পাড়াটার মাঝে একটা পুকুর; ছোট্ট পুকুর, যখন গ্রীষ্মের তাপে পানি কমতে থাকে—সাঁতরে এর মাঝখানে অনায়াসে দাঁড়ানো যায়। আর এটা যখন ভেসে যায় তখন কী এক মজা মজা, ভাপ ওঠা—কলমিলতা, নানা বুনো গাছের গন্ধ বেরোয়—এই গন্ধের সাথে মিশে আছে পাড়ার সবকটা মেয়ের শরীর! অদ্ভুত, না? তখন ওই টলটল পানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাটুলের গাছ, পুকুরটার লাগোয়া সরকারি অফিসের বাউন্ডারি দেয়াল—যা ঘেঁষে ফুরুত ফুরুত ভেসে ওঠে হলুদ গুইসাপ—ওরা এই পুকুরে ঝাঁপাত ভরা বর্ষায়; তেলের জার্কিনে বুকে ভর দিয়ে! তখন বাজারে এত রিফাইন্ড অয়েল আসে নি, তবু এই নতুন আমদানি তেলের জার্কিনে বাজার সয়লাব—ওরা কলার ভেলার সঙ্গে একে পুকুর পারাপারের বাহন হিসেবে ধরেছিল—যেন এক কদম সাঁতরেই ওরা জার্কিনের বুকে ভর দিয়ে পৌঁছে যেত ওপারে! এই খেলাটা ছিল মজার।
মেয়েটাকে কে বলেছিল বড় মেয়েদের একজোড়া উন্নত বুক থাকে—সে সুন্দর করে তার সমস্ত মেয়ে পুতুলের বুক বানিয়েছিল! এক ভাঁজ করা মোটা কাগজ দিয়ে বানানো সোফায় সেই উন্নত বুক নিয়ে তার মেয়ে পুতুলরা বিকেলবেলা বসে থাকত।
বিকেলে পুতুল—ধুমছে চলত পুতুল খেলা। সার সার লাইনে বসে পড়ত তারা পুতুলের ঘর সাজিয়ে। এর মেয়ের সঙ্গে ওর ছেলের, ওর ছেলের সঙ্গে তার মেয়ে—প্রতিদিন বিয়ের অনুষ্ঠান, প্রতিদিন ভুঁড়িভোজ—চানাচুর আর কলায়! হয়ত তাতে সঙ্গী এক টাকা দামের লজেন্স, দুইটাকা দামের বিস্কুট, সাদা পলিথিনে জমানো এক টুকরো বরই-তেঁতুলের চাটনি, বুনবুনি—এর পরে এসে জায়গা নিল জেমস চকলেট। মেয়েটাকে কে বলেছিল বড় মেয়েদের একজোড়া উন্নত বুক থাকে—সে সুন্দর করে তার সমস্ত মেয়ে পুতুলের বুক বানিয়েছিল! এক ভাঁজ করা মোটা কাগজ দিয়ে বানানো সোফায় সেই উন্নত বুক নিয়ে তার মেয়ে পুতুলরা বিকেলবেলা বসে থাকত। মেয়েদের বুক থাকে, এক জোড়া বুক—ভর দুপুরে যখন সবাই ঘুমাত—মেয়েটি ওদের ঘরের লোহার আলনার পিছনে অনেক কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে রাখা মায়ের ছেঁড়া ব্রাটা একদিন পরেছিল আর অনুভব করেছিল হঠাৎই ফুলে-ফেঁপে ওঠা স্তন! এরপর নেশা পেল, এরপর নেশা এলো—একদিন, দুইদিন মায়ের লাল রঙের ছেঁড়া ব্রাটা কোনোমতে তার অনুন্নত বুকের সাথে জুড়ে দিয়ে ঘরময় পায়চারি করত। মেয়েটি বলেছিল সে বিয়ে করবে কিন্তু একজোড়া বুক দিয়ে কী করবে তা সে জানত না! শুধু মনে হয়েছিল সুন্দর হতে চায় সে—মায়ের মতো সুন্দর!
