ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়।। ড. মাহফুজ পারভেজ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৭
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়।। ড. মাহফুজ পারভেজ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়

বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৮৩ বছর। ঠিকই মাঝরাতে কবিতা আর নেশার ঘোরে নগর কলকাতা শাসন করে ঢুলুঢুলু পায়ে নিজের পাড়ায় এসে বলতেন: "অবনী বাড়ি আছো/দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া/কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া/‘অবনী বাড়ি আছো?" তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার বোহেমিয়ান রাজপুত্র শক্তি চট্টোপাধ্যায়। গত শনিবার ছিল তাঁর জন্মদিন।

১৯৩৪ সালের ২৫ নভেম্বর শক্তি চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণা অঞ্চলের জয়নগর-মজিলপুরের দরিদ্র হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বামানাথ চট্টোপাধ্যায়।

কলকাতার কাশিমবাজার স্কুলে পড়তেন। দারিদ্রের কারণে তিনি স্নাতক পাঠ অর্ধসমাপ্ত রেখে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়েন এবং সাহিত্যকে জীবিকা করার উদ্দেশ্যে উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন।

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়যদিও কলেজ জীবনে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি, তথাপি কবিতা নয়, 'কুয়োতলা' নামে জীবনের প্রথমে একটি উপন্যাস রচনা করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। পরে কলেজকালীন বন্ধু সমীর রায় চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বনাঞ্চল-কুটির চাইবাসায় আড়াই বছর থাকার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় একজন সফল লিরিকাল কবিতে পরিণত হন।
তারপর থেকে একই দিনে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলার অভ্যাস গড়ে ফেলেন তিনি। শক্তি নিজের কবিতাকে বলতেন পদ্য। ভারবি প্রকাশনায় কাজ করার সূত্রে তার শ্রেষ্ঠ কবিতার সিরিজ বের হয়।

পঞ্চাশের দশকে কবিদের মুখপত্র কৃত্তিবাস-এর অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম, হে নৈশব্দ' ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। পেশাগত জীবনে তিনি ১৯৭০- ১৯৯৪ কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেছেন।

১৯৬১ সালের নভেম্বরে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলনের জনক মনে করা হয় তাঁদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম। সাহিত্যিক মতান্তরের জন্য ১৯৬৩ সালে তিনি হাংরি গোষ্ঠী ত্যাগ করে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতে যোগ দেন। তিনি প্রায় ৫০টি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করে ছিলেন।

পরবর্তীকালে কৃত্তিবাসের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম সাহিত্যিক মহলে একত্রে উচ্চারিত হতো এবং সুনীল-শক্তি বন্ধুত্ব ও কাব্য সাধনা আজীবন অটুট থাকে। তাঁরা দুইজন পরিণত হন কবিতার অনবদ্য জুটিতে।

আনন্দ ও ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কারে সন্মানিত  শক্তি চট্টোপাধ্যায় গদ্য ও কথাসাহিত্যে কিংবা সাংবাদিকতায় হাত লাগানোর চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত কবিতাই ছিল তাঁর পরম আরাধ্য। জীবনভর অসংখ্য কবিতা রচনা করেন তিনি। প্রকাশ করেন বহু কাব্যগ্রন্থ: হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য (১৯৬২), ধর্মে আছো জিরাফেও আছো (১৯৬৭), সোণার মাছি খুন করেছি (১৯৬৮), অন্ধকার নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকার (১৯৬৮), হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান (১৯৬৯), চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৯৭০), পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি (১৯৭১), প্রভু নষ্ট হয়ে যাই (১৯৭২), সুখে আছি (১৯৭৪), ঈশ্বর থাকেন জলে (১৯৭৫), অস্ত্রের গৌরবহীন একা (১৯৭৫), জ্বলন্ত রুমাল (১৯৭৫), ছিন্নবিচ্ছিন্ন (১৯৭৫), সুন্দর এখানে একা নয় (১৯৭৬), কবিতায় তুলো ওড়ে (১৯৭৬), ভাত নেই পাথর রয়েছে (১৯৭৯), আঙ্গুরী তোর হিরণ্য জল (১৯৮০), প্রচ্ছন্ন স্বদেশ (১৯৮১), যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো (১৯৮৩, কক্সবাজারে সন্ধ্যা (১৯৮৫), ও চির-প্রণম্য অগ্নি (১৯৮৫), মিষ্টি কথায়, বিষ্টিতে নয় (১৯৮৫), সন্ধ্যার সে শান্ত উপহার (১৯৮৬), এই তো মর্মর মুর্তি (১৯৮৭), বিষের মধ্যে সমস্ত শোক (১৯৮৮), আমাকে জাগাও (১৯৮৯), ছবি আঁকে ছিঁড়ে ফ্যালে (১৯৯১), জঙ্গলে বিষাদ আছে (১৯৯৪), বড়োর ছড়া (১৯৯৪), সেরা ছড়া (১৯৯৪), টরে টক্কা (১৯৯৬), কিছু মায়া রয়ে গেল (১৯৯৭), সকলে প্রত্যেকে একা (১৯৯৯), পদ্যসমগ্র-১ম থেকে ৭ম খণ্ড ইত্যাদি।

প্রবল বেদনা নিয়ে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি ১৯৯৫ সালের ২৩ মার্চ, ঠিক যেন তাঁর কবিতার উচ্চারণের মতো: "আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী/ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি। "

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-কথাশিল্পী। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৭
এমপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।