মধ্য আশি দশকে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আমার সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হয়। সংযোগ সূত্রটি ছিল বিশ্ববিশ্রুত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।
ম্যান্ডেলার কারাবাস শুরু হয় কুখ্যাত রবেন দ্বীপের কারাগারে। এখানে তিনি তার ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান। জেলে থাকার সময়ে বিশ্বজুড়ে তার খ্যাতি বাড়তে থাকে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন। সশ্রম কারাদণ্ডের অংশ হিসেবে রবেন দ্বীপের কারাগারে ম্যান্ডেলা ও তার সহবন্দীরা একটি চুনাপাথরের খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হন। কারাগারের অবস্থা ছিলো অতি শোচনীয়। কারাগারেও বর্ণভেদ প্রথা চালু ছিলো। কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের সবচেয়ে কম খাবার দেয়া হতো। সাধারণ অপরাধীদের থেকে রাজনৈতিক বন্দীদের আলাদা রাখা হতো। রাজনৈতিক বন্দীরা সাধারণ অপরাধীদের চাইতেও কম সুযোগ সুবিধা পেতো। ম্যান্ডেলা তার জীবনীতে লিখেছেন, তাকে ডি-গ্রুপের বন্দী হিসেবে গণ্য করা হতো, অর্থাৎ সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন্দীদের তালিকায় তাকে রাখা হয়েছিলো। ১৯৮৮ সালে ম্যান্ডেলাকে ভিক্টর ভার্সটার কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত ম্যান্ডেলা এখানেই বন্দী ছিলেন। আস্তে আস্তে তার ওপরে কড়াকড়ি কমানো হয় এবং দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়।
ম্যান্ডেলার কারাবন্দীত্বের সময়ে তার মুক্তির জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের ওপরে চাপ বাড়তে থাকে। ম্যান্ডেলার মুক্তির জন্য এই আন্দোলনের বহুল ব্যবহৃত শ্লোগানটি ছিলো, Free Nelson Mandela! ম্যান্ডেলার মুক্তি চাই। ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট বোথা হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তার স্থলাভিষিক্ত হন ফ্রেডেরিক উইলেম ডি ক্লার্ক। রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের পরেই ডি ক্লার্ক ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।
সে সময়ে আমরা ম্যান্ডেলার মুক্তিতে সোচ্চার হই বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে। জাকসু (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রছাত্রী সংসদ) ম্যান্ডেলার ছবিসহ একটি পোস্টার সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী জিল্লুর (তৃতীয় মাত্রার উপস্থাপক) আর আমি সেই পোস্টার ডিজাইন ও ছাপার কাজে যুক্ত হই। ধ্রুব এষকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিজাইনের। আমরা পোস্টারে সৈয়দ শামসুল হকের একটি পঙ্ক্তি লিপিবদ্ধ করতে আগ্রহী হই এবং বিষয়টি নিয়ে হক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি পুরো পরিকল্পনাটি শুনে আমাদের দু’দিন পর যেতে বললেন। যথারীতি আমরা দু’দিন পর যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের একটি অবিস্মরণীয় স্লোগান উপহার দিলেন: ‘একবার তুমি সাহসে হাতের লাঠি তুলে ধরলেই/ দেখবে আঁধার কাটবার আর বাকী নেই’। ম্যান্ডেলার ছবির নিচে স্লোগানটি দিয়ে আমরা পোস্টারটি ছেপে তার মুক্তির আন্দোলনকে বেগবান করেছিলাম।
