ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

গুজবের দিনে | রিপনচন্দ্র মল্লিক

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৮
গুজবের দিনে | রিপনচন্দ্র মল্লিক গুজবের দিনে | রিপনচন্দ্র মল্লিক

মাঝে মাঝে আব্বু হারিয়ে যান। কোথায় যে যায় তা আমরা কেউ জানি না। ইদানীং তিনি হারিয়ে গেলে পনের-বিশ দিন পরে পরে ফিরে আসেন। কখনও কখনও এক মাসও চলে যায়। একটু কিছু হলেই তিনি খুব রেগে যান। রেগে গেলে তার কোনো হুশ-জ্ঞান থাকে না। তখন তিনি হাতের কাছে যা কিছু পান, সেটাই হাতে করে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে তীব্র ক্ষিপ্রতায় নর্দমার ভেতরে ছুড়ে ফেলে দেন।

আমার দাদি বলতেন,  ‘তোর বাপের এই রোগ ছোটবেলার থেকেই হইছে। কতো তাবিজ-কবজ পড়া দিছি কিন্তু কোনো কাজ হয় নাই।

’ আমরা সবাই দাদির কথাই মেনে নিতাম। কিন্তু ইদানীং আব্বুর রাগ অন্যমাত্রায় চলে গেছে। তিনি এখন আর রাগ হলে আগের মতো ঘরের দামী দামী জিনিসপত্র ভেঙে ফেলেন না কিংবা কোনো নর্দমার ভেতরে ফেলে দিয়ে আসেন না। এখন তার এক নতুন ও অদ্ভুত রোগ হয়েছে। রেগে গেলেই এখন তিনি হারিয়ে যান। খুব চুপচাপভাবে হারিয়ে যান। ঘাসের ডগায় কুয়াশা পড়ার মতো নিঃশব্দে হারিয়ে যান। একদিন কিংবা দুই দিন নয়, দেখা গেলো আম্মুর সাথে আব্বুর ভীষণ ঝগড়া শুরু হয়েছে, ঝগড়া-ঝাটি করতে করতে আম্মু কিংবা আব্বু ক্লান্ত হয়ে যান। অথবা আমি এইভাবে বলতে পারি, আমার আব্বু কিংবা আম্মু অশান্তি করতে করতে যখন তারা আশেপাশের বাড়ির কোনো এক মুরুব্বির কাছে নালিশ করতে করতে ঝিমিয়ে পড়েন তখনও বোঝা যায় না আব্বু এখনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়বেন নাকি কিছুক্ষণ পরে। দেখা গেলো, আব্বু ঝগড়া ঝাটি শেষে আম্মুর হাতের রান্না খেয়ে দেয়ে সবার অলক্ষ্যে কোনো এক ফাঁকে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়বেন। সেই যে সে বেরিয়ে পড়বেন তারপর দিন যাবে, সপ্তাহও চলে যাবে। তারপর কোনো একদিন তিনি খুব নীরবে ফিরেও আসেন। কোনো এক রাতে ঘরের দরজায় এসে টকটক করে শব্দ করে আমাকে হয়তো ডাকবেন, শীতল..এই শীতল..শীতল। আমি দেখা গেলো, তখন ঘুমে বিভোর থাকি। আব্বুর ডাক টের পেয়ে আম্মু বিছানা ছেড়ে উঠে অন্ধকার ঘরের আলোটা হাতড়ে হাতড়ে জ্বেলে ঘরের দরজা খুলে দেবেন। আব্বু টুপ করে ঘরে ঢুকে পড়বেন। আম্মুকে হয়তো কিছুই বলবেন না যেমন- কেমন আছো? ছেলে-মেয়েদের শরীর কেমন আছে? ইত্যাদি ইত্যাদি জাতীয় কোনো কথা বার্তা তিনি বলবেন না।
 
