ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভ্রমণামৃত-৯

শনিবার বাজার: নান্দনিকতার ঝলক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩৯ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
শনিবার বাজার: নান্দনিকতার ঝলক ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নির্নিমেষ ভাবালুতার মধ্যে নিজেকে সঁপে দিয়ে তিনি বসে আছেন নিশ্চুপ। সামনে পরিশ্রমের ঘাম আর কুশলী হাতের তৈরি পণ্যসম্ভার।

চারদিকে চলছে নিরন্তর কোলাহল। অদূরের মঞ্চে শিল্পীদের টানা লাইভ মিউজিক আর আনন্দে ভাসতে আসা মানুষের প্রাণোচ্ছল নৃত্য। তাকে স্পর্শ করছে না কিছুই।

এই কোলাহলের মধ্যে নিবেদিত দার্শনিকের মতো ভেবে চলেছেন হয়তো মহাকালের কোনো ভাবনা। ক্যামেরা তাক করে ছবি তোলার অনুমোদন চাইতেই সম্বিত ফিরলো তার, মুচকি হাসিতে চমকিত করে বললেন, ‘ইয়ে, শিওর’।
সত্তুর পেরোনো পরিপক্ক মানুষ তিনি। মাথার মাঝ বরাবর টাক। দু‘পাশ ও পেছনের দিকে কাশফুল সাদা চুল। চোখের আইব্রো’ও পক্ক। ক্লিন সেভড। চোখে চশমা। বাংলাদেশে তৈরি ছাইরঙের সাধারণ টিশার্টের ওপর চাপিয়েছেন খয়েরি ছাপার বুকখোলা ওভারকোর্ট। মুচকি হাসিতে সারামুখ ভরে তুলেছেন।

তিনি উইলামেট ভ্যালির একজন কারুশিল্পী। আদি জনগোষ্ঠীর বংশধর। বংশপরম্পরায় ধরে রেখেছেন প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত পণ্য দিয়ে হাতেগড়া কারু গহনার পসরা। ইউজিন শহরের শনিবারের সাপ্তাহিক বাজারে তিনি বসেছেন পণ্যের পসরা নিয়ে।

ইউজিনের এই ‘স্যাটারডে মার্কেট’ আমার শনিবারের ভ্রমণ দিনলিপিকে সমৃদ্ধ করলো বড়। পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের প্রকৃত রসগন্ধ বহন করে মূল জনগোষ্ঠী। উইলামেট ভ্যালীর সভ্যতা ইউজিন অরেগনের যে আদি মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলেছে, তাদের বংশ পরম্পরার পরিচয়বাহী চারুকারুশিল্প কৃষির সাপ্তাহিক  বাজার ‘স্যাটার্ডে মার্কেট’ নামে খ্যাত। আমাদের ভাষায় বলতে পারি, শনিবার বাজার।

চারুকারুশিল্পী ও সনাতন কৃষিজীবী আর ক্রেতাদের পদভারে মুখরিত এ মেলা নবাগতদের সামনে মেলে ধরছে প্রকৃতিলগ্ন ঐতিহ্যময় অতীত। আধুনিকতার প্রাণহীন কোলাহল ও শিল্পবিপ্লবের ডামাডোলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আদিদের জীবন বৈভবের নান্দনিকতা যে কালোত্তীর্ণ হয়ে টিকে আছে, শনিবার বাজারের পরতে পরতে তা উপলব্ধি করা যায়। আমার মনে হলো, এই শনিবার বাজার যেন এখানকার জনগোষ্ঠীর নান্দনিক জীবনের এক ঐতিহাসিক ঝলক।

বেলা বারোটার দিকে উপস্থিত হলাম ‘স্যাটার্ডে মার্কেটে। আজ বৃষ্টি নেই, সোনালি রোদ্দুরময় আবহাওয়ায় মানুষজন ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। দূর থেকেই কানে ভেসে আসে উপচেপড়া ভিড়ের মানবিক কোলাহল। ইউজিন শহরের হ্যাপেনিং এরিয়া ব্রডওয়ে’র অদূরে পার্কের উন্মুক্ত চত্ত্বরে এ শিল্প কোলাহল। উন্মুক্ত চত্ত্বরে অস্থায়ী তাবুর নিচে স্টলের পর স্টল সাজিয়ে বসানো হয়েছে এ বাজার। বাজারের ঐতিহ্যও বহুকাল পেরিয়েছে।

উইলামেট ভ্যালির মানবসভ্যতা কাঠ, চামড়া, পাহাড়ি পাথর-নুড়ি, সমুদ্রতলের নানা সম্পদের মতো প্রকৃতি থেকে জীবনের উপাদান সংগ্রহ করে যে তাদের জীবনযাপনের স্টাইল তৈরি করেছিল, মেলার কারুপণ্য দেখে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। স্টলগুলোর সামনে ঘুরে ঘুরে আমরা অনুপুঙ্ক্ষভাবে পণ্য দেখতে লাগলাম। দলের মেয়েরা আকৃষ্ট হলো মেয়েদের ব্যবহার্য গয়না, গৃহস্থালি আসবাব আর কারুপণ্যের দিকে।

