এক যে ছিল মেয়ে। সৌন্দর্যে আর সৌকর্যে যার জীবনের পথচলা শুরু।
নতুন খেলনা কুকুরছানাকেও এমন অদ্ভুত রকমের বোকা বোকা লাগে শুধুমাত্র এই এক কারণে—সেও এই চাপা আওয়াজ শুনতে পায় বাড়ি জুড়ে। “টাকা চাই! আরও টাকা!” তবু মুখ ফুটে কেউ কিছু বলে না। এই গোপন আর্তনাদ চারিদিকে ভেসে বেড়ায়। আর এই কারণেই কেউ এর কথা বলে না। ঠিক যেমন সারাক্ষণ নিঃশ্বাস চলতে থাকলেও কেউ বলে না যে “শ্বাস নিচ্ছি”
তার একটি ছেলে আর ছোট্ট দু’টি মেয়ে। বাগানঘেরা ছিমছাম বাড়ি। সেই সাথে আছে করিৎকর্মা সব কাজের লোক। তাই পাড়ার যে কারো চেয়ে নিজেদের বড় বলেই ভাবে তারা। এত স্বচ্ছলতার মাঝেও বাড়িজুড়ে সারাক্ষণ এক চাপা হাহাকার। সংসারে অভাব যেন নিত্যসঙ্গী। মায়ের সামান্য কিছু আয় আছে, বাবারও তাই। কিন্ত তাদের চাহিদামাফিক ঠাটবাট বজায় রাখতে এই আয় মোটেও যথেষ্ট নয়। বাবা শহরের কোন এক অফিসে কাজ করে। রোজগারপাতির সম্ভাবনা ভালোই, কিন্ত সে সম্ভাবনা কখনো বাস্তবে রূপ নেয়নি। অভাবের যাঁতাকলে চিড়েচ্যাপ্টা দশা হলেও ঠাটবাটের কোনো রকম কমতি নেই।
শেষমেষ একদিন মা বলে বসে, “দেখা যাক এবার আমার দ্বারা কিছু হয় কি না”। কিন্তু সে নিজেও জানে না কিভাবে কোথা থেকে শুরু করবে। ভেবে ভেবে সারা হয়। এটা সেটা নানান কিছু চেষ্টা করতে থাকে। তবু সাফল্যের সোনার হরিণ অধরাই রয়ে যায়। তার কপালে এবার চিন্তার ভাঁজ। ছেলেমেয়েরা দিন দিন বড় হচ্ছে। আজ বাদে কাল স্কুলে যাবে। আর তাই টাকা চাই, আরো টাকা। রূপবান ও রুচিবান এই বাবাকে দেখে মনে হয় না তার দ্বারা জুৎসই কোন কাজ আদৌ সম্ভব। মায়ের অবশ্য আত্মবিশ্বাসের কোনো কমতি নেই। অথচ তারও সেই একই দশা। তাই বলে রুচিতে সে স্বামীর চেয়ে কোনো অংশে কম যায় না।
এবং তাই পুরো বাড়ির আনাচে কানাচে এক চাপা আওয়াজ ভেসে বেড়াতে থাকে—“টাকা চাই! আরো টাকা!” বড়দিন উপলক্ষে যখন বাড়ির খেলাঘরটি চমৎকার আর দামি সব খেলনায় সেজে উঠে তখনও ছেলেমেয়েরা সেই অব্যক্ত আওয়াজ টের পায়। হালফ্যাশানের চকচকে কাঠের খেলনা ঘোড়া আর ফিটফাট পুতুল-বাড়ির পেছন থেকেও একই আওয়াজ যেন গুমরে গুমরে বলে যায়—“টাকা চাই! আরো টাকা!”
দুলতে থাকা খেলনা ঘোড়ার স্প্রিং থেকেও যেন এই আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। ঘোড়াটি যেন তার খসখসে কাঠের মাথা কাত করে শুনতে থাকে সেই আওয়াজ। খেলনা গাড়িতে বসানো বড়সড় গোলাপী পুতুলটিও যেন হাসতে হাসতে এই আওয়াজ শুনতে পায়। আর শুনতে পায় বলেই যেন ইচ্ছে করে এমন বোকার মতো হাসতে থাকে। নতুন খেলনা কুকুরছানাকেও এমন অদ্ভুত রকমের বোকা বোকা লাগে শুধুমাত্র এই এক কারণে—সেও এই চাপা আওয়াজ শুনতে পায় বাড়ি জুড়ে। “টাকা চাই! আরও টাকা!”
