ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

‘থিয়েটারের সংজ্ঞা সারাজীবন এক রাখার কী দরকার’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫২ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৬
‘থিয়েটারের সংজ্ঞা সারাজীবন এক রাখার কী দরকার’ ছবি: সংগৃহীত

ড. ইস্রাফিল শাহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক। বাংলাদেশে থিয়েটারের চর্চা ও প্রসারে কাজ করে চলেছেন নিরন্তন।

থিয়েটারের প্রয়োজনে ভ্রমণ করেছেন ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ আর ভারত তার নিজের শিক্ষাভূমি। দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকেই তার নাট্যশিক্ষা। নির্দেশক হিসেবেও কাজ করেছেন বিভিন্ন দেশে। থিয়েটার গবেষণা ও প্রকাশনা তো রয়েছেই। বর্তমানে প্রতিনিয়ত বিস্তার লাভ করছে তার কর্মক্ষেত্র। স্বীকৃতও হচ্ছেন কর্মক্ষেত্রের তার অবদানের জন্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে নাট্যশিক্ষার বিস্তারে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন।  

সম্প্রতি মিসরের কায়রো একাডেমিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন থেকে ফিরে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের নাট্যচর্চা, নাটক এবং ইস্রাফিল শাহীনের নিজস্ব নাট্যচর্চা পদ্ধতি নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। বাংলানিউজের পক্ষ থেকে কথোপকথনে অংশ নেন তরুণ নাট্য গবেষক ও নির্দেশক মেহেদী তানজির। এরই চুম্বকঅংশ বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

বাংলানিউজ: মিসরের কায়রো একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন সম্বন্ধে জানতে চাই।
ইস্রাফিল শাহীন: কায়রো একাডেমিতে এটাই প্রথম আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন’। মোট ১৩টি দেশ থেকে বিভিন্ন নাট্য গবেষক, নির্দেশক ও শিক্ষক অংশ নেন এ আয়োজনে। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ অংশ নেয় এখানে। বাংলাদেশ থেকে আমার সুযোগ হয় অংশ নেওয়ার। সাত দিনব্যাপী সেমিনার, বিভিন্ন প্রযোজনা দেখা এবং মিসরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সাস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রদর্শন ছিলো এ আয়োজনের অংশ।

বাংলানিউজ: এ সম্মেলনে আপনার ভূমিকা কী ছিলো?
ইস্রাফিল শাহীন: আয়োজনের সব ইভেন্টগুলোতে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি সেমিনারে আলোচনা করতে হয়েছে। সেখানে মূলত আমার থিয়েটার সম্বন্ধে বর্তমান চর্চার পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেছি।  

বাংলানিউজ: এ সম্বন্ধে সংক্ষেপে শুনতে চাই।
ইস্রাফিল শাহীন: আমি যেটাকে বলছি, ‘ভ্রমণ নাট্য’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদেরকে বান্দরবান, পঞ্চগড়সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে গিয়েছি। তারা টাঙ্গাইলের দেহব্যবসাহীদের সঙ্গে, বিভিন্ন অঞ্চলের জেলে, কুমার, মেডিকেলসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছে। যেকোনো কমিনিউটিতে এরকম কাজ হতে পারে। মূলত নৃবিজ্ঞানমূলক শিক্ষায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমে নাট্যচর্চায় অংশ নেওয়ার চেষ্টা। শ্রেণীকক্ষের বিপরীতে সমগ্র অঞ্চল রূপান্তরিত হয়েছে শ্রেণীকক্ষে। আমাদের যাত্রা বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে। একসঙ্গে খাওয়া, ঘুমানো ও তাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গণমানুষের জীবনকে পাঠ করতে শিখছে। উপলব্ধি করা শিখছে মানুষ ও মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে। শুধ চার দেয়ালের মধ্যে নাট্যচর্চাকে সীমাবদ্ধ রেখে নাট্যচর্চা এগুতে পারে না।  

