লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রোমিও-জুলিয়েট, অ্যান্টনি-ক্লিওপেট্রার প্রেম কাহিনী জগৎ খ্যাত। বাংলা সাহিত্য ও সিনেমায় দেবদাসের চেয়ে জনপ্রিয় ও শক্তিশালী প্রেমাত্মক ট্র্যাজেডি নেই।
১৯২২ সালের প্রেক্ষাপটে ফিটজ্গেরাল্ডের উপন্যাস অবলম্বনে ২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ান পরিচালক বাজ লারম্যান নির্মাণ করেন ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’।
প্রেক্ষাপট ও নির্মাণের সময়ের পার্থক্য প্রায় শতবৎসর। তবু এ যেনো জাজ জেনারেশনের নিখুঁত চলচ্চিত্রায়ন। সিনেমার শুরুটা হয়েছে মানসিকভাবে অসুস্থ নিক ক্যারাওয়ে ও তার ডাক্তার ওয়াল্টার পার্কিনসের মধ্যে কথোপকথনের মাধ্যমে। পুরো সিনেমাজুড়ে ক্যারাওয়ে শুধু তার গভীর বেদনাময় স্মৃতির নির্মোহ স্বীকারোক্তি দিয়ে গেছে— কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও বসে, কখনও কলমে, কখনও মুখে। তার এই স্মৃতিচারণই ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে আনন্দ, বেদনায়, দ্বন্দ্বে, দগ্ধতায়, আশায়।
অধরা সবুজ আলোকেন্দ্রিক আশার বেসাতি বোনা প্রেমিক পুরুষ গ্যাটসবি। তার প্রতিবেশী হিসেবে ১৯২২ সালে ওয়েস্ট অ্যাগে বসবাস শুরু করে নিক ক্যারাওয়ে। ওয়ালস্ট্রিটের একজন সামান্য স্বপ্নাবিষ্ট যুবক যখন রহস্যময় বিজনেস ম্যাগনেট গ্যাটসবির সঙ্গে পরিচিত হয়, মুহূর্তে পাল্টে যায় তার নিউইয়র্কীয় জীবন। গ্যাটসবির বিশাল রাজকীয় প্রাসাদের ভিতরে-বাইরে মাঝে মধ্যেই চলে মেগা পার্টি। সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণপত্র পায় ক্যারাওয়ে। কিন্তু পার্টিতে উপস্থিত হয়ে সে বুঝতে পারে, শুধুমাত্র তাকেই আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়েছে, বাকিরা নিয়মিতই সেখানে আসে। গ্যাংস্টার, রকস্টার, ফিল্মস্টার, গেমার, আমুদে সবাই আসে গ্যাটসবির রাজকীয় প্রাসাদে। কিন্তু কেউ জানে না, কে এই গ্যাটসবি, ঠিক কী কারণে ভদ্রলোকটি এতো আয়োজন করে? মিডিয়ার লোকেরাও জানে না গ্যাটসবির অঢেল সম্পত্তির উৎস কী? সেই লোকারণ্য পার্টিতে ক্যারাওয়ে পতিত হয় এমন এক গোলকধাঁধায় যার সমাপ্তি ঘটে এক দুঃসহ বেদনার স্মৃতির মাধ্যমে।
ক্যারাওয়ের চাচাতো বোন ডেইজি সেই ধাঁধার কেন্দ্রবিন্দু, সেই পার্টির উদ্দেশ্য। কিন্তু ডেইজি বিবাহিতা, ডেইজি তখন টম বুকাননের সহধর্মিণী ডেইজি বুকানন। পরকীয়া অন্বেষী টমের সঙ্গে ডেইজির সম্পর্কেও টানাপোড়ন। এমন সময় উন্মোচিত হয় এক সত্য। ডেইজি আর গ্যাটসবির পূর্ব প্রেমের কথা গ্যাটসবি জানায় ক্যারাওয়েকে। পাঁচ বছর আগে যে দুঃসহ ঘটনা তার ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে গেছে, গ্যাটসবি কী পারবে তার সংশোধন করতে? অতীত কী সংশোধন করার যোগ্য? হোক না তা প্রবল প্রেমের করুণ বিচ্ছেদ, তবু যে চিরতরের জন্য অন্যের হয়ে গেছে, তাকে কী ফিরিয়ে আনা যায়? গ্যাটসবির সংগ্রাম এখানেই। গ্যাটসবি সেই অসাধ্য সাধন করতে চায়। সে জানে বুকানন ডকের সবুজ আলো সে একদিন ধরবেই।
ডেইজির সঙ্গে গ্যাটসবির রসায়ন জমে ওঠে ক্যারাওয়ের ছোট্ট ঘরে। মূলত এ রসায়নে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে অতি সাধারণ, বইপড়ুয়া এক যুবক ক্যারাওয়ে। সিনেমাটির প্রেমের দৃশ্যপটগুলো হৃদয়ের গভীরে ঢুকে আবেগকে নাড়া দেবে। একদিকে টম বুকানন ও মার্টল উইলসনের অবৈধ প্রেম, অন্যদিকে ডেইজি ও গ্যাটসবির পবিত্র উন্মাদ প্রেম। এই দুই প্রেমের মধ্যে সম্পর্ক কী? এই দুই প্রেমের পরিণতি কী? এই দুই প্রেমের পরিণতি টানতে গিয়ে এমন এক অকল্পনীয় পরিসমাপ্তি সিনেমাটিতে টানা হয়েছে যা হৃদয়ে দাগ কেটে যাবে। অথচ এই নিকৃষ্ট পরিসমাপ্তির নায়ক জর্জ উইলসন ভিলেন নয়, সে একজন নিরপেক্ষ চরিত্র।
