মাঝির মন্থরগতির এ বোটে করে অখ্রিদের সলীলাবর্তে বেশ কিছুটা সময় কাটাবার পর আমি ফিরে আসি তীরের কাছে এক বাঁধানো ঘাটে। সেখানে তখন মানুষের ঢল, যেন পুরো শহরের লোকসমাগম এই স্থানেই।
কখনও আবার ঘরে বোনা উলের সোয়েটার গায়ে জড়ানো এক ফেরিওয়ালা কয়লার উনুনে ভুট্টা পোড়াতে দিয়ে হাতের সস্তা বিড়িতে সুখটান লাগায়। রংবেরঙের আলো জ্বলা খেলনার পেছনে ছুটে চলা এক শিশু আচমকা তার পথে আমাকে দেখতে পেয়ে লাজুক হাসি হাসে। অদূরেই আরেক যুগল প্রগাঢ় আলিঙ্গনে একে অপরকে আবদ্ধ করে চুম্বনে বিদ্ধ হয়। শেষ সন্ধ্যার সিঁদুররঙা মেঘের প্রতিফলন বুকে ধারণ করা হ্রদের জলে দুলতে থাকা জেলে নৌকাগুলো আর আশপাশের নানা মানুষের নানা চিত্রকে পেছনে ফেলে আমি এগিয়ে যাই এই তীরের খুব কাছের এক বাজারে।
গমগমে সে বাজারে তখন ঠ্যালা গাড়িতে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছে মালার কারিগরেরা। অখ্রিদ হ্রদ থেকে তুলে আনা সাদা মুক্তোর মালা তো আছেই, আরও আছে নানা বর্ণের কোরালের নানা আকারের মালা। আর এমন এক বাজারে নারীকুল হুমড়ি খেয়ে পড়বে না, তাই কি হয়? হয় না।
ভ্রাম্যমাণ গাড়িগুলোর হ্যাজাকের বাতি ঢেকে যায় গোল হয়ে ঘিরে ধরা টসটসে মুখগুলোর জটলার জালে। আর স্লাভিক ভাষায় দরাদরির নানা শব্দ ছিটকে আসে সেখান থেকে। এর মাঝেই একসময় মনে পড়ে সেই রাত নটায় টিকিটের খোঁজ নেওয়ার কথা। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই নটা বাজতে আর তেমন দেরি নেই।
ত্রস্ত পায়ে আমার পান্থশালার কাছের সেই টিকিট বিক্রির টংঘরে পৌঁছে দেখতে পাই, যার মায়ায় এখানে এসেছিলেম সেই মায়াবতীর বদলে টুল জুড়ে আসীন এক মধ্য বয়স্কা নারী। ঘাড় চুলকে তাকে পরদিনের টিকিটের কথা জানাতে সে কিছুটা বিষণ্ণ মুখে জানায় আগামীকালের জন্যে তারা পর্যাপ্ত টিকিট বিক্রি করতে পারেনি। তাই একজন যাত্রী নিয়ে নোঙর তুললে তাদের ঠিক পোষাবে না। তবে আমার অবস্থা বিবেচনা করে এক বুদ্ধি বাতলে দেয় সে আমাকে।
নাকি জাহাজঘাটা থেকে সক্কাল সক্কাল এক বিশাল জাহাজ রওয়ানা দেয় সেই কাঙ্ক্ষিত দ্বীপ সেন্ট নাউমের পানে, আমি চাইলে সেই জাহাজে করেও ঘুরে আসতে পারি। কথাবার্তার মাঝেই আমি ইতি উতি করে সেই মেয়েটিকে খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু দোকানের আশপাশে তাকে দেখতে পাই না। ভদ্রমহিলাকে “ব্লাগোদারাম” অর্থাৎ কিনা ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে আসার সময় তাকে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেই ফেলি, ‘দুপুরের সেই মেয়েটি কোথায়?’ ভদ্রমহিলা মুখ টিপে হেসে বলেন, ‘বেচারার দিদিমা আজ একটু অসুস্থ, তাই ওকে কিছুটা আগেভাগেই আমার কাছে দোকান ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। ’
ভদ্রমহিলার কথা মিথ্যে ছিলো না, সকালে উঠে ঘাটে গিয়েই আমি সারেং সাহেবের উদাত্ত ডাকাডাকি শুনতে পাই। শ্বেতরঙা সেই বিশাল জাহাজের নিচের তলে একটা আরাম মতো জায়গা বেছে নিয়ে অনতিদূরে আয়েশি ভঙ্গিতে ভেসে চলা এক রাজহাঁসের উপর ক্যামেরার ফোকাস স্থির করি। পরিস্কার দেখতে পাই গ্রীবা উঁচু করে ভেসে বেড়ানো হাঁসটির জলের উপরকার অংশ স্থির হলেও নিচে অনবরত দাপড়ে যাচ্ছে হলদে পা দুটো। আমাদের জাহাজের সারেং সাহেব নোঙর তুলে ভট ভট শব্দে জাহাজ চালিয়ে দিলে এক জার্মান যুগল ছইয়ের বাইরে গিয়ে বস্ত্র পরিহার করে সূর্যালোক গায়ে মাখবার প্রয়াসে এমন এক এঙ্গেলে পশ্চাৎদেশ পেছনমুখী করে শুয়ে পড়ে যে বাধ্য হয়েই সেদিক থেকে কিছুটা দৃষ্টিসংবরণ করে আমাকে অন্য দিকে তাকাতে হয়।
চলবে....
আরও পড়ুন..
** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-৫)
**ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-৪)
** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-৩)
** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-২)
** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-১)
বাংলাদেশ সময়: ০৭২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৬
এএ