আমি খুঁজছিলাম ভিন্ন কিছু। সামনে এগোতেই ‘অরেগন অথর’ নামের এক স্টল পেলাম। স্টলে দাঁড়ানো সত্তুরোর্ধ টুপিপরা শান্তপ্রকৃতির মানুষ। শ্রুশ্মমন্ডিত। চোখে চশমা আঁটা। গায়ে ফুলহাতা চেক শার্ট। আলাপে জানলাম, তিনিই বইগুলোর লেখক। নাম তার জো ব্লাকলে। জো নিজের লেখা ও প্রকাশ করা বই নিয়ে সাজিয়েছেন স্টল। সঙ্গে তার মধ্যবয়স্কা সুশ্রী স্ত্রী। তিনটি ঐতিহাসিক উপন্যাস ছাড়াও স্থানীয় বিষয়ের ওপর অন্তত দশটি বইয়ের রচয়িতা জো। উল্লেখযোগ্য লেখা ‘কিডন্যাপড’, ‘হেয়ারলুম’, ‘ক্রাইসিস ইন গ্রিনভিল’। মেলায় একজন লেখককে পেয়ে আমার আগ্রহ তার ওপর নিবিষ্ট হলো।

আলাপে জানলাম, তিনি স্থানীয় লেখক। জাতীয় বা আঞ্চলিক লেখকদের ভিড়ে কিংবা অনলাইনের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণায় যাওয়ার আগ্রহ তার নেই। ইউজিনে বসবাস করেন। নিজে অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্থাপনার ওপর লেখালেখিই জীবনে আরাধ্য করেছেন। তিনি একান্ত স্থানীয় এবং স্থানীয়ত্বই তার লেখালেখির মূল মাধুর্য। ভাবলাম, ঐতিহ্যময় কারুশিল্পীরা যেমন বড় শিল্পের ডামাডোলে নিজেদের হারিয়ে ফেলতে নারাজ, তেমনি এই ‘অরেগন অথর’। ব্যাপক ক্যানভাসে গিয়ে নিজস্ব স্থানীয় ক্ষুদ্রতাকে তিনি হারাতে চান না।

কৃষিপণ্য অঙ্গনে মেলায় রাসায়ণিক সার ও হাইব্রিড পদ্ধতি ছাড়া উৎপাদিত ফলমূল, শাকসব্জি মধু, ডিম, মুরগী, মধুর বিশাল সমাহার। স্থানীয় কৃষকরা ভাল দাম পেতে মেলায় হাজির করেছেন এসব। আমরা মধু, চেরি ও স্ট্রবেরির স্বাদ নিয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম।

পাশের মুক্তমঞ্চে চলছে স্থানীয় শিল্পীদের লাইভ মিউজিক। শিল্পীদের একজনের পর একজন গেয়ে চলেছেন মনমাতানো গান। মুক্ত বায়ুসেবনকারী নারীপুরুষ কিংবা গৃহত্যাগী যুবক-যুবতীরা গানের তালে তালে উন্মাতাল নৃত্যে মেতেছে। পাশের ফুডকোর্টে চলছে আন্তর্জাতিক সব খানাপিনা। ব্যাংকক গ্রিল ও আফগান কুইজিন নামের এশীয় খাবারের দোকানে আমেরিকানদের ভিড় দেখে মনে হলো, দেশের ফুসকা চটপটির স্টল বসালে ভিন্ন স্বাদপ্রত্যাশী আমেরিকানদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে।

পুরো মেলায় অভ্যাগত ক্রেতাদর্শক আবালবৃদ্ধবণিতা নানা বয়স, পেশার হলেও স্টলমালিক চারুকারুশিল্পীরা বয়সী এবং বিশেষ চেহারার এবং ব্যতিক্রমী বেশধারী। আমার চোখ সারাক্ষণ তাদের দিকে নিবদ্ধ। তাদের কুশলীহাতের চমৎকার সব শিল্পের পাশাপাশি আমি অনুপুঙ্ক্ষভাবে পরখ করলাম এদের শান্ত, সৌম্য, মুখাবয়ব এবং ব্যতিক্রমী বেশভূষা। যে বিরল ব্যতিক্রম সচরাচর নাগরিক কোলাহলে মেলে না।

বাংলাদেশ সময়: ২৩৩০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
এইচএ/

**হংসবৃত্তান্ত ও ইউনিভার্সিটি অব অরেগন
**গড়াই থেকে উইলামেট। । নদী নির্জন বুনো পথ পরিভ্রমণ
**ইউজিন শহর। । দরজায় অচেনা আগন্তুক
**আলোকচিত্রের জন্য মার্কিন মুলুকে
**আমেরিকায় বয়ে নেওয়া বাক্সভরা আবেগ
** চিকেন চাইতেই এলো সিগারেট!
** সাড়ে তিন ঘণ্টার উড়াল ও ম্যাদোনা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।