ওই পাড়ার আর সব মেয়েরাও হয়ত চেয়েছিল বিয়ে করতে! সবার কী এক নেশা পেল—বিয়ে! হঠাৎই টইটুম্বুর পাড়াটি মরা শ্মশান হয়ে গেল। পুকুরে কোনো স্রোত ছিল না, গুইসাপগুলো হয়ে গেল অন্তরিন, মাঠের সবুজ ঘাস ওদের পুতুলের গৃহস্থালীর অভাবে কেমন পুরুষ্ট হয়ে বুড়ো হয়ে গেল! আর একটা জিনিস ঘটেছিল—আগে প্রতিদিন যে চুড়িফিতেওয়ালা তার কাচ দিয়ে ঢাকা কাঠের ফ্রেমটা সাজিয়ে-গুছিয়ে আসত, সে আসা বন্ধ করেছিল, তারচেয়ে বরং ঘনঘন আসতে শুরু করেছিল বাসন-পত্র ওয়ালা। মা তার পুরনো কাপড় দিয়ে, কখনো কখনো মাসে মাসে টাকা শোধের শর্তে সেইসব স্বচ্ছ কাচের বাসনে ঘর ভরাচ্ছিল। আর-মায়েরাও সেটাই করছিল। বিয়ের ঠিক পাঁচ বছর পরে যখন মেয়েটি দীর্ঘ সময়ের জন্য তার পাড়ায় ফিরল—মেয়েটির মনে হলো বিয়ে ভুল, ভুল, ভুল! মরে গেছে পাড়াটা। বিয়ের আগুনে জ্বলে গেছে এর শান্ত-সৌম রূপ। অথচ বিয়ে কী বোঝার আগেই মেয়েটি তার পরিবারের লোকজনকে বলেছিল, আমি বিয়ে করব, বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পোলাও-গোশত রেঁধে তোমাদের খাওয়াব।
মেয়েটির মনে আছে প্রথম যেদিন পাড়াটার পরিবর্তন এলো—খেলার এক সঙ্গীর ঘরের জানালা মেয়েটির মা লোহার পেড়েক দিয়ে বন্ধ করে দিল। মায়েরা কি নিষ্ঠুর হয়? তারা সবসময় চায় তাদের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাক! সঙ্গী মেয়েটির চোখ ছলছল করছিল। তার ঘরের একটা মাত্র জানালা বন্ধ—প্রায় অন্ধকার ঘরে বসে সে তখন ভাবছিল মেহেদিতে চুন-খয়ের মেশালে রং গাঢ় হয়! লিলাক তার এই সঙ্গী মেয়েটির বন্ধ জানালার রহস্য জানত—কেউ ওকে বলে নি এমনকী সঙ্গী মেয়েটিও না; হয়ত বলার মতো তখনও কিছু দাঁড়ায় নি—লিলাক জানত অই বন্ধ জানালার ওপাশে আছে আরেকটা জানালা, যেটা ছিল মেয়েটির চাচাত ভাইয়ের। মায়েরা কেমন ঠেলে ঠেলে দিচ্ছিল মেয়েদের বিয়ে-গৃহস্থালীর উঠানে, যেন তাদের অনুরূপ না হলেই মরে যাবে তারা! নাকি তারা ঘর ফাঁকা করছিল নিশ্চিন্তে একটু দম নেবে বলে? পাঁচ বছর পর ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে লিলাকের মনে হলো, তার মতো করে হয়ত কেউ বোঝে নি মৃত নদীর ঢেউ কেমন হয়, বিপুল কাঁটাতারের বেড়ায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে লোকে কিভাবে ভুলে যায় তার প্রাচীন মানচিত্রের কথা; কেন ভাগ হয় দেশ, কেন হয় ঘর!
