে আলো। ছোট্ট একটা শিখায় সারা ঘর ফর্সা হতো। বড় হওয়ার সাথে সাথে বুঝতে শেখে, আলো আসলে শুধুই পদার্থবিদ্যার একটি চিত্রসর্বস্ব টপিক নয় বা আমরা যাকে আলো বলে জানি তা শুধুই আলো নয়। আলো এক মহাশক্তি। এর ব্যাপক অর্থ ও বিচরণক্ষেত্র রয়েছে।

ইকরামের শিক্ষকতায় আসা সেই অর্থ-খোঁজারই এক মানবিক প্রচেষ্টা বলতে হবে। যে আড়াইশ’ খাতায় সে পাশ মার্ক দিতে পারে নি বা যে খাতাগুলো পাশ মার্ক তুলতে ব্যর্থ হয়েছে, সে খাতাগুলোর জন্য এখন তার খারাপ লাগতে শুরু করেছে। ছেলেবেলায় প্রতিটি দাঁড়িকমা ধরে ধরে পড়ে আসা ইকরাম সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়া শহরে আগন্তুকের চোখে তাকিয়ে থাকে। সে দেখতে পায়, অজস্র নানারঙা বাতির পাশেই ছেলেবেলার বাতিহীন অন্ধকারগুলো ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে।



বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।