ড. তপন বাগচী একাধারে কবি-গল্পকার-ছড়াকার-প্রাবন্ধিক-গীতিকার-গবেষক। তার জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৩ অক্টোবর মাদারীপুরের কদমবাড়ি গ্রামে।
তপন বাগচী রচিত দু’টি জীবনীগ্রন্থ ‘বিপ্লব দাশ (২০০১)’ ও ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৯৯৮)’ অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। প্রবন্ধ এবং জীবনীগ্রন্থই নয়; অনেক সিরিয়াস গ্রন্থের পাশাপাশি ছোটদের আনন্দ দিতেও ভোলেননি তিনি। তাই তো ছড়া নিয়ে হাজির হয়েছেন কোমলমতি শিশুদের কাছে। তার ছড়াগ্রন্থ সমকালে তমকালে (২০১০), খাচ্ছে ছুটি লুটোপুটি (২০০৯), মঙ্গা আসে ঘরের পাশে (২০০৮), স্বপ্নেবোনা তূণীর সোনা (২০০৭), চড়কাবুড়ি ওড়ায় ঘুড়ি (১৯৯৫), রাতের বেলা ভূতের খেলা (২০০৮), রুখে দাঁড়াই বর্গী তাড়াই (১৯৯৪) শিশুদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি নানাবিধ শিক্ষাও দিয়ে গেছে।
তিনি প্রবন্ধ, জীবনী আর ছড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। কাব্যজগতে তার দাপুটে বিচরণ পাঠকের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কবিতার বই নির্বাচিত ১০০ কবিতা (২০১০), সকল নদীর নাম গঙ্গা ছিল (২০০৭), অন্তহীন ক্ষতের গভীরে (২০০৫), শ্মশানেই শুনি শঙ্খধ্বনি (১৯৯৬), কেতকীর প্রতি পক্ষপাত (১৯৯৬) পাঠকের ভালোবাসা অর্জন করে নিয়েছে। এতো এতো অভিধার পরও একটি অভিধা তাকে তাড়া করেছে। সেখানে স্বাক্ষর রেখেছেন কৃতিত্বের। দু’টি গল্পগ্রন্থও উপহার দিয়েছেন আমাদের। তার গল্পগ্রন্থ শখের গোয়েন্দাগিরি (১৯৯৩) ও সাতদিনের সাতকাহন (২০১১) আমাদের গল্প শুনিয়েছে। তার গল্পও আমাদের বিমুগ্ধ করেছে।
তপন বাগচী তার সুযোগ্য হাতে সম্পাদনা করেছেন দু’টি গ্রন্থ। আনন্দনাথ রায়ের ফরিদপুরের ইতিহাস (২০০৭) ও একুশের নতুন কবিতা (১৯৯২) তার উল্লেখযোগ্য সম্মাদিত গ্রন্থ। এখানেই শেষ নয়। তিনি এখনও লিখে চলছেন বিরামহীন। আরও কিছু গ্রন্থের কথা হয়তো উল্লেখ করতে পারিনি যথাযথ তথ্যের অভাবে। এছাড়া তিনি যে ভবিষ্যতেও লিখবেন; তার পরিচয় হয়তো আপনারা ভবিষ্যতেই পেয়ে যাবেন।
মানুষ পরিশ্রম করলে অবশ্যই তার ফলাফল পেয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে সৃজনশীল মানুষদের বড় স্বীকৃতি তার ভক্ত-অনুরাগী। তবুও প্রাতিষ্ঠানিক কিছু স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন আমাদের পুলকিত এবং গর্বিত করে। তেমন গর্বিত প্রাপ্তি হচ্ছে পুরস্কার বা সম্মাননা। সেই প্রাপ্তিও যুক্ত হয়েছে তপন বাগচীর ভাগ্যে। তিনি নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা ২০১১), বগুড়া লিটল ম্যাগাজিন মঞ্চ সংবর্ধনা (নদীয়া ২০১০), সুনীল সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), কবি বাবু ফরিদী সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা (২০০৯), মহাদিগন্ত সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা ২০০৮), জেমকন সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতি পদক (২০০৮), জসীমউদ্দীন গবেষণা পুরস্কার (১৯৯৬), মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৮) লাভ করেন।
লেখালেখির কথা বলতে গেলে, বাংলা প্রবন্ধে তপন বাগচী এক অনবদ্য নাম। তার আগ্রহের বিষয় বাংলা সাহিত্য, লোকসংস্কৃতি, লোকনাট্য, গণমাধ্যম, মুক্তিযুদ্ধ, আঞ্চলিক ইতিহাস, জীবনী প্রভৃতি। এছাড়া গল্প, কবিতা, ইতিহাস ও ছড়া নিয়ে প্রাবন্ধিকের নিজস্ব চিন্তা স্থান পেয়েছে তার লেখায়। তার প্রবন্ধে লালন শাহ, জসীমউদ্দীন, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী নজরুল ইসলাম, হাসান হাফিজুর রহমান, ননী গোপাল সাহা, মোহাম্মদ রফিক, যোগেন মণ্ডল, নূহ-উল-আলম লেনিন, আহমাদ মাযহার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিশিষ্টজনের প্রাসঙ্গিক আলোচনা স্থান পেয়েছে।