তবু মুখ ফুটে কেউ কিছু বলে না। এই গোপন আর্তনাদ চারিদিকে ভেসে বেড়ায়। আর এই কারণেই কেউ এর কথা বলে না। ঠিক যেমন সারাক্ষণ নিঃশ্বাস চলতে থাকলেও কেউ বলে না যে “শ্বাস নিচ্ছি”।
একদিন তাদের ছেলে পল এসে মায়ের কাছে জানতে চায়, “মা, আমাদের নিজেদের গাড়ি নেই কেন? কেন আমরা সবসময় মামার গাড়ি নয়ত ট্যাক্সিতে চড়ি?”
মা বলে, “কারণ পুরো বংশে আমরাই সবচে’ গরীব। ”
“কেন, মা?”
“কারণ তোর বাবার ভাগ্য বলতে কিছু নেই”, মায়ের গলায় তিক্ত ঝাঁঝ।
ছেলেটি কিছুক্ষণ নীরব থাকে। সে খানিকটা ভয়ে ভয়ে জানতে চায়, “‘ভাগ্য’ মানে কি টাকাপয়সা, মা?”
“না, পল। ঠিক তা না। ‘ভাগ্য’ থাকলেই লোকের টাকা পয়সা হয়। ”
পল মায়ের কথা ঠিক বুঝতে পারে না। সে বলে, “ও, অস্কার মামা যে ভাগ্যের মালপানির কথা বলে, আমি তো ভাবি মামা টাকার কথাই বলে। ”
মা বোঝায়, “ভাগের মালপানি বলতে তোর মামা টাকার কথাই বোঝায়। কিন্তু সে ‘ভাগের’ কথা বলে, ‘ভাগ্যের’ কথা না। ”
ছেলে বলে, “ও আচ্ছা, তাহলে ভাগ্য কী জিনিস, মা?”
মা বলে, “ভাগ্য থাকলেই টাকা হয়। যার ভাগ্য থাকে, তার টাকাও থাকে। তাই জন্মের সময় টাকার চেয়েও ভাগ্য থাকা বেশি ভালো। ধনী হলে টাকা হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু ভাগ্য থাকলে আরো বেশি করে টাকা হাতে আসে। ”
“ওহ, তাই বুঝি? তাহলে বাবার কি ভাগ্য নেই?”
“না রে, একেবারে অভাগা লোক একটা। ” মায়ের কথার সুর রীতিমত তিক্ত-বিরক্ত।
ছেলে ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“কেন?” সে জানতে চায়।
“জানি না। একজন মানুষের কেন ভাগ্য থাকে, আবার আরেকজনের কেন থাকে না তা কেউ জানে না। ”
“তাই বুঝি? কেউ জানে না? কেউ-ই না?”
“হয়ত ঈশ্বর জানেন। কিন্তু তিনি কখনো বলেন না। ”
“তবে তো তাঁর বলা উচিৎ। কিন্তু তোমারও কি ভাগ্য নেই, মা?”
“না রে, অভাগা লোকের সাথে বিয়ে হলে কারো ভাগ্য থাকে না। ”
“কিন্তু তোমার নিজের কি ভাগ্য নেই?”
“বিয়ের আগে ভাবতাম আমার ভাগ্য আছে। কিন্তু এখন কেবল উল্টোটাই মনে হয়। ”
“কেন?”
“থাক ওসব কথা। এমন তো নাও হতে পারে। ”
এটাই মায়ের মনের কথা কিনা তা বোঝার জন্য ছেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু মায়ের চোখমুখ দেখে তার মনে হয় মা কী যেন একটা লুকানোর চেষ্টা করছে।
“তবে যাই হোক”, ছেলের অহঙ্কারী জবাব, “আমার কিন্তু ভাগ্য আছে। ”
“কেন, রে?” মা এবার হেসে ফেলে।
সে মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সে নিজেও জানে না এ কথা কেন বলেছে।
“ঈশ্বর আমাকে বলেছেন,” গর্বে ছেলের বুক ফুলে দশহাত।
“তিনি বললে তো ভালোই হয়, বাবা। ”
“তিনি বলেছেন, মা। ”
“চমৎকার!” মা এবার বাবার মতো ভঙ্গি করে বলে ওঠে। ছেলেটি দেখল যে মা তার দাবি বিশ্বাস করা তো দূরের কথা বরং কোনো পাত্তাই দেয়নি। মনে মনে তার রাগ হয়। তার মন চায় জোর করে মায়ের নজর কাড়তে। ছেলেমানুষী ভঙ্গিতে সে আপনমনে গুটি গুটি পায়ে চলে যায় “ভাগ্যে”র সূত্র খুঁজতে। ভাগ্যকে তার চাই-ই চাই।
