ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মেয়ে থেকে মেয়েলি অবধি | তানিয়া চক্রবর্তী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৭
মেয়ে থেকে মেয়েলি অবধি | তানিয়া চক্রবর্তী মেয়ে থেকে মেয়েলি অবধি।

“She was ready to deny the existence of space and time rather than admit that love might not be eternal.” 
― (Simone De Beauvoir, The Mandarins)
 
“Virtue can only flourish among equals”
(MARY WOLLSTONECRAFT)

আসলে “বাদ” বাদই দিলাম কিন্তু মেয়েদের জীবনে উত্তরণের গ্রাফ খেয়াল করলে দেখা যাবে, এক একটা সময় কীভাবে মেয়েদের নামিয়েছে ঠেলে। এখন সময়টা আমরা ধরতে পারছি বিভিন্ন মাধ্যমের  দৌলতে।

গণধর্ষণ আর শিশুদের ওপর যৌন অত্যাচারের খবর পড়তে পড়তে চোখ-কান বন্ধ হয়ে আসে, দেয়াল উঠে আসে হঠাৎ। এসবের পরেও বলছি “বাদ”–এ বিশ্বাস করি না এখনও পর্যন্ত কারণ, তাহলে একটা অংশকে বন্ধ করে দিতে হয়— যেই বন্ধ হওয়ার প্রয়াসে আসে বিবাদ বা জেহাদ বাড়ে। যেটা দরকার সেটা সংশোধন, আর সেটা সর্বস্তরে। খুব ছোট বয়স থেকে ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রকরণ সম্পর্কিত ভেদ সরিয়ে দিতে হবে। জীবনের দু’টো অংশ ভালো আর মন্দ!
 
এবার কথা হতে পারে এগুলো তো অনেকক্ষেত্রে আপেক্ষিক, সেক্ষেত্রে উত্তর— ব্যক্তি তো শুধু সংবেদনের প্রাণ নয়, তার শিক্ষা দিয়ে ভাবনা দিয়ে তাকে সমাজ, ভালো-মন্দ এবং আপেক্ষিকতার মিশেল বানিয়ে স্থিতিতে এসে বসার চেষ্টা করতে হবে। কারণ নারী, পুরুষের দ্বারা অবদমিত কখনও হবে না। খাদ্য-খাদক বোধ দিয়ে যে চাপা দেওয়ার প্রয়াস চলে সেটা খুব ব্যর্থ কারণ, এটা একটা সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা আর আধিপত্য একাংশের বেড়ে যাওয়ার কথা— যেমন বহু বন্যপ্রাণীকে মানুষ বশে আনতে পেরেছে, এটুকু সিদ্ধান্ত আসা গেছে মানুষ সত্যি পারবে বা পারে। কিন্তু খুব ভালো করে দেখুন কোনো এক জনুক্রমের মা বা মেয়ে যদি অত্যাচারিত হয় কিম্বা আর কিছু জনুক্রম ধরলাম খুব নিরীহ এবং পরিবেশ দ্বারা অবদমিত, তাদের থেকেই কিন্তু  কোনো এক অংশে এসে এক দুর্দান্ত চরিত্রের মেয়ের আগমন হবেই! এটা কোনো মিথগত বিষয় নয় কারণ, আসল বিষয় হলো মূলত নারী-পুরুষের পৃথিবীতে কোনোটাই বাদ যেতে পারে না এবং অসমান হতে পারে না। কোষের যে কায়জমাটি ভাগ হয় সেটিও বণ্টিত এবং এই যে ধরলাম দুর্দান্ত চরিত্রের আধিপত্য বিস্তারকারী পুরুষ, তাদের যদি নারী সন্তান জন্ম নেয় তাদের জিনগুলো যাবে কোথায়! এ তো বংশগতির ধারা— তাই মেয়েরা নিচে থাকবে আর ছেলেরা আধিপত্য বিস্তার করবে এই ধারণাটাই ভুল এবং সময় সেটা প্রমাণ করে দেবে।  মেয়ে থেকে মেয়েলি অবধি। সম্ভবত বিদেশের কোনো অঞ্চলে পাঁচটি মেয়ে এই কিছুদিন আগেই একটি পূর্ণবয়স্ক ছেলেকে যৌন অত্যাচার করে রাস্তায় ফেলে রেখে গেছে। যদিও  এটা কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিকার নয় কিন্তু এটা হতে পারে, সেই মেয়েরা অতিপুরুষ বা ধর্ষকামী ছেলেদের বংশগতিপ্রাপ্ত নারী বা সন্তান। অতএব এখানের অন্যায় এখানেই থাকবে, এখানের ভালো এখানেই থাকবে। বিষয়টা যতো না নারী-পুরুষ তার চেয়ে বেশী ন্যায়–অন্যায়ের।      
 