পাঁচ বছর পর লিলাক জানল সেই পেরেক আটকানো ঘরের বাসিন্দা, তার খেলার সঙ্গী মেয়েটি একবার এসেছিল এখানে অনেকদিন। অন্য এক ঘর খুঁজে মা বিয়ে দিয়েছিল তাকে। সে সময় বাড়িতে সবার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। হায় সম্মান, হায় টাকা, হায় ভার, হায় মর্যাদা। ধড়ফর করে বাড়ির সবাই নামাজ-রোজা-দোয়া-দরুদ পড়তে লেগে যায়। কেমন দম বন্ধ করা বাতাস বুকে ভরে লিলাক শোনে—প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিল মেয়েটিকে তার বর! কতজন সেই ঢোলে বাড়ি দিচ্ছিল—যেন কী এক খেলা; একটা ছেড়ে দিলেই পাওয়া যাবে আরেকটা, আর নির্লজ্জ মেয়েরাও যেন বিয়ে নামক স্টেশনে বসে বসে ঝিমায়; কখন ডাক আসবে আর ঝুলে যাবে! এরপর আর অনেকদিন মেয়েটা পাড়াতে তার ঘরে আসে না, বর চায় না মায়ের বাড়ি আসুক, মা চায় না মেয়ে মায়ের বাড়ি আসুক! মা কামনা করে সংসার বেঁচে যাক মেয়ের, খুব করে কামনা করে। আর অই সঙ্গী মেয়েটা—বাচ্চা হয়, বাচ্চা মরে যায়—সে মেয়েটাও খুব করে এক সাধারণ মিস্ত্রির প্রেমে পড়ে যায় পুতুল খেলার দিনে। তুমুল প্রেমগুলো কেমন তুমুল করে দূরে ঠেলে। মা তার কপাল চাপড়ান—নিজের কপাল পুড়েছে, পুড়েছে; মেয়ে যাবে তার সামান্য মিস্ত্রির ঘরে?
এক ব্যবসায়ী ধরে আনা গেল—বাচ্চা বাঁচে না বলে তারও ধৈর্য স্থলন হলো। জীবন হলো উত্থান, জীবন হলো পতন! তবে যাই হোক, যাই বলুক লোকে—মায়েরা মনেপ্রাণে চায় মেয়েদের সংসার যেন বাঁচে। একটা বাচ্চা খোদার কুদরতে এসে গেল—কত ঝারফুক-দোয়া-তাবিজ, খুব করে হলো সব। শুধু বিয়ে পাড়াটাকে কেমন নিস্তব্ধ করে দিল আর সেইসব মেয়েদের মায়েরা এখন বুক ফুলিয়ে বলতে পারে, ‘মেয়ে তার অমুক ঘরে আছে, স্বামীর ঘর আসল ঘর; একবার যখন ঢুকেছ ওই ঘরে মৃত্যু হলেই তবে বের হবে। ’ লিলাক ভয় পায় ওই সঙ্গী মেয়েটির জন্য, সেও পাড়া থেকে মুছে গেছে—জায়গা নিয়েছে আরেক পাড়ায় কিস্তু ওর চাইলেও কোনোদিন বাচ্চা হবে না। লিলাক ভয় পায়—ওই একটি মুখের কান্নার দীর্ঘ করুণ রূপ দেখতে পাওয়ার শঙ্কায় কাঁপে লিলাক। মায়েরা তো চায় তাদের মেয়েদের সংসার বাঁচুক; মেয়েরাও চায়।
লিলাক তার নিজের গল্প বলবে না এখন, কিছু অন্যের গল্প বলবে, এখন এটুকুই বলবে পাঁচ বছর পর নিথর, ভাষাহীন, মুখ-বধির কবর পাড়াটায় ফিরে তার সেই দিনের; সেই সকালের কথা মনে পড়ে—খুব ভোর তখন; একটা রিক্সার খোঁজে সে হাঁটছে। দরজায় মা তাকে বিদায় দিয়েছে। মা জানে সে বিয়ে করতে চায়, মা জানে সে সংসার করতে চায়—মায়েরা সেই চাওয়াকে এ্যাপ্রিসিয়েট করে। এক ফুফু এনেছে বিয়েটা। ছেলে বেশ বড়লোক আবার লেখাপড়াও শেখাবে বলেছে! লিলাক ভাবে বাবা অসমর্থ্য—যদি এই বিয়েটা সে করে বাবাকেও কিছু সাহায্য করা যাবে, পড়ালেখাও বন্ধ হবে না। কিন্তু কী হবে তার দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্কের? লিলাক ভাবে ওর অন্যায় হচ্ছে না! সে তার পরিবারকে যেকোন উপায়ে সাহায্য করতে চায়—এ অন্যায় না। কিংবা ন্যায়-অন্যায় বোঝার বয়স তখন ছিল না। এই বোধহীন বোধ প্রেমটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিল তবু এত বছর পরেও লিলাকের মনে হয় সে অন্যায় করে নি—সে সাহায্য করতে চেয়েছিল নিজেকে বিক্রি করে!