ঘরের দরজা আটকে দিয়েই আম্মুই বলতে থাকে, ‘এই শোনো, তোমার কী খুব খিদে পেয়েছে? ভাত খাবে?’ তখন আব্বুর মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দেওয়ার উপরে তখন আসলে বলা যায় পরের দৃশ্যটা কী হবে? দেখা গেলো, আব্বু ওইভাবে চুপচাপ তাদের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছেন কিংবা খাবার টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছে। আর আমার আম্মু একটু পর পর খাবার থালায় তরকারি কিংবা ডাল তুলে দিচ্ছেন। আব্বু যতোক্ষণ পর্যন্ত খেতে থাকবেন, দেখা যাবে এই সময়ের ভেতরে তিনি একটি কথাও মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেন না। বোবার মতন ভাত খেয়ে-দেয়ে বিড়ালের মতো করে পা টিপে টিপে হেঁটে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়বেন। তখন রাত গভীর থাকে। আম্মুও তখন আর বেশিকিছু আব্বুকে জিজ্ঞেস করেন না। অনেক দিন পরে, আব্বুকে কাছে পেয়ে চাঁদের আলো ঝলমলিয়ে ওঠার মতো তার চেহারা ফুটে বেরিয়ে পড়ে। আমার আম্মু এখন আর আব্বুর এভাবে হারিয়ে যাওয়াকে মেনে নিয়েছেন। আম্মু এমন মনে করেন যেনো, আব্বুর হারিয়ে যাওয়াটা তার মানসিক অধিকার থেকেই করে থাকেন। অথবা যেখানে হারিয়ে গিয়ে থাকেন, সেখানে মাঝে মাঝে হারিয়ে গিয়ে থাকাও উচিত। তাই ছোটবেলাতে দেখতাম, আব্বু হারিয়ে গেলে আম্মু খুব চিন্তিত হয়ে পড়তেন। এমনও মাঝে মাঝে হতো যে, আম্মুর ব্লাড প্রেশার বেড়ে যেত। আমরা তার মাথায় তেল-পানি দিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলতাম। কিংবা তিনি আব্বুর চিন্তায় খাওয়া-গোসল বাদ দিয়ে অসুস্থ হওয়ার মতন বিছানাশায়ী হয়ে পড়তেন। যতোদিন না পর্যন্ত আব্বু ফিরে আসেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের ঘরে এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি ও আমার ভাই বোনেরাও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তখন হয়তো আম্মুর বয়স কম ছিলো, তাই আব্বুর হারিয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারতেন না।
 
আমার আব্বু ছোটবেলা থেকেই বিলাসী জীবন যাপন করে বড় হয়েছেন। আমার দাদা ছিলেন আমাদের এই এলাকার বড় ব্যবসায়ী। ফলে আমার আব্বু সৌখিন জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। আমার দাদার কথা না বললেই নয়। তখনকার দিনে আমার দাদা ছিলেন গ্রামের এক উঠতি ব্যবসায়ী। ধান ও পাটের ব্যবসা করে বেশকিছু টাকা পয়সা জমিয়ে ফেলায়, গ্রামের মানুষ তাকে খুব সম্মান করতে শুরু করল। যদিও এই বিষয়টি আমার আদি পুরুষদের মধ্যে কারও ভাগ্যেই জোটেনি। জুটবেই বা কী করে? অতি দরিদ্র পরিবারের মানুষদের কপালে কী আর সামাজিক মান-সম্মান থাকে! তাদেরকে তো আর কেউ পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ডেকেও কোনো কিছু জানতে চায় না। তারা তো কেবল পরের জন্য কামলা খেটে খেটেই জীবনটাকে পার করে দিয়েছেন। কিন্তু আমার দাদা তার পূর্ব পুরুষদের হেঁটে চলা সেই চিরচেনা পথে হাঁটেননি। তিনি এই গ্রামের মানুষের কামলা খাটেনি। তিনি কামলা খাটাতে শুরু করেছেন।
 
তিনি খুব অল্প পুঁজি নিয়ে ধানের ব্যবসা শুরু করলেন। আমাদের গ্রামে তাদেরকে ফড়িয়া বলে ডাকা হয়। ফড়িয়াদের কাজ ছিল গৃহস্তের বাড়ি থেকে ধান, পাট, ধনিয়া কিনে এনে মোকামে বিক্রি করা। এটা চাট্টিখানি কথা নয়। এই কাজ করতেই মাথার ঘাম মাটিতে পড়ে যেত। ব্যবসার শুরুর দিকে আমার দাদার হাতে তেমন টাকা-পয়সা না থাকায় তিনি নিজেই এসব কাজ করতেন। তবে আমার আব্বার বয়স যখন চৌদ্দ কিংবা পনের বছর হবে, শুনেছি তখন থেকেই দাদার সাথে আমার আব্বুও ব্যবসার কাজে একটু একটু নেমে গেছেন। আব্বুকে দিয়ে দাদা কী আর করাবেন। বেশিদূর আব্বু লেখাপড়া করেননি। ফলে মাঝে মধ্যে আব্বুও দাদার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বসতেন। তবে তিনি ছিলে একটু বাউন্ডুলে প্রকৃতির। আমাদের পরিবারে মূলত তখন থেকেই ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়েছিল।
 