কিন্তু এতোকিছু সত্ত্বেও মেয়েদের ওপর অন্যায় এতো কেন বেশী! কারণ, দুর্বলতা পরিহার করতে পারেনি মেয়েরা। আরও একটি বিষয়,যে ক্ষেত্র পুরুষরা এতোদিন ধরে পেয়ে এসেছেন তা তারা নারীকে দেবেন কেন এটাও কিন্তু নারী-পুরুষ বিষয় নয়— বিষয়টা রাজনীতির কাছাকাছি কিছু। দু’টি ক্ষমতাবান মানুষের কম-বেশী ক্ষমতার ব্যবহারেও এই খেলাটাই চলে।  
 
হ্যাঁ, অবশ্যই  প্রকৃতিগত কিছু বিষয় আছে, তবে সেটা এতোখানিও প্রকৃতিগত নয় যে সেটাকে এড়ানো যাবে না। কারণ, আমরা মানুষেরা পরিব্যক্তির বংশধারা নিয়ে বেঁচে আছি। যে কাঠামো কাঠামোরই ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রথা বা নিয়ম বানায় সেই নিয়ম দিয়েই নারীকে কটুক্তি করা হয় সবচেয়ে বেশী। উদাহরণ, গণিকালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সমাজে পুরুষের উত্তেজনার ভারসাম্যকে সামলে রাখতে, খেয়াল করলে দেখা যায়— যে কোনো ক্ষেত্রের নারীকে ওই প্রথার নামে নাম দিয়ে ব্যঙ্গ করা হয় কিন্তু এসব কিছু থাকলেও পুরুষ বা নারী কাউকে বাদ দিয়ে একটা যুক্তিযুক্ত সমাজ চলবে না! মূল বিষয়টা হলো, অন্যায় আর ন্যায়। যেহেতু দু’টো মূল প্রকরণ নারী ওপুরুষ! তাই একদিক থেকে প্রতিবাদ করলেই সেটা “বাদ” হিসেবে চলে আসে! বিদেশে নারীদের  সম্ভোগের জন্য পুরুষদের দেহব্যবসায় পাওয়া যায় কিন্তু আমরা ব্রথেল বললেই প্রধানত নারী দেহব্যবসায়ীদের বুঝি বা বোঝানো হয়। এখানে সেই প্রকরণ একটি কারণ আবার খেয়াল করে দেখবেন, একটি স্বাভাবিক জীবনযাপনের মেয়ে তার ওপর রাগান্বিত পুরুষ সম্প্রদায় তাকে হঠাৎ “বেশ্যা”বলে ছোট করার চেষ্টা করল অথচ যুক্তিযুক্তভাবে এই ব্রথেলের মেয়েটি তাদেরই সামজিক কারণে সুন্দর ঘরের নালা হয়ে বেঁচে আছে কিন্তু এখানেও সেই প্রকরণই দায়ী। আসলে এই প্রকরণগত বোধটা সর্বজনীনভাবে সব মেয়েরা আমরা অস্বীকার করি না “ভীতু যোদ্ধা আর সাহসী যোদ্ধার” মতো। ফলে থেকে যাওয়া প্রকরণ হরমোন আর লিঙ্গের বাহানায় ক্লান্ত হয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে, এখানেই খরগোশ-কচ্ছপ গল্প শুরু হয়। মেয়েরা দুর্বল হতে থাকে আর তাকে মানবাধিকারের চেয়ে বেশী মহিলা কমিশনের কাছে যেতে হয়। আমাদের এখানে  ধর্ষণটা যে পর্যায়ে গিয়ে দেখা হয় তার চেয়ে অনেক ছোট জায়গাতেই সেটা অপরাধ— সেটা হলো শুধু “ব্যক্তির ইচ্ছের সঙ্গে অযাচিত জোর”, কিন্তু এই মুখ্য বিষয়টাকে বাদ দিয়ে যৌনতা/ সম্মান-অসম্মান কতো কী ভেবে ফেলা হয়! এই জোর জিনিসটাই তো চূড়ান্ত অপরাধ যেকোনো ক্ষেত্রেই। এখানে বেশীরভাগ ধর্ষণের বিষয় ঝুলে থাকে, তার মধ্যে যদি কারও ধর্ষণের অপরাধে ফাঁসি হয় সেটা নিয়েও শুরু হয় ইতি-নেতিবাচক কতো কথা। সম্প্রতি একটি এই সম্পর্কিত ছবি আমাকে অবাক করে তুলেছে। মনে হচ্ছে, যেন ধর্ষিতার চেয়ে ধর্ষণকারী বেশী সহানুভূতির অধিকারী কারণ, তার গুরুতর শাস্তি হতে চলেছে। এর মূলেও কিন্তু “বাদ” নয়। বিষয়টা হচ্ছে ন্যায়-অন্যায় বোধ!
 