শুধু কাহিনী নয় সিমন ডুগগানের অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফিতে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে দর্শকের। দ্য গ্রেট গ্যাটসবি অতি সচেতনভাবে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন বাজ লারম্যান। আবেগ ও প্রেমের উত্থান-পতন অতি দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। আর পুরো সিনেমাটিতে ক্রেগ আর্মস্ট্রংয়ের মিউজিকে নদীর ঢেউয়ের মতো ভেসেছে। সিনেমাটির মিউজিক দর্শকের অনুভূতির শিরায় শিরায় গমন করবে।
চলচ্চিত্রটির ট্র্যাজেডি দেবদাসের সমতুল্য, তাই গ্যাটসবিকে পাশ্চাত্যের দেবদাস উপাধি দিলেও ভুল হবে না। আমাদের দেবদাস প্রেমের জন্য মাতাল হয়েছে, ভবঘুরে হয়েছে, শেষে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। দেবদাসের কোনো আশাই ছিলো না। কিন্তু গ্যাটসবির আশা ছিলো। গ্যাটসবি তার আশা পূরণ করার জন্য বুকানন ডকের বিপরীতে বিশাল প্রাসাদ বানিয়েছে, বিশাল পার্টি থ্রো করেছে শুধু একটা আশায়, ডেইজি একদিন তার পার্টিতে আসবে। কাহিনীচিত্রের শেষ দৃশ্যে, প্রত্যাশার সকালে তার ফোনটা রিং রিং শব্দে বেজেও উঠেছিল। তবু সেই প্রত্যাশার সকালে এক লোমহর্ষক ট্র্যাজেডি রচিত হয়, যে ট্র্যাজেডি একমাত্র বাহক ক্যারাওয়ে।
সিনেমাটির অন্যতম প্রধান চরিত্র ক্যারাওয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন স্পাইডারম্যান খ্যাত টবি ম্যাগুইরি। এক কথায় টবি ম্যাগুইরির এটা সেরা অভিনয়। স্পাইডারম্যান সিরিজের অভিনয়কে ছাড়িয়ে দ্য গ্রেট গ্যাটসবিতে টবি তার অভিনয়কে শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়েছে। গ্যাটসবি চরিত্রে অভিনয় করেছেন সময়ের অন্যতম দক্ষ অভিনয়শিল্পী লিওনার্দো ডি-ক্যাপ্রিও। লিওনার্দো গ্যাটসবি চরিত্রটিকে অতি নিপূণভাবে তার অভিনয়ের মাধ্যমে রূপায়িত করার চেষ্টা করেছেন। লিওনার্দোর হাসি, দৃঢ় মুখচ্ছবি, চটপটে ভাব, উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ, কপালের ভাঁজ সবসময় বিখ্যাত। এখানে সব কিছুর সংমিশ্রণ রয়েছে। লিওনার্দোর সঙ্গে রোমান্টিকতার সম্পর্ক এই প্রথম নয়, টাইটানিক সিনেমায় তার রোমান্টিক উপস্থাপনা তরুণ-তরুণীদের মনে এখনও গেঁথে আছে। এখন কথা হলো রোমান্টিকতার উপস্থাপনায় লিওনার্দোর দ্য গ্রেট গ্যাটসবি কী টাইটানিককেও ছাড়িয়ে গেছে? দ্য গ্রেট গ্যাটসবিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ নেই, তবে এখানে ভ্যালি অব অ্যাশেইজ আছে, এখানে বাস্তবিকতা আছে।
ডেইজি চরিত্রে কেরি মুল্লিগান আবেদনময়ী, রোমান্টিক নারীর ভূমিকায় স্বার্থকভাবে অভিনয় করেছেন। সিনেমাতে সে এমন এক নারী, যে গ্যাটসবিকে নির্মোহভাবে ভালোবাসে। কিন্তু বিশেষ সিদ্ধান্তের মুহূর্তে যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, টম বুকাননকে সে ভালোবাসে কী না, তখন সে তা অস্বীকার করতে পারে না। নারী মন ও বাস্তবতার যে এক সুন্দর সংমিশ্রণ দ্য গ্রেট গ্যাটসবি সিনেমাটিতে ঘটেছে তা অতি নগণ্য চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত হয়েছে।
আর জোয়েল এডজার্টনের টম বুকানন চরিত্রটিকে অনেকে খল চরিত্র মনে করলেও, আসলে সিনেমাটিতে কোনো খল চরিত্রই নেই। টম বুকানন পরিস্থিতির স্বীকার এক রোমান্টিক পুরুষ। সে মার্টলকে ভালোবেসেছে, আবার তার স্ত্রী ডেইজির সঙ্গেও কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি। মার্টলকে হারিয়ে সে যে করুণ প্রতিশোধ নেয় তা অমলিন। এই প্রতিশোধের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর।
এছাড়া সিনেমাটিতে সেই সময়কার নিউইয়র্কের চিত্র দারুণভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। সেই সময়কার সমাজব্যবস্থা, যানবাহন, ব্যস্ততা সবকিছুই ক্যামেরা ও কাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
তবে সবকিছু ছাড়িয়ে প্রেমই চলচ্চিত্রটির মূখ্য বিষয়। প্রেমের জন্য যদি ওয়াল স্ট্রিট উলফশাইমার হতে হয় তাও হতে হবে, যদি প্রেমিকার দোষ নিজের কাঁধে নিতে হয় তাও নিতে হবে, আবার প্রেমিকা অধরা সবুজ আলো হলেও ওয়েস্ট অ্যাগের পোতাশ্রয়ে দাঁড়িয়ে তার নাগাল পাওয়ার আশা করতে হবে। আশাই সত্য প্রেমের প্রকৃত সঞ্জীবনী শক্তি।
বাংলাদেশ সময়: ১১০১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৭
এসএনএস