এই ব্যবসায়ই আমাদের পরিবারকে উচ্চবিত্ত পরিবারের তকমা এনে দেয়। ব্যবসায়ের কয়েক বছরের মাথায় আমার দাদা নিজেই বাড়ির কাছের কয়েকটি ছোট ছোট দোকান নিয়ে গড়ে ওঠা বাজারে মোকাম খুলে বসেন। তখনও বাজারটির কোনো নির্দিষ্ট নাম মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েনি। সেখানে বসেই তিনি কৃষককের কাছ থেকে ধান কিনে বড় বড় মহাজনী আড়তে বিক্রি করতে থাকেন। এভাবে চলতে চলতে একসময় তিনি নিজেই বাড়ির পাশের বাজারের কাছে চালের মিল বসিয়ে ফেলেন। সেই চালের মিলই আমাদের পুরো পারিবারিক জীবনকে বদলে দিয়েছিল। মূলত তখন থেকেই আমাদের জীবনে আসতে থাকে সুখের চাকচিক্য। কয়েক বছরের ব্যবধানের ভেতরেই আমাদের পরিবারের সদস্যদের চাল-চলন, আচার-আচারণ, বেশ-ভূষাতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়ে গেলো। এমনকি আমাদের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গ্রামের মুরুব্বিরা অত্যন্ত সম্মানের সাথে আচার-ব্যবহার করতে শুরু করলেন। দাদির মুখ থেকে শুনেছি, তারপর থেকে ধীরে ধীরে আমাদের গ্রামের সব মানুষজনই আমার দাদার উপরে ভরসা রাখতে শুরু করে। গ্রামের মানুষজন বুঝতে পেরেছে, সবার চোখের সামনে দাদা ধান চালের ব্যবসা করে উন্নতি করছেন। সবাই আমাদের কাছেই ধান বিক্রি করতে আসেন। শুধু কী আমাদের এই গ্রাম। আশে পাশের কতো গ্রামের শত শত মানুষ আমাদের ধান চালের মিলে চলে আসে। দাদার সুনাম মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে, গঞ্জ থেকে শহরে। সেই সময়ে আমার আব্বু তরুণ ছিলেন। তখন তিনি খুব রকমের বাউন্ডুলে কিংবা বলতে পারি তিনি একজন প্রেমিক ছিলেন। শুনেছি আব্বু খুব আদর যত্ন আর দাদার শান-শওকতে বড় হওয়ায় তার হৃদয় দুরন্ত ছিলো। যখন যেখানে যা মন চাইত তখন সেখানেই তিনি তাই করতে চাইতেন। এবং বলতে পারি, তিনি প্রায় সময়ই তার ইচ্ছেটাকে পুরণ করতেন। দাদির মুখে প্রথম শুনেছিলাম, আমার আব্বু যে বছর কলেজে ভর্তি হয়েছেন, সেবছরই তিনি একটি মেয়েকে নিয়ে হারিয়ে গেলেন। কিন্তু আমার দাদা, তার বড়ছেলের এভাবে বিয়ে হবে, তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। আত্মীয়-স্বজন, থানা-পুলিশ করে যখন আব্বুকে খুঁজে পাওয়া গেলো ততোদিনে পনের দিন কেটে গেছে। কিন্তু আমার দাদা ওই মেয়েকে মেনে নিতে পারেননি। যেহেতু আমার দাদা আব্বুর বউ হিসেবে ওই মেয়েকে মেনে নিতে পারেননি, ফলে ওই মেয়েকে বাড়িতে তুলে আনা অনেক কঠিন হয়ে যায়। আমার দাদারও অনেক টাকা পয়সা হওয়ায় এবং এলাকাজুড়ে তার নাম-খ্যাতি-যশ ছড়িয়ে পড়ায় তার নিজের ভেতরে এক ধরনের আত্ম-অহংকার চলে আসে। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন যে, তার এতো মান-সম্মান সেখানে তার ছেলে এভাবে একটি মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, আর তিনি সেটাকে হাসতে হাসতে মেনে নেবেন— এই বিষয়টিই তিনি মানতে পারেননি। এবং শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি তাই ঘটেছিল। আমার আব্বুও শেষ পর্যন্ত পারিবারিক মান-সম্মানের কথা বিবেচনা করে দাদার কথাই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। দাদির মুখে শুনেছিলাম, আদরের দুলাল আমার দাদির বড়ছেলে মানে আমার আব্বু প্রায় ছয় মাস প্রায় মানসিক ভারসাম্যহীন একজন মানুষ ছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে গেলেও সেই যে তখন থেকে আব্বুর পাগলামি শুরু তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। মানে হচ্ছে, মাঝে মাঝে তার মাথায় শয়তান চাড়া দিয়ে ওঠে। তখন রাগের মাথায় ঘরের ভেতরে কিংবা হাতের কাছে যা পেতেন, একেবারে নর্দমার মধ্যে ফেলে দিয়ে আসতেন। আব্বুর এমন সব পাগলামী কিংবা আতলামি অথবা বলতে পারি বদ-মেজাজের কারণে আমার দাদা ও দাদি ভীষণ অস্বাস্তিতে থাকতেন। তারা ভেবেছিলেন, বিয়ে-শাদি করিয়ে দিলে তার এমন সব বদ-মেজাজী কাণ্ডগুলো ধীরে ধীরে কমে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আমার আব্বুর বিয়ের জন্য দাদা মেয়ে খুঁজতে শুরু করলেন। কিন্তু কোথাও মেয়ে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। আব্বুর মাথা যে মাঝে মাঝে গরম হয়ে যায় এই ব্যাপারটিই তাকে বিয়ে করানোর জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা গেলো, কোথাও মেয়ে দেখে পছন্দ হয়েছে, তো মেয়ের পরিবার খবর পাঠায় তাদের মেয়ে পড়াশোনা করবে, তো এখন কিছুতেই বিয়ে বসতে চায় না। অথবা যে সময়ের মধ্যে ভালো-মন্দ খবর পাঠানোর সময় দেওয়া থাকে, মেয়ের বাবা সেই সময়ের মধ্যেও কোনো খবর পাঠান না। ফলে আব্বুকে বিয়ে করাতে গিয়ে দাদা বেশ ঝামেলাতেই পড়ে গেলেন। কী আর করার আছে। শেষ পর্যন্ত আমার দাদা তার ভায়রাকে ধরলেন। তার ঘরের বড়মেয়েটি বেশ লক্ষ্মী টাইপের মেয়ে। গোলগাল চেহারা। ফর্সা-লম্বা মতো একটি মেয়ে। মেয়েটির মুখ মনে পড়লেই মাটির তৈরি মা লক্ষ্মীর মুখ মনে পড়ে যায়। আমার নানা ছিলেন আমার আব্বার খালু। বুঝতেই পারছেন, আমার আব্বা শেষ পর্যন্ত তার খালাতো বোনকে বিয়ে করলেন। যিনি আমার আম্মু। আমার আব্বুকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য ঘরের সবাইকে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। যে মেয়েটিকে নিয়ে আব্বু হারিয়ে গিয়েছিলেন, তাকেই আব্বু ঘরে তুলে আনতে চাইছিলেন। কিন্তু আমাদের ঘরের কেউ তখন সেই মেয়েকে বউ হিসেবে আনতে রাজি ছিলো না। আব্বুর অনেক ঝক্কি-ঝামেলার পরেও পরিবারের চাপে আমার আম্মুকে বিয়ে করতেই হয়েছে। আমার আম্মু আপাদমস্তক একজন সংসারি মেয়ে। বিয়ের পর থেকেই তিনি এই সংসারের গৃহকর্মের হাল যে ধরেছেন, এখ্রি পর্যন্ত সেই হাল ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে আম্মুকেও কম কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। বিয়ের রাতেই আম্মুর এক বিশাল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমার দাদার যেহেতু টাকা পয়সা অনেক হয়েছিল। ফলে তার ছেলে হিসেবে আমার আব্বু বেহিসেবীভাবে টাকা পয়সা খরচ করার লোক ছিলো। তিনি খুব নেশা করতেন। সিগারেটের তামাকগুলো বের করে তিনি তামাকের সাথে গাঁজা মিশিয়ে সিগারেটের খোসার ভেতরে তামাক ও গাঁজার মিশ্রণ পুরে প্যাকেট ভরে রাখতেন। যখন মন চাইত, তখন তিনি গাঁজা মেশানো সিগারেটে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেন। গাঁজা খাওয়া তো তিনি এখনও ছাড়তে পারেননি। আমাদের সবাইকে তিনি ছাড়তে পারেন, কিন্তু গাঁজা খাওয়া তিনি ছাড়তে পারেন না। শুধু গাঁজাই নয়। আব্বু তো বিভিন্ন ব্রান্ডের দেশি-বিদেশি মদও ঢকঢক করে গিলে ফেলতেন। যেহেতু দাদার অনেক টাকা-পয়সা ছিলো, ফলে টাকা-পয়সা নিয়ে তাকে তেমন ভাবতে হতো না। তো যে কথা বলছিলাম, আম্মুর যেদিন বাসর রাত ছিলো। সে রাতেই আব্বু এক বোতল বিদেশি মদ নিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন। সারা রাত মদ খেয়ে খেয়ে সেই যে আব্বুর মাতলামি কিংবা পাগলামি আম্মুকে সহ্য করতে শুরু হয়েছিল, সেটা এখনও পর্যন্ত চলছেই। আম্মু কখনও কখনও আব্বু কিংবা আমাদের ভাই-বোনদের উপরে রেগে গেলে আব্বুর এইসব কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরে তার ব্যক্তিগত আক্ষেপগুলো বলতে থাকেন। বলতে থাকেন, তিনি কতো জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে এখনও এই সংসারে পড়ে আছেন। কেন পড়ে আছেন? আমাদের মায়ায় পড়ে আছেন। আমি ও আমার ছোটবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি এখনও পড়ে আছেন। তার এই পড়ে থাকা আমাদের আরও বেশি বড় হতে আশাবাদী করে তোলে। গত কয়েক দিন ধরে আব্বুর সেই পুরনো রোগ হয়েছে। এবার অনেক দিন পরে, আব্বুকে তার পুরনো রোগে ধরেছে। কম করে হলেও প্রায় এক বছরের কাছাকাছি তো হবেই। দশ কিংবা এগারো মাস আগে শেষবার আব্বু হারিয়ে গেলেন। প্রায় একমাস পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন। আব্বুর হারিয়ে যাওয়াটাকে আম্মু মেনে নিয়েছেন। কারণ, তিনি মাঝে মাঝে বাড়ির পাশের ফুফুদেরকে আব্বুর হারিয়ে যাওয়ার পক্ষে কথা বলতে শুনতাম। দেখা গেলো হয়তো কোনো এক প্রতিবেশী ফুফু আম্মুকে বলছেন- ‘ভাবী, ভাইজান কী বড়ভাবীর বাড়ি গিয়া আটকিয়ে গেছে নাকি। অনেকদিন ধরে তো দেখি না’। ফুফুদের এমন কথায় হয়তো মাকে বলতে শুনতাম- ‘ক্যান, তার তো সে বাড়িতে পড়ে থাকার হক আছে। এখানে সেখানে বেড়াতে যাওয়ার হক আছে। থাকুক। যতোদিন থাকে। থাকুক। আমি তো তাকে সব সময়ই কাছে পাই। সে বেচারী তো পায় না। থাকুক। যতোদিন ভালো লাগে সে থাকুক’।
 