সিমোন দ্য বোভেয়ারের কিছু কথা তুলে আনি এ প্রসঙ্গে কারণ, দেহরস, মন এগুলি প্রকৃতির নিয়মের জন্য কোথাও অবশ্যই বাধাদানকারী হলেও সেটা সমাজের শুভ গঠনের তাগিদ, ফলস্বরূপ এসবের অংশীদারকে অপমান করা মানে সমাজের একটা অংশ নষ্ট করা কারণ,কোথাও না কোথাও এর সঙ্গে ব্যক্তির তথা নারীর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাটি তারই অধীনস্থ।
 
“শুক্রাণু, যার ভেতর দিয়ে পুরুষের জীবন সম্প্রসারিত হয় অন্য আরেক জীবনে, তার কাছে অচেনা হয়ে যায় এবং বিচ্ছিন্ন হয় দেহ থেকে, তাই পুরুষটি তার স্বাতন্ত্র্যকে অক্ষতভাবে ফিরে পায়। নারী যে সময়কাল মুক্ত থাকে মাতৃত্বের দাসত্ব থেকে তখন স্ত্রীলিঙ্গটি মাঝে মাঝেই সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে পুংলিঙ্গ জীবটির” (দ্বিতীয় লিঙ্গ)
 
আসলে যে ভেদ আছে তা তো থাকবেই। দেহজনিত আর সংবেদনজনিত কারণ দিয়ে অনেকে পুরুষদের অন্যায়গুলো আড়াল করতে চান। তাদের উদ্দেশ্যে বলার, সমাজটা তো যৌথ তাই অন্যায় হতেই থাকলে সমাজ থাকবে না। আরও গুরুত্বের বিষয়, মানুষ সেই জীব যে প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে গঠন আর নিয়মকে প্রাধান্য দিয়েছে। কারণ সে বুঝেছে, প্রকৃতির মধ্যে সে আছে, সে নিজেই নিয়মের মধ্যে বশীভূত। তাই দেহ, আবেগ, ইন্দ্রিয় ইত্যাদি যদি কোনো ইন্দ্রিয়জনিত কারণ হয়েও থাকে, সে তাকে অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে আর যদি না রাখে সেটা ইচ্ছাকৃত। তার সঙ্গে যে কোনো ক্ষেত্রেই কোনো বাহানা কার্যকর নয়। যেমন কোনো শ্লীলতাহীন বিষয়ে মেয়েটির পোশাক আর ছেলেটির ইম্পালস–এর হাস্যকর বাহানা দেওয়া হয়ে থাকে। আমাদের এই দেশ দূর্গা, কালী, মনসা, শীতলা এমন আরও কতো নারীরূপ পূজিত হন আর সেই দেশেই মেয়েরা চূড়ান্ত অশ্লীলভাবে অপমানিত হয়। এর থেকে কী বোঝা যায়? এটাই বোঝা যায় যে, ধর্ম নয় ভয় নয় একটা বোধের অভাবে চারিদিক ধুঁকছে— সেখানে ন্যায়–অন্যায় আসল আলোচনার কেন্দ্র। বেশকিছুদিন আগে কলকাতা ফিল্ম ফেস্টে একটি ছবি দেখেছিলাম ‘অনার-কিলিং’ বিষয় নিয়ে, সেখানে গ্রামের প্রধান বিচারক একই গোত্রের দু’টি ছেলে-মেয়ের প্রেমের জন্য তাদের লোক দিয়ে হত্যা করিয়েছিলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে তাকে অনেক কাউন্টার প্রশ্ন করায় তিনি বলেছিলেন এটা