তারপর নানা কারণে নানা প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তাকে নানাভাবে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষার সুযোগও পেয়েছি। আজকে সেসব স্মৃতি মনে পড়ছে। স্মৃতিতে ছাপিয়ে মূল্যায়নের আলোয় যখন তাকে দেখে, মনে হয় তিনি এক স্পর্ধিত পুরুষ। কি কথায়, কি ব্যবহারে, কি প্রকাশে, সর্বক্ষেত্রেই সেটা সুস্পষ্ট। সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুর পর মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগের অঙ্গনে তাকে নিয়ে আবেগ ও উচ্ছ্বাসের যে প্লাবন দেখেছি, মূল্যায়ন ততটা দেখিনি। কে কবে সৈয়দ হকের পাশে বা পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল, সেটাই ফলাও করা হচ্ছে। মৃত কবি ও লেখককে আশ্রয় করে অর্বাচীন ও অজ্ঞাতকুলশীলদের জাতে ওঠার মচ্ছব আসলেই হতাশাজনক। আরেকটি বিষয়ও প্রসঙ্গত উল্লেখ করার মতো। তা হলো মন্তব্য প্রদানের মাত্রা ও পরিধির ক্ষেত্রে। আমাদের বিদ্যাজগতে ও মননে ‘সমালোচনা’ শব্দ ও প্রত্যয়টি যথোপযুক্ত অর্থ পাচ্ছে না। আদিগুরু এরিস্টটল যে সমালোচনা ও নন্দনতত্ত্বের কথা বলে গেছেন সেটাই অনেকে জানেন না। সমালোচনার আধুনিক প্রয়োগ তো দূর অস্ত। এখানে সমালোচনা যুক্তি বা লজিকের ধারও ধারে না। প্রশংসা করতে বসলে পূজা শুরু করে। নিন্দায় লিপ্ত হয়ে কতল করে ফেলে। ব্যক্তি বা বিষয়টির ভালো ও মন্দ মিলিয়ে যথার্থতা শনাক্ত করা আর হয় না। এ কারণেই একদল স্তাবক তাকে দেবতা বানাচ্ছে। আরেক দল নিন্দুক তাকে দানবে প্রতিপন্ন করছে। দোষ-গুণ মিলিয়ে আসল সৈয়দ শামসুল হককে আর পাওয়া যাচ্ছে না। আবেগ আর হিংসার বুদবুদে আচ্ছন্ন করা হচ্ছে তাকে।
কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক তার প্রজন্মের ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি ছিলেন পঞ্চাশের জাতক এবং এরাই বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রথম যুগ নির্মাতা এবং বহু বিতর্কের স্রষ্টা। আমার বক্তব্য ব্যাখ্যা করে না বলা হলে সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে না। এরা প্রথম প্রজন্ম এজন্য যে, চল্লিশের সকল কবি-সাহিত্যিক, যেমন, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, আহসান হাবিব, শওকত ওসমান প্রমুখ সকলেই ঢাকা এসেছিলেন কলকাতার স্মৃতি নিয়ে। কিছুটা কাল সেখানে কাটিয়ে। সাতচল্লিশে উপনিবেশ বিদায়ের পর ব্রিটিশ ও কলকাতার বাইরে ঢাকায় যে নতুন সাহিত্য গড়ে ওঠে, সেই স্বাধীন উদ্বোধনের সারথী পঞ্চাশের কবি-সাতিহ্যিকগণ, যেমনভাবে সত্তরের প্রজন্ম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতক আর আশির প্রজন্ম স্বৈরাচার বিরোধিতার জাতক ও নব্বই দশকের কর্মীরা বিশ্বায়নের স্পর্শমাখা। এই পরিবেশগত প্রভাব সকল প্রজন্মই ইতি ও নেতিবাচকভাবে পেয়েছে। পঞ্চাশেরর তরুণ প্রজন্ম সামনে খোলা মাঠ পাওয়ায় তাদের সকল কিছুই নতুন ও উল্লেখযোগ্য হয়েছে এবং এদের প্রায় সকলেই বাইশ থেকে সাতাশ বছরের মধ্যে বাংলা একাডেমির পুরস্কারটি হাসিল করেছেন। পরে আহমদ ছফা বা আবিদ আজাদ পঞ্চাশ-ষাট বছরের জীবন কাটিয়ে মৃতুমুখে পতিত হয়েও পুরস্কারটির দেখা পাননি। আর এখন এটি রাজনৈতিক বিষ্ঠায় পরিণত হয়েছে।