বাংলানিউজ: এই ‘ভ্রমণ’র মাধ্যমে কীভাবে নাট্যচর্চা হচ্ছে? একটু ব্যাখ্যা করবেন কী?
ইস্রাফিল শাহীন: ছেলেমেয়েরা যখন ভ্রমণের মাধ্যমে পরিচিত হচ্ছে কোনো একটি অঞ্চলের সঙ্গে, ওই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে, তাদের আচার-আচরণের সঙ্গে- তখন এই ছেলেমেয়েদের মধ্যে মনোদৈহিকভাবে বিস্তর প্রভাব পড়ছে। ধরেন, কৃষকের বাড়িতে আমরা উঠেছি, সেখানে আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের দৈনন্দিন কাজে অংশ নিচ্ছে। ধান লাগাচ্ছে, রান্না করছে, ঘর গোছাচ্ছে ইত্যাদি। তখন এই শিক্ষার্থীরা প্রথমে আনন্দ লাভ করছে। ঢাকা শহরে গ্রাম থেকে আসা একজন শিক্ষার্থী এক মাস কিংবা এক বছর পরে যান্ত্রিক হয়ে যায়। এই ‘ভ্রমণ’র মাধ্যমে সে ওই প্রকৃতি ও মানুষের জীবন সম্বন্ধে উপলব্ধি করছে, বিক্রিয়া হচ্ছে তাদের মানসিকতায়। স্বরণ করছে তার মূলকে। ভুলে যাচ্ছে না যে, সে এই বাস্তবতারই অংশ। অন্যদিকে, যখন ওই কৃষক কিংবা তার স্ত্রীর পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থী অবলীলায় কাজ করছে তখন তাদের ভেতরেও প্রভাব পড়ছে নিশ্চয়ই। এটাও তো থিয়েটার। এছাড়াও গল্পবলা তো রয়েছেই। আমি কিন্তু গল্প খুঁজতে বলি না, বলি মিশতে। হাসতে, কথা বলতে, নাচতে। নানারকম আড্ডার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ঘটচ্ছে এটা তো অভিনয় চর্চায় বিশেষ কার্যকর।  

বাংলানিউজ: আপনি কী পরিবেশনা, না কী অভিনেতার প্রস্তুতি নিয়ে বেশি আগ্রহী?
ইস্রাফিল শাহীন: প্রস্তুতি নিয়েই বেশি কাজ করতে আগ্রহী। আমি একজন জাত অভিনেতা তৈরি করতে চাই। যার ভাষা হবে সমৃদ্ধ, আচরণ হবে উৎকৃষ্ট। ভালো বক্তা হবে সে। অভিনেতার দৈনন্দিন জীবন হবে অন্যের জন্য ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব স্বরূপ।  

বাংলানিউজ: অভিনেতার ভালো বক্তা হওয়ার প্রয়োজনীয়তা কী?
ইস্রাফিল শাহীন: একজন অভিনেতার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতেই হবে। নানা ধরনের পাঠের মাধ্যমে এ গুণ অর্জিত হবে। বই বা সিনেমা যেমন দেখবে তার পাশাপাশি থাকতে হবে ‘ভ্রমণ’র বিস্তর অভিজ্ঞতা। অভিনেতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, তার অভিনয় নিয়ে দর্শকের কাছে অর্থপূর্ণ উপস্থাপন। স্থান-কালভেদে এ উপস্থাপন পৃথক হয়। অভিনেতার শব্দ ও অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য তিনি হবেন সিদ্ধহস্ত।

বাংলানিউজ: বর্তমানে আপনি কী ধরনের নাট্যচর্চায় আগ্রহী?
ইস্রাফিল শাহীন: ‘তাৎক্ষণিক নাট্য’। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তা সামনে রেখে তাৎক্ষণিকভাবে অভিজ্ঞ অভিনেতাদের নিয়ে আপোষহীন, ব্যঙ্গাত্মক নাটক। যা এ সমাজের পোস্টমর্টেম করে সত্য খুঁজে বের করবে। ধরেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা মেডিকেলে গেলো। আমি বলবো, শুধু গল্পের তালাশ করো না। ওই মানুষগুলোকে দেখো। তাদের প্রয়োজনে এগিয়ে যাও। এ অসময়ে সাহায্য করো, কিছু ঘটবে তো। সেটাও তো থিয়েটার। আবার খুঁজে বের করো, যদি কোনো অনিয়ম থাকে। এবং সঙ্গে সঙ্গে তা উপস্থাপিত হোক। কোনো পাণ্ডুলিপির চরিত্রায়নের দরকার, তেমনি আগে মানুষের চরিত্রায়ন প্রয়োজন। থিয়েটারের সংজ্ঞা কি সারাজীবন এক ছিলো? কিংবা এক রাখারই বা কী দরকার? 

বাংলানিউজ: আপনার এ নাট্যচর্চার সাফল্য কামনা করছি। আশা রাখছি, ভবিষ্যতে আপনার এই চিন্তা বিশ্বব্যাপী বিশেষ সম্মানে স্বীকৃত হবে।
ইস্রাফিল শাহীন: আমি যে পদ্ধতিতে কাজ করতে চাই, সেটাই যে শেষ কথা, তা নয় আবার এটাই যে আদর্শ, তাও নয়। এ জাতীয় চর্চা আগেও হয়েছে, হয়তো দর্শনগত পার্থক্য রয়েছে।

বাংলানিউজ: বাংলানিউজকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ইস্রাফিল শাহীন: থিয়েটার হোক সবক্ষেত্রে, সবসময়...। ধন্যবাদ বাংলানিউজকেও।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫২ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০১৬
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।