পাপ তাই ইনি পাপের খণ্ডন করাতে এই খুন করিয়েছেন। এবার তাকে প্রশ্ন করা হয়, কোথায় লেখা আছে বা বলা আছে এটা পাপ! সে কিছু শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থের নাম করে। সাংবাদিক সেটা পড়ে শোনান যে, সেখানে এরকম কোনো কথা নেই। তবু সে অনড় বলতে থাকে এটা শাস্ত্রের লেখা এবং তার পূর্বপুরুষরা তাকে এটাই বলেছে। সুতরাং বুঝতে পারছেন আমাদের অসুবিধেটা কোথায়, আমাদের নিজে থেকে অর্জিত বোধের চেয়ে প্রভাবিত বেশী প্রচলিত কথায়। ফলস্বরূপ সমস্যা সমাধান হয় না। ন্যায়-অন্যায়, প্রকৃত সামাজিক বোধ আমাদের গোঁড়াতে ভ্রম এনে দিয়েছে। একটা দেশের মেয়ে উন্নত হলে সেই দেশটার গোটা অর্থে আর্থসামাজিক গঠনটাই লাভদায়ক হয়ে যায় এটা বোঝার আগে আমরা দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে ফেলেছি গ্লানিময় লালসার। যেহেতু দৈহিক শক্তিতে মেয়েরা দুর্বল তারা আগে থেকে নিজেদের আরও দুর্বল করে তোলে শুধু এই ভাবনাটাকে কায়েম করে।
 
ইদানিং সিরিয়ালের এই কথাটা পাশের ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসে “নারী যদি শঙ্কা ত্যাগ করত সে নিজেই শঙ্কর হয়ে যেত” ভাবতে ভালোলাগে, এই কথা তো এই দেশেই আছে। যে মাঠে গোলকিপার আছে প্রতিপক্ষের সেই মাঠেই তো নিজেদের গোলপোস্টও আছে। পৃথিবীর একটি ধর্ষণ শোনার বহু আগে থেকেই যেনো সাধারণ ঘরের মানুষ শিশুপুত্রটিকে বোধ দিয়ে গড়ে তোলেন। যেমন একটা গাছ কাটা হলে আমরা সন্ত্রস্ত দূর থেকে আরেকটা চারাগাছ পুঁতে দিই। আর দুর্বলতা বিশেষত শরীরী দুর্বলতার বিষয় হলে বাঘ মানুষকে হারাত কিন্তু মানুষ বাঘকে হারিয়েছে। তেমন নারী–পুরুষের শরীরী শক্তির বিষয়ে আসলে আগের উক্তিটাই খাটবে। কোনো আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস না তৈরি করে শুধু একটা জনুবোধ বাড়িয়ে চারাগাছ থেকে মহীরুহ বানাতে পারে। আমাদের হাত, আমাদের সম্পদ, আমাদের জায়গা, আমাদের ভাবনা— সুতরাং বাকিটা বুঝে নিই চলুন... “লিঙ্গ বৈষম্য”-কে কেবল একটা অন্যায় হিসেবে দেখুন, আমাদের যুদ্ধের পথ সহজ হবে অনেক। এটা কোনো মেয়েলি যুদ্ধ নয় এটা শুভ ও স্বাভাবিক সমাজের একটা বাস্তব কাঠামোর মানবিক যুদ্ধ! বহুকিছু বলার আছে তবুও এখানেই ইতি টানছি বাকিটা হয়তো অন্যকোথাও অন্যকোনো মুহূর্তে…
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।