কিন্তু তখন থেকেই দূর প্রান্তের চট্টগ্রামে তরুণ মেধাবী লেখক মহীবুল আজিজ যে ইতালো ক্যালভিনোর অসাধারণ গল্পগুলো নিয়ে মেতেছিলেন, সে তথ্য অনেকেরই অজানা ছিল। সুদীর্ঘকাল পরে তিনি যখন গল্পগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন, তখনই কেবল বিষয়টি সাহিত্য বোদ্ধাদের নজরে আসে।
ইতালো ক্যালভিনো হলেন সেই লেখক, যাকে সমকালীন আরেক লেখক চিহ্নিত করেন, ‘লেখালেখির কাঠবেড়ালি’ নামে। কারণ, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও মননশীলতাকে অকাতরে ঢেলে দিয়ে অকল্পনীয় সৃজনী ক্ষমতা দেখাতে ক্যালভিনোর মতো খুব কম লেখকই পেরেছেন। তিনি মানব অনুভূতির অতলে ডুব দিয়ে তুলে এনেছেন অদেখা মানবিক বোধ ও অনুভবের জগৎ। সমাজ ও মানুষের এমন কিছু প্রপঞ্চ ক্যালভিনো এঁকেছেন, যা তিনি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
কিউবার সান্তিয়াগো শহরের দ্য লাসভেগাসে ইতালো ক্যালভিনোর জন্ম ১৯২৩ সালের ১৫ অক্টোবর। আর মৃত্যু ১৯৮৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। কৃষিবিদ পিতার সঙ্গে তিনি নিজের দেশ ছাড়াও সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকা চষে বেড়িয়েছেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন প্রাণবৈচিত্র্যের নিখুঁত পরিচয়। দু’জনের প্রভাবই তার গল্পে স্পষ্ট।
কৃষি ও বনানীময় মানুষের কথাগুলোকেই ক্যালভিনো বলেছেন অভিনব চমকের মাধ্যমে। গল্পের বুনন ও আঙ্গিকের দিক থেকে নিজস্ব অসাধারণ পটুত্ব দিয়ে এখনো মাতিয়ে রেখেছেন বিশ্ব কথাসাহিত্যের পুরো দুনিয়াটিকেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্যালভিনো ছিলেন ইতালির তুরিনে। তখন ফ্যাঁসিবাদ ও নাৎসিবাদের বিরোধিতায় সমাজতন্ত্রের দিকে মনোদার্শনিকভাবে ঝুঁকে পড়েন তিনি। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের দশ বছরের মাথায় ১৯৫৭ সালে হাঙ্গেরিতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের প্রতিবাদে দল ছেড়ে নিজের লেখালেখির অঙ্গনেই স্থিত হন।
পূর্ণকালীন লেখক জীবনে ক্যালভিনো তিনটি উপন্যাস ও অসংখ্য ছোট গল্প রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে- দ্য ক্রো কামস্ লাস্ট, দ্য ব্যরন ইন দ্য ট্রিজ, কসমিকোমিকস, দ্য হোয়াইট সুনার, দ্য ইয়ুথ ইন তারিন।
জীবিকা নির্বাহে মাঝে মাঝে সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণকারী ক্যালভিনোর লেখার অভিনবত্বই তাকে জনপ্রিয় করেছে। একটি গল্প তিনি শুরু করেছেন এভাবে- ‘একটি শহর ছিল, যেখানে সবই নিষিদ্ধ। শুধু একটি বিষয় নিষিদ্ধ ছিল না, আর তা হলো ডাংগুলি। ফলে সবাই শহরের পেছনের বড় মাঠে জড়ো হতো। আর দিন পার করে দিতো ডাংগুলি খেলেই’।
চমৎকার রূপক আর চিত্রকল্প দিয়ে ক্যালভিনো একটি অবরুদ্ধ জনপদকে কয়েক লাইনেই বুঝিয়ে দিতেন। এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে তার আখ্যানের ভাজে ভাজে।
মহীবুল আজিজ ঝরঝরে ভাষায়, গভীর তথ্য বিন্যাসে অনুবাদের সঙ্গে ক্যালভিনোর যে জীবনালেখ্য দিয়েছেন, সেটি নিঃসন্দেহে মূল্যবান পাওয়া। ক্যালভিনোর এমন গল্পগুলোকেই তিনি অনুবাদের জন্য বেছে নিয়েছেন, যেগুলো সমাজের অনেক লুকোনো ক্ষতকে উন্মোচিত করে এবং ঘুঁনেধরা সমাজের পাটাতন ধরে তীব্র নাড়া দেয়।
‘গ্রন্থাকারে এক জেনারেল’, ‘একটা কিছু কর’, ‘বিড়াল এবং পুলিশ’, ‘বিবেক’, ‘শত্রুর চোখ’, ‘আকাশমুখো নৃ-গোষ্ঠি’ ইত্যাদি গল্পে স্বাধীনতা, মানবিকতা, নৈতিক স্বাতন্ত্রের অমল মাত্রায় ব্যক্তিসত্তার অচলায়তন ভেঙে মুক্তির দরোজায় কড়া নেড়েছেন ক্যালভিনো। উত্তরাধুনিক বা বিশ্বায়নের মানুষের একক ও সার্বভৌম জাগৃতির গান তার গল্পের অন্তর্গত মূলস্রোত। প্রথা, প্রতিষ্ঠা, দর্শনের নামে মানবসত্তার বন্দিত্বকে অস্বীকার করে মানবমুক্তির অলঙ্কারে পরিণত করার কৃতিত্বে ক্যালভিনোর গল্পগুলো পাঠকের মনের গভীরে অমোচনীয় দাগ রেখে যায়।
বাংলা ভাষার পাঠকরাও মহীবুল আজিজের অনুবাদ করা এ বইয়ে ক্যালভিনোর গল্পের হাত ধরে শিহরণ জাগানো জগতের সন্ধান আর অনাস্বাদিত বিষয়ের আনন্দ পাবেন।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-গল্পকার-গবেষক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ২২২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৭
এমপি/এএসআর