ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-৪)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১৬
ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-৪)

পূর্ব প্রকাশের পর
তীরের কাছটায় এ হ্রদের পানি যেন স্ফটিক স্বচ্ছ। তলদেশের পাথরের মাঝে দানা খুঁটে খাওয়া মাছের ঝাঁককে তাই খুব সহজেই চিনে নেওয়া যায়।

ইচ্ছে হয় হাত বাড়িয়ে বড়শি ছাড়াই অগভীর সেই জল থেকে মুঠোর মাঝে কোনো একটি মাছকে টেনে তুলি।

তীরের সেই কাছটায় তখন চলছে তুমুল হুল্লোড়। কেউ কেউ পা ডুবিয়ে ভুঁড়ি চেগিয়ে বসে অদূরে রেডিওতে বাজতে থাকা গানের সঙ্গে দুলছে, আবার কেউবা পানি থেকে সদ্য সাঁতার কেটে উঠে অন্তর্বাসের উপর শুকনো তোয়ালে চাপাচ্ছে। আমি শ্যাওলা ভেজা দু’টি পাথরের উপর সন্তর্পণে পা ফেলে তার ডান ধারের এক পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে ওঠা শুরু করি, আমার গন্তব্য ওই পাহাড়ের চূড়োর একটি গির্জা। পাহাড় বাইতে তেমন একটা কসরত করতে হয় না আমাকে, ঢালের মাঝে পুঁতে রাখা পাথরের সিঁড়ি আমার কায়িক শ্রমকে কিছুটা লাঘব করে দেয়।

সেই চূড়োতে এক ছোট্ট বাগান, একধারে কয়েকটি সাইপ্রেস গাছ আর সবাইকে ছাপিয়ে আর্মেনীয় স্থাপত্যের এক ছোট্ট গির্জা। দূর থেকে বেশ খানিকটা বৃহৎ মনে হলেও যৎসামান্য দক্ষিণার বিনিময়ে ভেতরে গিয়ে বুঝতে পারি আদতে এটি আমার এ জীবনে দেখা সবচেয়ে ক্ষুদ্র গির্জা।

তবে ক্ষুদ্র হলেও গির্জার দেয়ালে প্রায় বিলীন যে চিত্রকর্মগুলো দেখা যায় সে থেকে বোঝা যায় শৈল্পিক মূল্যের দিক থেকে এ গির্জার অবস্থান মোটেও হেলাফেলা করবার মতো নয়। আর তা হবেইবা না কেন? এ গির্জা তো আর এ কালের নয়, এটি তৈরি হয়েছিলো সেই চৌদ্দ শতকে, অটোমানরা এ অঞ্চলে পা রাখারও আগে। আমি গির্জার একমাত্র ও এক চিলতে প্রার্থনা ঘরটিতে পেতে রাখা দু মানুষের এক বেঞ্চে বসে দেয়ালের বিবর্ণ ফ্রেস্কোগুলোর দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকি। এক পর্যায়ে চৌকাঠ মাড়িয়ে দরজার সংকীর্ণ পাল্লাকে ঠেলে হুড়মুড়িয়ে এসে ঢোকে এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া, বেদির কাছটায় ফ্রেস্কোর নিচে জ্বালিয়ে রাখা মোমবাতিগুলোর কয়েকটি সেই হঠাৎ হাওয়ায় নিভে যায়। অন্ধকার এক কোণে চুপ করে ঝিম মেরে থাকা গির্জার তরুণ যাজক সেই দৃশ্য দেখে উঠে এসে তৎক্ষণাৎ দেশলাই জ্বেলে মোমবাতিগুলো আবার প্রজ্বলিত করে, মাথার উপরে ঝুলতে থাকা সিলভারের ঝাড় লণ্ঠনের সঙ্গে এই মোমের আলো সৃষ্টি করে এক কমলাভ আলো-ছায়ার কন্ট্রাস্ট।  

গির্জাটিকে ভূমি থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে মেলে রেখেছে বক্রাকারে ছড়িয়ে থাকা পাথরের সিঁড়ির বেশ কয়েকটি ধাপ। আমি সে ধাপগুলো বেয়ে নেমে এসে সাইপ্রেস আর রকেটের মতো ধাই করে ঊর্ধ্বপানে বেড়ে ওঠা কয়েকটি ঝাউ গাছের প্রান্তে এক নববিবাহিত দম্পতিকে চুম্বনরত অবস্থায় আবিষ্কার করি, তবে কি এনাদের মাত্রই বিবাহ সম্পন্ন হলো? কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে তিনশ ষাট ডিগ্রি অব্দি স্ক্যান করেও আমি ত্রিসীমানায় কোনো যাজকের দেখা পাইনি।

তার বদলে দেখতে পাই বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়ানো কয়েক ক্যামেরা-ম্যানকে, কাঁধে বিশাল বাঁশের মতো লেন্সওয়ালা কিছু ক্যামেরা ঝুলিয়ে তারা সেই চুম্বনের মুহূর্তটিকে ধরবার জন্যে ব্যতিব্যস্ত তখন। আমি সেসব ক্যামেরার লেন্স আর তাদের লক্ষ্যবস্তুর মাঝে কোনোরূপ বাধা সৃষ্টি না করবার জন্যে কিছুক্ষণ সেই সিঁড়ির প্রান্তেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি।

সেসব পালা সাঙ্গ হলে হেড ক্যামেরাম্যান আমাকে ডান হাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে লাইন ক্লিয়ারের সংকেত দেয়। আমি এসে বসি সে প্রাঙ্গণের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রশস্ত দেয়ালের মাথায়। সেখানটায় খানিক ছায়া, বহু নিচে দেখা যায় অখ্রিদের অপার নীল জল, বহু দূরে দুলে দুলে চলে ছইওয়ালা কয়েক নৌকো। আমি সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আয়েশ করে পা দুলিয়ে বসে বিশ্রামের উছিলায় সেই নব দম্পতিকে পর্যবেক্ষণ করি।  

চলবে....

** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-১)
** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-২)
** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-৩)

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।