মনে পড়ে সেই সকালের কথা, যেকোন কারণেই হোক ফুপুর আনা সে ছেলে লিলাককে বিয়ে করতে চায় না। এরমাঝে সম্পর্কটাও ভেঙে গেছে, ফিরবে কোথায় লিলাক! কোন মাঝে? মা তাকে বিদায় দিচ্ছে সেই সকালে, সে যাচ্ছে বড় পীরের কাছে; পীরের তদবিরে যদি কিছু হয়। এই পাড়ার লোকজনের এগুলোতে এত বিশ্বাস, লিলাকও বিশ্বাস করতে চায় দৈবক্রমে বিয়েটা হয়ে যাক তার! কেমন বিবমিষা জাগায় সেই সকাল, কেমন হাহাকার জুড়ে থাকে সেই যাওয়াতে! বসে থাকে সে অন্ধ পীরের দরবারে। খেজুর বাগান ঘেরা লাল সুড়কির পথ ভেঙে লিলাক সেখানে পৌঁছেছে। পীর বলেন, বিয়ে হবে, এখানেই হবে; ছেলের চৌদ্দগুষ্টি এসে বিয়ে করিয়ে নিয়ে যাবে! একটা হাতির দাঁতের চিরুনি দেখিয়ে বলেন, এতে চুল আঁচড়াবে, ওই ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হবে! লিলাক কাঁদতে পারে না, লিলাক হাসতেও পারে না; বলতে পারে না তার ভালোবাসা ভেঙে গেছে! লিলাক মরিয়া হয়ে দোয়া কাটা হাতির দাঁতের চিরুনি মায়ের হাতে এনে দেয়, মা চিরুনিটা দিয়ে চুলে এক টান দিতেই হাত ফসকে ওটা পড়ে যায় মেঝেতে!
লিলাকের প্রেমিকও জীবনে প্রথম গোলাপ লিলাককে দিতে গিয়ে হাত থেকে ফেলে দেয়! পাঁচ বছর পরে যখন মৃত পাড়ার মুখোমুখি দাঁড়ায় লিলাক—তার চোখে পড়ে ঘরের কোণায় তখনও রয়ে যাওয়া চিরুনিটা। দোয়া সমেত চিরুনিটা দূরে ছুঁড়ে দেয়; মাকে বকে কেন মা এতদিনেও সেটা ফেলে দেয় নি! লিলাকের সেসময় মনে প্রশ্ন জাগে—কী ঠেলে দেয় একটা মেয়েকে বিয়েতে? শরীর? টাকা? অভিমান না মায়েদের জীবন—মায়ের মেয়ে হওয়ার চেষ্টা? ঝনঝন করে বাজে লিলাকের মায়ের গৃহস্থালীর বাসন-কোসন! ওই ঝনঝন শব্দে লিলাকের ঘুম পায়! ঘুমাতে ঘুমাতে বলে, ভুল ভুল, বিয়ে ভুল মা!
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৫