বিতর্কের দিক থেকেও পঞ্চাশ নেতৃত্ব স্থানীয়। আল মাহমুদের বিপ্লবীপনা মৌলবাদে কুর্ণিশ করেছে। শামসুর রাহমান স্বৈরাচারের ছায়া এড়াতে পারেন নি। আলাউদ্দিন আল আজাদ বা ফজল শাহাবুদ্দীন স্বৈরতন্ত্রের সহযোগী ছিলেন। তুলনায় সৈয়দ হকের বিতর্কিত লেখা খেলারাম খেলে যা, নিষিদ্ধ লোবান কিংবা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব উল্লেখযোগ্য। (তসলিমা নাসরিনের অভিযোগ, বিতর্ক ও মামলা এখানে উহ্য রাখা হলো)। কিন্তু এতসবের পরেও তার স্পর্ধিত উপস্থিতি সামনে এসে দাঁড়ায়। পোশাকে, আচরণে, বিশ্বাসে, বচনে এর প্রমাণ সুস্পষ্ট। তার দিকে তাকালে সে কথাই মনে হয়। জীবন-যাপনের সর্বক্ষেত্রে এবং লেখার প্রতিটি অক্ষরে তিনি সে ছাপ রেখেছেন। নিজের ধর্মনিরপেক্ষ, সেক্যুলার, লোকজ-মানবতাবাদ, প্রেম ও দ্রোহ, কবির আর্তি ও হাহাকার, জাতিসত্তার সংগ্রামশীলতা তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে মূর্ত করেছেন। নিজের আধুনিক জীবনবোধকেও তিনি আড়াল করেন নি। যা তার বিশ্বাসের অংশ সেটাকে চর্চা করেছেন। যা তার দর্শনের অংশ সেটাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। যা তার রাজনৈতিক বোধ সেটাকে লালন করেছেন। এক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক, আড়াল, অবগুণ্ঠনে তিনি মোটেও আস্থাশীল ছিলেন না; ছিলেন সাহসের প্রতীক। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতির যে পাঠে তিনি মগ্ন ছিলেন, সেটার সাংস্কৃতিক রূপান্তর সাধনে এবং নন্দনতাত্ত্বিক বহিঃপ্রকাশে সৈয়দ শামসুল হক ভ্যানগার্ডের মতো অগ্রগামী।
সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান হয়েছে। সাহসের সঙ্গে নিজেকে এবং নিজের কর্ম ও কীর্তিকে প্রকাশ করার স্পর্ধিত ধারায় ছেদ পড়েছে। নিজের বিশ্বাসকে প্রচার ও প্রকাশে যে সাহস লাগে, বির্তক বা সকলের চেয়ে আলাদা হতেও যে যোগ্যতা ও হিম্মত লাগে, সেটা তিনি বার বার প্রমাণ করেছেন। তার প্রজন্মের সহযাত্রীদের চেয়ে বেশিই করেছেন এবং সেসব তিনি করেছেন যৌক্তিকভাবে। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায়; অপরূপ মাধুর্য ও ব্যঞ্জনায়। তিনি রাজনীতিকে যেমন নাড়িয়েছেন নিজের বিশ্বাসময়তার দর্শনে; মানুষের হৃদয়কেও স্পর্শ করেছেন অপূর্ব মায়াময়তায়। তার স্থান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের হৃদয়ের গহীন গভীরে। যেমনটি তিনি মনে করতেন এবং বলেছেনও লোকজ ভাষার মোহময়তায়: ‘চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও/ বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান/ নিজেই তাজ্জব তুমি- একদিকে যাইবার চাও/ অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান/ এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/ যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর। ’
সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক আলোচনা-সমালোচনার তীব্র স্রোতের মধ্যেও আমাদের পরানের গহীন ভিতরে দোলা দেবেন; রুমাল নাড়িয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবেন; কালে-কালান্তরে; প্রজন্ম ও পরম্পরায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৬
এমজেএফ/