ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঘর ভাঙা ঝড় | আকাশ মামুন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৬
ঘর ভাঙা ঝড় | আকাশ মামুন

মোহাব্বত শেখের টানাটানির সংসার। পা ভাঙা কুকুর যেমন লেংচিয়ে লেংচিয়ে চলে ঠিক তেমন করেই সংসার চলে তার।

আজ চাল আছে তো ডাল নেই, নুন আছে তো তেল নেই, ঘরের ছাউনি আছে তো বেড়া নেই। ফু্টো চালে যেমন চৈত-বৈশাখে চাঁদের আলো আসে তেমনি শাওন-ভাদ্দরে গড়ায় বৃষ্টির জল। পাটখড়ির ভাঙা বেড়ার ফাঁকে রাতদিন ঘরে বিড়াল-কুকুর আসা যাওয়া করে। গঞ্জের পুরনো কাপড়ের দোকান থেকে যতোটা রোজগার হয় তাতে দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করাটাই রাজ্যজয় করার মতো। এমন অবস্থায় লুফে নেওয়ার মতো একটা খবর এলো বটে। কিন্তু খবরটা শুনে মোহাব্বত গোখরোর মতো ফুঁসে উঠলো।

তার কথা- না খায়া মরুম। বৌ কামাই করবো হেই টেহায় খামু-পিন্দিমু? মাগীর শখ দেখছো! ভাতার ধরবো-নাং কইরা বেরাইবো। ফুঁস করে ফণা তোলা গোখরো যেমন শিকড় দেখে মাথা নুইয়ে ফেলে তেমনি পাড়া-পড়শি, আত্মীয়স্বজনের অভিযাচিত কথাবার্তায় দমে গেলো মোহাব্বত। ঠিকইতো, এহন দু’জনের সংসারই চলে না। পুলা-মেয়া যহন হবো তহন ক্যামনে চলবো।

একটা বিদেশি এনজিওতে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে যোগদান করলো বিন্তি বেগম। চৈত্রে পুরো গাছ যেমন বৈশাখের বৃষ্টিতে লকলকিয়ে ওঠে ঘন সবুজ পাতায়, তেমনি মোহাব্বত-বিন্তির সংসারে সুখের ডগা লকলকিয়ে মাথা তুলতে লাগলো। এখন আর চালের ফুটোয় চাঁদের আলো ঘরে আসে না, বৃষ্টির জলে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বসে থাকতে হয় না। হাতের ডগায় চুন আর মুখ ভর্তি পানের ঘন ঘন পিক ফেলতে ফেলতে মোহাব্বত ক্রেতাদের বোঝায়- কাপড় ভালা, বাইছ্যা লন বিশ ট্যাহা।

এক অভাবের সাগর থেকে আরেক অভাবের সাগরে এসে পড়েছিলো বিন্তি। পুষ্টির অভাবে বয়স বাড়ার সঙ্গে দৈহিক বৃদ্ধি তাল মেলাতে পারেনি। তাইতো নারীসুলভ দৈহিক সৌষ্ঠব যতোটা বাড়ার কথা ছিলো ততোটা বাড়েনি। সেই লিকলিকে দেহ সুখের ছোঁয়া পেয়ে যেনো হয়ে উঠছে বিকশিত অঙ্গনা। কালো বিবর্ণ চেহারায় ঠিকরে পড়া রূপ যা বোঝায়, তা না হলেও কেমন একটা বান ডেকেছে সত্যি। দেহে স্পষ্ট হয়ে উঠা নানা বাঁক, নারীর বয়স সুলভ সৌন্দর্য জানান দিচ্ছে। আর এটাই যেনো কাল হলো বিন্তির। দিনকে দিন মোহাব্বতের সন্দেহ বাড়তে লাগলো বিন্তিকে নিয়ে।