তাকে দেখা গেছে অঞ্চলভিত্তিক কাজের ক্ষেত্রে নিষ্ঠার পরিচয় দিতে। সবক্ষেত্রে সমান পারঙ্গমতায় যাত্রাগান নিয়ে তার নিরীক্ষাধর্মী পর্যালোচনা অবশ্যই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবার মতো বিষয়। বিলুপ্তপ্রায় যাত্রাগানের নানাবিধ সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করেছেন তিনি। পাশাপাশি লোকসংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণাও রয়েছে তার। এজন্য তাকে ‘শেকড়সন্ধানী শিল্পী’ বলা যেতে পারে। কেননা তিনি লোকসংস্কৃতি নিয়ে গভীর নিরীক্ষা চালিয়েছেন। আবিষ্কার করেছেন অজানা অনেক অধ্যায়। লোকসংস্কৃতির অন্তর্গত অবেহেলিত যাত্রাশিল্প নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন পাঠক সমক্ষে।
তিনি লোকজ যাত্রাগান ও তার শিল্প উপযোগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। যাত্রাগানে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গ ফুটিয়ে তুলেছেন। যাত্রাগানে নারীর অংশগ্রহণ ও উপস্থাপন কৌশল নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার ফল প্রকাশ করেছন। প্রবাদ-প্রবচনে লোকজ্ঞান ও নারী প্রসঙ্গ নিয়ে তার আলোচনা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। পূর্বাঞ্চলীয় বাউলগানের ধারা ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে অকপটে আলোচনা করেছেন। আলোচনা করেছেন রাধারমন এবং শাহ আবদুল করিমের গান নিয়ে। চলচ্চিত্রে লোকজ জীবনের অন্বেষা ফুটে উঠেছে তার প্রবন্ধে। কথা বলেছেন দলিত সম্প্রদায় নিয়েও।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ জীবনীগ্রন্থে কবির পরিবার পরিচিতি, শিক্ষাজীবন, সংসারজীবন, কর্মজীবন, সাময়িকপত্র সম্পাদনা, কতিপয় চরিত্র বৈশিষ্ট্য, শেষ জীবন ও মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করেছেন। তুলে এনেছেন সমকালীন প্রতিক্রিয়াও। এছাড়া একজন গীতিকবি হিসেবেও যথেষ্ট সুনাম রয়েছে তার। চিন্তাসূত্রে প্রকাশিত একটি গান ভারতের ‘তারা বাংলা’ চ্যানেলে প্রচারিত হয়। যে গানটি মূলত যাত্রাশিল্পের দুর্গতি ও অবক্ষয় নিয়ে। গানের কথা হচ্ছে, ‘ভাই রে আগের দিন আর নাই/ যাত্রাগান কালে খাইছে, (তারে) কেমনে যে ফেরাই’। গানটি চিন্তাসূত্র নামের একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশের পর সেটি পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে গাইতে উৎসাহী হন শিল্পী সঞ্জয় মণ্ডল। এছাড়া তপন বাগচীর লেখা অনেক গান বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর গেয়েছেন। মালালা ইউসুফজাই, সুচিত্রা সেন, নেলসন মেন্ডেলা, ভিক্টর হুগো, সৈয়দ শামসুল হক, ভাষা মতীন প্রমুখের জীবনভিত্তিক লেখা গান দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চ্যানেলে পরিবেশন করেছেন ফকির আলমগীর। পাঠকের উদ্দেশ্যে তার একটি গান উদ্ধৃত করছি,
‘আজকে তুমি আসবে বলে
দুয়ারখানি খুলে রাখি।
বুকের কাঁটা নিয়েছ তাই
চুলের কাঁটা তুলে রাখি॥
আসবে তুমি হাওয়ায় উড়ে
যতই তুমি থাক দূরে
সেই খুশিতে এমন নাচে
সব বিরহ ভুলে থাকি॥
আর দেব না দূরে যেতে
চাই সারাক্ষণ কাছে পেতে
তোমায় নিয়ে ভাসব বলে
নৌকাখানি কূলে রাখি॥’
প্রবন্ধে, কবিতায়, গল্পে, গানে অন্য এক সব্যসাচীর সন্ধান পাই আমরা। তিনি যতোদিন আমাদের মাঝে থাকবেন; ততোদিন আমরা আরও বেশি বেশি সাহিত্যরসদ সংগ্রহ করতে পারবো। পুরোটা সময়জুড়ে সাহিত্যচর্চায় নিমজ্জিত এ মানুষটির বয়স যদিও আমাদের ধর্তব্য বিষয় নয়। আমরা চাই, তিনি চির তরুণ, চির জাগ্রত, চির বিরাজিত হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে। তার অর্ধশত বর্ষে সব সাহিত্যসেবীর পক্ষ থেকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আগামীর পথচলা আরও মসৃণ হোক একামনায় ভুল-ত্রুটি মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার বিনয়াবনত আবেদন রেখে এখানেই শেষ করছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৭
এসএনএস