আমি এসব কথার অর্থ খুব বেশি বুঝতে পারতাম না। কিংবা বুঝতে চেষ্টা করতাম না। অথবা কখনও করিনি। তবে আম্মুকে কয়েকদিন ধরে মাঝে মাঝে বলতে শুনি, ‘দেশে রাজাকার গো নিয়া কী গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। এক পক্ষ হরতাল ডাকে, আরেক পক্ষ প্রতিরোধ ডাকে। কবে যে এসব থামবে জানি না। টিভি খুললেই রাজাকার গো বিচারের খবর দেখায়। দেশে কী আবার রায়ট লাগবে নি। তোর আব্বু এর মধ্যে কোথায় গিয়া যে হারাই গেছে। কী যে করি। কোনো খোঁজ খবর তো পাই না। সে যেভাবে রাস্তা ঘাটে চলাফেরা করে। কী থেকে কী হয়ে যাবে, কেউ কী তা জানে?’ অনেক দিন পর এই প্রথম আব্বুর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে আম্মুকে খুব টেনশনে পড়তে দেখলাম। যখন থেকে একটু একটু বুঝতে শুরু করেছি, তখন থেকেই আম্মুকে কিন্তু খুব সহজে এমনভাবে খুব একটা চিন্তিত হতে দেখতাম না। অথবা নির্দিধায় বলতে পারি, এমনটা আমরা কখনও দেখিনি। আম্মুকে দেখে মনে হচ্ছে, আব্বুর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে তিনি এমনভাবে বিচলিত হয়েছেন যে, দেশে রায়ট লাগছে। খুব ঝামেলাময় কিছু হচ্ছে। পথে-ঘাটে যেকোনো সময় দুর্ঘটনায় আব্বুর কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সকাল থেকে মানুষ বলাবলি করছে, রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদী হুজুরকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলানোর রায় দেওয়া হয়েছে। তারপর থেকেই সারা দেশ স্তব্ধ। আমাদের বাড়ির আশেপাশের মুরুব্বিরা বলাবলি করছেন, গতকাল রাতে নাকি রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে। তিনি খুব ভালো ওয়াজ করেন। অনেক মানুষ তার মুরিদও হয়েছে। তার মুরিদরা সাঈদী হুজুরের ফাঁসি মানতে পারছে না। রাত থেকেই ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে। পুলিশের সাথে তারা যুদ্ধে নেমে গেছে। চারপাশে কী যে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। আমি সকাল থেকেই বাসায় টিভি খুলে বসে আছি। টিভির স্ক্রলে একটু পরপর নিহত মানুষের লাশের সংখ্যা বেড়েই চলছে। পাঁচ মিনিট আগে পঞ্চাশজন নিহত দেখাচ্ছে। দেখা গেলো, তার পাঁচ মিনিট পরেই টিভিতে ষাটজন নিহতের খবর দেখাচ্ছে। মানুষ রাস্তায় নেমে পুলিশের সাথে সাঈদীর জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে। পুলিশকে তারা আক্রমণ করছে, আর বলছে, ‘আমাদের সাঈদী হুজুর নির্দোষ। আমরা তাকে চাঁদে দেখেছি।
 