খেলাঘরে যখন তার বোন দু’টি পুতুল খেলায় ব্যস্ত, তখন বড় কাঠের ঘোড়ায় চড়ে জোরে জোরে দুলতে দুলতে তার এমনই মত্ত অবস্থা হয় যে বোন দু’টি উসখুস করতে থাকে। তারা আড়চোখে দেখতে থাকে ভাইয়ের কাণ্ড-কারখানা । দুরন্ত বেগে দুলতে থাকে ঘোড়া আর সেই সাথে দুলতে থাকে তার কালো ঢেউ খেলানো চুল। ছেলেটির চোখে তখন অদ্ভুত এক আগুনের ফুলকি। বাচ্চা মেয়ে দু’টির সাহস হয় না ভাইয়ের সাথে কথা বলার।
এই উন্মত্ত ঘোড়দৌড় শেষে ছেলেটি ঘোড়া থেকে নেমে এসে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ঘোড়াটির মুখের দিকে। ঘোড়ার লাল রঙের মুখটি সামান্য খোলা আর বড় বড় চোখদু’টি কাচের মতো ঝকঝকে।
“চল! এক্ষুণি আমাকে ভাগ্যের কাছে নিয়ে চল! চল বলছি!” সে মনে মনে ঘোড়াকে হুকুম করে।
অস্কার মামাকে বলে ছোট্ট একটা চাবুক আনিয়েছে, আর সেটা দিয়েই সে ঘোড়ার ঘাড়ে চাবকায়। এই ঘোড়াই যে তাকে ভাগ্যের কাছে পৌঁছে দিতে পারে সেটা তার ভালোই জানা আছে। একটু জোর খাটালেই কাজ আদায় করা যাবে। তাই সে আবার তার খেলনা ঘোড়ায় চেপে প্রবল বেগে ছুটে চলে, যদি কোনোভাবে ভাগ্যের নাগাল পাওয়া যায়। সে জানে তার এই চেষ্টা একদিন ঠিকই সফল হবে।
“তোমার ঘোড়া তো ভেঙে যাবে, পল” পলের আয়া বলে।
“সারাক্ষণ খালি ঘোড়ার পিঠে। এবার একটু থামলে ভালো হতো,” পলের বোন জোন বলে উঠে।
জবাবে পল কেবল কটমট করে চেয়ে থাকে তাদের দিকে। আয়া এবার হাল ছেড়ে দেয়। এই ছেলেটির চালচলন সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। অবশ্য ছেলেও এখন মোটামুটি বড় হয়ে গেছে। সারাক্ষণ আয়ার দেখভালের আর দরকার পড়ে না।
একদিন মা আর অস্কার মামা খেলার ঘরে গিয়ে দেখে সে রোজকার মতো ঘোড়ার পিঠে। পল তাদের সাথে কোনো কথা বলে না।
“কিরে জকি! বাজিমাৎ হবে তো?” মামা বলে।
“তোর কি এখনো কাঠের ঘোড়ায় দোল খাওয়ার বয়স আছে নাকি? তুই আর এখন একেবারে ছোট্টটি নেই, বুঝলি,” মা বলে।
পলের নীল চোখজোড়া মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠে শুধু। মত্ত অবস্থায় সে কারো সাথে কথা বলে না। মা চিন্তিত মুখে ছেলের কাণ্ড-কীর্তি দেখতে থাকে। হঠাৎ এক সময় সে ঘোড়া থামিয়ে নেমে পড়ে।
“পেয়ে গেছি!” সে চিৎকার করে সবাইকে বলে উঠে। তার নীল চোখগুলো যেন জ্বলছে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি বলিষ্ঠ, আত্মবিশ্বাসী।
“কী পেয়েছিস?” মা জানতে চায়।
“যা চেয়েছি, তাই পেয়েছি!” ছেলের তেজী জবাব।
“ঠিক বলেছিস, ভাগ্নে। কোনো কিছুর শেষ না দেখে থামতে নেই। তোর ঘোড়ার নাম কী রে?” অস্কার মামা বলে।
“ওর কোন নাম নেই,” ছেলেটি বলে।
“নাম ধরে না ডাকলেও কথা শোনে?” মামা জানতে চায়।
“আসলে ওর অনেকগুলো নাম। গত সপ্তাহে নাম ছিল ‘স্যানসোভিনো’। ”
“‘স্যানসোভিনো’? ওই ঘোড়া তো এ্যাস্কট-এর রেস জিতেছিল। এই নাম তুই কী করে জানলি?”
“ও তো সারাক্ষণ শুধু ব্যাসেটের সাথে রেসের গল্প করে,” জোন বলে।
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৫