একজন লেখককে তার অভিজ্ঞতা সঞ্জাত চেতনা ও বিশ্বাসের কাছে সর্বদা সৎ থাকতে হয়। পূরবী বসু তার নারী জীবনের অভিজ্ঞতাকে নানা কৌশলে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
পূরবী বসু বাড়ির অন্ধকার ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে একজন মধ্যবিত্ত সংগ্রামী নারীর চোখে যে নীল আকাশটি ধরা পড়ে তা আমাদের দেখাতে চান। এটি একজন নারীর প্রতি নারীর পক্ষপাত নয়- এ একজন মানুষের মানবীয় অবস্থান। এখানেই পূরবী বসুর নিজস্বতা।
‘যখন সরোবরে ফুল ফোটে না’ পূরবী বসুর দ্বিতীয় উপন্যাস। পুরো উপন্যাসটি জুড়ে রয়েছে মধ্যবিত্ত নারী জীবনের উত্থান-পতনের গল্প। একজন নারী একেবারেই বিচ্ছিন্ন তার পরিবার থেকে, সমাজ থেকে। তাকে একাই নানা দুঃখ, বঞ্চনার সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। এই হচ্ছে মধ্যবিত্ত নারীজীবনের পরিণতি। তার আপন বলে কি কিছু রয়েছে? এমনই এক প্রশ্নের আমরা সম্মুখীন হই উপন্যাসের শুরুতে। আরতির জীবনের গল্প দিয়ে উপন্যাসের সূচনা। আরতি ও তার বড়-সড় একটি পুকুর। এ দু’য়ের সম্পর্ক কাহিনীর শুরুতে একটি রহস্যজাল সৃষ্টি করে। সেই রহস্যময় পুকুরটিকে লেখক ‘স্ত্রীধন’ হিসেবে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এটির মালিকানা তিন প্রজন্ম ধরে হাত বদল হয়ে আসছে- ‘তিন প্রজন্ম ধরে আরতির পরিবারে স্ত্রীধন হিসেবে মালিকানার হাতবদল হয়ে আসছে যে জিনিসটির, তা টাকাপয়সা নয়। বিষয়সম্পত্তি, বাড়িঘর, দালানকোঠা নয়। সোনাদানা, মোহর, মণিমুক্তা, হীরা-চুন্নি-পান্নাজাতীয় কিছু দামি ধাতু বা পাথর নয়। এমনকি দুর্লভ অ্যান্টিক আসবাবপত্র, বাসনকোসন বা মূল্যবান চিত্রকলা পর্যন্ত নয়। এটি শহরের একপাশের এই বিরাট পুকুরটি। ’
উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন এসে দাঁড়াবে ‘স্ত্রীধন’ বলে আমাদের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে আদৌ কি কিছু রয়েছে? যেখানে নারী নিজেই নিজের মালিকানা পায় না। সে নিজেই সম্পদ ও আমানত হিসেবে স্থানান্তরিত হয় এক মালিক থেকে আরেক মালিকের হাতে।
এই পুকুরটি এই পরিবারের নারীদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে আশালতা, বিরজাসুন্দরী, মীরা, লিপি, তৃণাদের জীবনের নানা গল্প। যেখানে তারা বাঁচতে চেয়েছেন নিজেদের মতো। তাদের প্রেম, ব্যর্থতা, স্বপ্ন ভাঙা ও গড়ার গল্পগুলো পাঠককে ভাবায়। পাঠক এমন এক সমাজের সন্ধান পায় যে সমাজকে তারা দেখছে প্রতিদিন, কিন্তু কোথায় যেনো দেখার মধ্যে খামতি থেকে গেছে। তাদের দৃষ্টিতে উপেক্ষিত থেকেছে সমাজের একটি বড় অংশ- নারী। নারী চরিত্রগুলোকে উজ্জ্বল করতেই যেনো পুরুষ চরিত্র মন্মথ, ভাস্কর, মানস, সুধীর হলধরদের আগমন ঘটেছে উপন্যাসে। এটির আকৃতি ও কলেবরের কথা বিচার করলে একে উপন্যাস না বলে উপন্যাসিকা বলাই যুক্তিসঙ্গত হবে।
‘যখন সরোবরে ফুল ফোটে না’-এর ভাষা স্বচ্ছ, সাবলীল, ঝরঝরে। ঘটনার পরম্পরায় কাহিনী এগিয়ে চলে। সংলাপ খুবই কম। পাঠক উপন্যাসটি শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবে না।
আরতি-মন্মথের মা-বাবা হওয়ার স্বপ্ন সফল হয়েও মুকুলেই তা নষ্ট হয়ে যায়। ‘...আরতি ও মন্মথ দু’দুটি জীবিত সন্তানের জন্ম দিয়েও মা-বাবা হতে পারলেন না। বাচ্চা দু’টি চলে যাওয়ার পরেও বহুদিন আরতি ওদের মুখমণ্ডল, কান্না, ওদের শোয়ার ভঙ্গি ভুলতে পারতেন না। ’
আরতির ভাগনি মীরার জীবনেও একটি ঝড় আসতে দেখি। আরতি হঠাৎ জানতে পারে মীর সাড়ে সাত মাসের প্রেগনেন্ট। ‘আরতির হাত-পা ততোক্ষণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে শুরু করেছে। মীরা আসলেই কবে থেকে প্রেগনেন্ট, সন্তানটি কার, কেন সে এ ব্যাপারে একটি কথাও বলেনি তাকে, ডাক্তারের কাছে আসার মুহূর্তেও নয়, এসব কোনো কিছুই ঠিক ঠাহর করতে পারছেন না আরতি। ’ তারপর কী হলো মীরার? কেন মীরা এক পুরুষের ভ্রুণ শরীরে ধারণ করে পালিয়ে এসেছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে? আর আরতির দু’দুটো বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পরেও কেন মা হওয়া হলো না। আর ‘স্ত্রীধন’? সে সব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে পাঠককে উপন্যাসটি পড়তে হবে।
যখন সরোবরে ফুল ফোটে না, পূরবী বসু
অন্য প্রকাশ, ঢাকা, বইমেলা-২০১৬
বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৭
এসএনএস