ইস! আমার ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে কিংবা লজ্জা লাগছে যে, আমরা বাঙালিরা এখনও গুজবে কতো বিশ্বাসী। সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে। এমন অসম্ভব মিথ্যা কথাও এখন গুজব বানিয়ে বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে। এবং তার কিছু অন্ধ অনুসারীরা সেকথা বিশ্বাস করে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে। আবার তাদের আন্দোলনের ভেতরে সাধারণ দু-চারজন মানুষও যে মরে যাচ্ছে। এসব মিথ্যা আজগুবি গুজব আমার কানে আসলে খুব মেজাজ খারাপ হয়। যতোসব নোংরামি কাজ। যাই হোক আমি টিভির খবর দেখতে দেখতে হঠাৎ খবরের ভেতরে দেখি, এক মহিলাকে জড়িয়ে ধরে রাস্তার পড়ে থাকা একটি পোড়া গাড়ির ভেতর থেকে দুই জনের লাশ বের করে আনা হচ্ছে। আমি আর কোন কথা বলতে পারি না। এখন বুঝতে পারছি, আব্বু মাঝে মাঝে হারিয়ে গেলেও আমার আম্মু কেন এসব নিয়ে চিন্তিত হতেন না। কেন আমার প্রতিবেশী ফুফুদেরকে আম্মুকে বলতে শুনতাম, আব্বুর হারিয়ে যাওয়াতে আরেকজনের হক আছে। আব্বুর এমন একটি ছবি আমি দেখতে পাবো, তা কখনও কল্পনায়ও আসেনি। আব্বুর সাথে মারা যাওয়া ওই নারী কী আব্বুর সেই প্রেমিকা কিংবা আমাদের বড় মা? আব্বু যাকে খুব ভালোবেসে তার কাছে থাকার জন্য আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যেতেন? আমি কোনো কথা বলতে পারছি না। তবে কী আব্বু চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে বলেই আম্মুর বুকের মধ্যে খানিক বাদে বাদে ধক করে উঠেছিল! কেমন করে আম্মুকে বলি যে, আমার আব্বুকে আর কোথাও কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতোদিন আমাদের যে রঙিন জীবন ছিলো, সেখানে অন্ধকারের ছায়া একটু একটু আসতে শুরু করেছে। আমরাও ধীরে ধীরে গাঢ় শোকের কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছি। আব্বুর লাশ বাড়িতে আসতে আসতে দেখি সারা দিনের রঙিন সূর্যটি কখন যেনো ডুবে গেছে। রাতের আকাশের কোথাও চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে না। আমাদের বাড়ির উঠোনজুড়ে কুয়াশারা নেমে বুকের গহীনের বেদনাকে ঢেকে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের বেদনা কিছুতেই সরছে না।
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৮
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।