ঘটনার সূত্রপাত সেদিন দুপুরে। পৌষের শীতে জড়সড় প্রকৃতি। সূর্যের দেখা নেই। তাই বলে দিন আর বসে থাকেনি, সূর্যকে ছাড়াই গন্তব্যে ছুটে চলছে। গঞ্জে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। শীতে জড়সড় হয়ে গঞ্জে যাওয়ার যোগাড়যন্ত করছিলো মোহাব্বত। কাপড়ের গাঁট বেঁধে সাইকেলে একা তোলার কসরত করতে গিয়ে সাইকেলসহ পড়ে গেল হুড়মুড় করে। তা দেখে উত্তর পাড়ার হাসনা বেওয়া টিপ্পনি কেটে বললো- কিগো মোহাব্বত, বৌ তো কামাই করতাছেই। তুমি এবার ছাইড়া দেও না।

টাং করে বিণার তার বেজে উঠার মতো দেমাগে লাগলো মোহাব্বতের।
সে বললো- ক্যা, তর কী মনে অয়? আমি বউয়ের কামাই খাইতে বইয়া থাহি? শালির যা কামাই, তাইতে ওরই শ্যাঠা ভরে না!
-    হ, আমিও তাই কই, মোহাব্বতের মতো মানুষ বউয়ের কামাই খায় কিবা কইরা! হেই দিন দেখলাম, ডিস্কু মাইয়া দহিন পারার মতলুর লগে যে পরিমাণ হাসাহাসি করতাছে আল্লাই মালুম!
-    সত্যি কইরা ক হাসনা কী দেখছস। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজেই এবার গাঁটসমেত সাইকেলটা ফেলে দিলো মোহাব্বত।
হাসনা মোহাব্বতের রুদ্রমূর্তি দেখে ভিরমি খেয়ে বলতে লাগলো- কী জানি ভাই, আমি কী কমু আবার হাইকোট দেহন লাগবো। আমি কিছু জানি ন্যা। তোমাগো ভালা তোমারাই দেহগা। আমি ক্যাচালে নাই।

গঞ্জে না গিয়ে বিন্তির বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ছিলো মোহাব্বত। আজ হেস্তনেস্ত কিছু একটা হয়ে যাবে তা মোহাব্বতের রূঢ় মূর্তি দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। সন্ধ্যা হয় হয় করে যখন বিন্তি বাড়ি ফিরলো তখনই তার উপর গরু তাড়ানোর লাঠি নিয়ে চড়াও হলো মোহাব্বত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো বিন্তি। শুনতে পেলো খিস্তি দিয়ে মোহাব্বত বলছে-  শালি কার লগে নাং কইরা বেরাস ক? কার নিগা এতো হাইজ্যা-পুইরা যাস? তর চারকি আজ আমি ছুইট্যাইয়া দিমু। আজক্যার থিকা তর চারকি বন্দ।

এবার মুখ খুললো বিন্তি- কী এমন সুখে রাখছো? জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ কী পুইরা করছো? তোমার কাছে আইয়া জীবনডারে তিলে তিলে ধ্বংস করছি। এহন যহন নিজ হাতে জীবনডারে সুন্দর করবার লাগছি তহন তোমার সহ্য হয় না তাইনা? জিদ্দে জইল্যা-পুইড়া মরতাছো।

এবার যেনো দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো মোহাব্বত। তার উপর্যুপরি আঘাতে সন্তান সম্ভবা বিন্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। ততক্ষণে চিৎকার চেঁচামেচিতে জটলা বেঁধেছে। এবার হারুর মা এগিয়ে এলো বিন্তিকে মুক্ত করতে। বিন্তির শরীর রক্তে ভিজে গেছে। শত চেষ্টাতেও আর বিন্তির জ্ঞান ফিরে এলো না। মোহাব্বতকে প্রতিবেশীদের অনেকেই পালানোর পরামর্শ দিয়েছিলো। কিন্তু নির্বিকার মোহাব্বত কারও কথা না শুনে পুলিশের অপেক্ষায় বসেছিলো। সকাল নাগাদ পুলিশ এসে মোহাব্বতকে থানায় নিয়ে গেলো আর পোস্টমর্টেমের জন্য মর্গে গেলো বিন্তির লাশ।


বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০১৬
এসএমএন/এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।